Hare to Whatsapp
রাজ্যের নজিরবিহীন আর্থিক অবস্থা নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর সাংবাদিক সন্মেলন ও বাস্তব
By Our Correspondent
আগরতলা, ফেব্রুয়ারি ৭, : মাস খানেক আগে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী যীষ্ণু দেববর্মা সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন রাজ্যের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভাল নয়। তাই সরকারী কর্মচারীদের ডি এ দেওয়া যাচ্ছে না। টাকার সংস্থান হলেই রাজ্যের সরকারী কর্মচারীদের ডি এ প্রদান করা হবে। একই রকমভাবে মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব নিজেও একাধিক অনুষ্ঠানে স্বীকার করেন চাহিদা অনুযায়ী টাকার সংস্থান করা যাচ্ছে না বলে ভিসন ডকুমেন্ট-এ প্রদত্ত বহু নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। টাকার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এবং ২০২৩ এর আগেই তিনি প্রতিটি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করবেন। না হলে তিনি ভোটে দাঁড়াবেন না।
মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন যে, আগামী তিন বছরের মধ্যে ত্রিপুরাকে তিনি মডেল স্টেট বানাতে চান। এবং তা সম্ভব। কেননা, কেন্দ্র ও রাজ্যে একই দলের সরকার থাকায় রাজ্যের উন্নয়নে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায়। এবং ত্রিপুরা সরকার এক্ষণে এই সুবিধা পাচ্ছেন। এবং মুখ্যমন্ত্রী নিজেও ত্রিপুরার বর্তমান সরকারকে ডাবল ইঞ্জিনের সরকার বলে অবহিত করেন। এবং দিল্লী থেকে ইতিমধ্যে একাধিক ক্ষেত্রে বেশ কয়েক হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত পাওয়া গেছে বলে বিভিন্ন সময় দাবী করেন। এবং তিনি গত দুই বছরে তের বার দিল্লী থেকে ফিরে এসে রাজ্যে এবং দিল্লীতে সাংবাদিকদের জানিয়ে ছিলেন কোন মন্ত্রক থেকে অতিরিক্ত কত টাকার মঞ্জুরী বা প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রীর সেই সব গুলি বয়ান একত্রিত করলে দেখা যায় কম করেও তিন হাজার কোটিরও বেশি টাকা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে অতিরিক্ত পেয়েছেন বা পাবেন। অবশ্য কত হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত পাওয়া গেছে এটা স্পষ্ট নয়। কেননা, বাস্তবিক অর্থে দেখা যাচ্ছে সরকারী কর্মচারীদের বেতন পেনসন কিংবা সামাজিক ভাতার অর্থ ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে সরকারী প্রশাসন অর্থের অভাবে অনেক চালু প্রকল্প চালিয়ে রাখতে পারছেন না। একাধিকবার রাজ্য সরকার বিভিন্ন সরকারী দপ্তর প্রধানদের কাছে ব্যয় সংকুচের বার্ত্তা সম্ভবলিত সার্কুলার পাঠিয়েছেন। শুধু তাই নয়, বেশ কিছু সরকারী দপ্তর ও নিগমের কাছে সার্কুলার পাঠিয়েছেন অতিরিক্ত অর্থ থাকলে ৭.৫% সুদ দেওয়া হবে সেই টাকা যেন রাজ্যের পরিকাঠামো উন্নয়ন খাতের জন্যে প্রদান করা হয়। অর্থাৎ রাজ্য কোষাগারে আর্থিক সঙ্কট রয়েছে এটা স্পষ্ট।
পাশাপাশি এটাও ঘটনা যে পুর্বতন বাম সরকারের বকেয়া ১১ হাজার কোটি টাকা দেনা যা এক্ষণে সুদে আসলে ১৩ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। তার উপর চতুর্থ অর্থ কমিশনের শেষ বছর হাওয়ার কারনে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে প্রয়োজন ও প্রতিশ্রুতি মোতাবেক অর্থ আসছে না। এই অবস্থায় রাজ্যের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা যে খুব একটা ভাল নয় এটা রাজ্যের অর্থমন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রী একাধিকবার স্বীকার করলেও গত ৬ই ফেব্রুয়ারী রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী হঠাৎ করে এক সাংবাদিক সম্মেলন করে দাবী করে বসলেন যে না, রাজ্যের কোন আর্থিক সঙ্কট নেই। সরকারী কর্মচারীদের বেতন পেনশন, সামাজিক ভাতার টাকা প্রদান কোন কিছুই বন্ধ হয়ে যায়নি যে কেউ বলতে পারে রাজ্যে আর্থিক সঙ্কট চলছে। শিক্ষামন্ত্রী একথাও বলেন যে, কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকেও পর্যাপ্ত অর্থ পাওয়া যাচ্ছে। তার মতে ত্রিপুরাইনফো ডটকম ও ত্রিপুরা দর্পন পত্রিকায় (যদিও নাম উল্লেখ করেননি শিক্ষামন্ত্রী) রাজ্যে নজরবিহীন অর্থসঙ্কট চলছে বলে যে খবর প্রকাশিত হয়েছে তা সম্পুর্ন মিথ্যা ও ভুল। শিক্ষামন্ত্রীর আরও দাবী, সাংবাদিকরা বাজেট বুঝেননা। বাজেট একটা কঠিন সাবজেক্ট। তাই হয়তো তারা ভুল লিখে দিয়েছে। শিক্ষামন্ত্রীর আরও অভিমত, এধরনের খবর করার আগে রাজ্যের অর্থ দপ্তরের সাথে যোগাযোগ করে দপ্তরের বক্তব্য জেনে নিলে ভালো হতো।
শিক্ষামন্ত্রী শ্রী রতনলাল নাথ রাজ্যে আর্থিক সঙ্কট নেই দাবী করতে গিয়ে যা বলেছেন এসম্পর্কে রাজ্য তথ্য ও প্রচার দপ্তর একটি প্রেস রিলিজ জারী করেছেন। তাতে বলা হয়েছেঃ-
স-৩৬৫৭
আগরতলা, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২০
কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার চায় জনগণের
টাকা যেন সঠিকভাবে খরচ হয়ঃ শিক্ষামন্ত্রী
বর্তমান রাজ্য সরকার ১২৭ টি কেন্দ্রীয় প্রকল্প, ৪টি রিএমবার্সমেন্ট প্রকল্প, ফিনান্স কমিশন গ্রান্ট সহ বিভিন্ন প্রকল্প গুলি যথাযথ ভাবে রূপায়নের লক্ষ্যে কাজ করছে। রাজ্য সরকার চায় জনগণের উন্নয়নের জন্য যে টাকা সরকারের কাছে রয়েছে তা যেন সঠিক ভাবে খরচ হয়। কারন যে কোনও সরকারই জনগনের কাছে দায়বদ্ধ থাকে। আজ মহাকরনের প্রেস কনফারেন্স হলে আয়োজিত সাংবাদিক সন্মেলনে একথা গুলি বলেন শিক্ষামন্ত্রী রতনলাল নাথ। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় সরকারের এমন কিছু কিছু প্রকল্প রয়েছে যেগুলির নাম পরিবর্তন হয়েছে এবং কিছু প্রকল্প অনিয়মিত হয়ে গেছে। সেই প্রকল্পগুলির অব্যয়িত টাকা খরচ করতে গেলে বিধানসভায় অনুমোদন নিতে হয়। রিএমবার্সমেন্ট প্রকল্পের ক্ষেত্রে আগে টাকা খরচ করে তার হিসেব দিলে টাকা পাওয়া যায়। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় প্রকল্পে প্রাপ্ত টাকা খরচ করে সঠিক সময়ে ইউটিলাজেশন সার্টিফিকেট দিতে হয়। তবেই পরবর্তীতে টাকা পাওয়া যায়। দেখা গেছে বিগত সরকার উদ্যান দপ্তরের ২০১৫-১৬, ২০১৬-১৭, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্পের ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট দেয়নি। বর্তমান সরকার সেগুলি রেগুলাইজেশন করার চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় সরকার ৬টি প্রকল্পে স্বাস্থ্য, খাদ্য এবং প্রানী সম্পদ বিকাশ দপ্তরকে সরাসরি টাকা প্রদান করেছে। এছাড়াও চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বরের মধ্যে রেগায় রাজ্য ৬৭৬ কোটি ৯১ লক্ষ টাকা পেয়েছে। রাজ্যের বিভিন্ন ব্লকে রেগায় কাজও হয়েছে। রেভিনিউ ডেফিসিট গ্র্যান্ট-এ ৮৭৫ কোটি টাকার মধ্যে রাজ্য পেয়েছে ৭২৯ কোটি ১০ লক্ষ টাকা। বাকি টাকা ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসের মধ্যেই পাওয়া যাবে। লোকাল বডিজ গ্রান্টে (আরবান) ৬৮ কোটি ২৬ লক্ষ টাকার মধ্যে ৬৩ কোটি ৬৪ লক্ষ টাকা পেয়েছে রাজ্য। এছাড়াও স্টেট ডিজাস্টার রেসপন্স ফান্ডে রাজ্য ৩৪ কোটি ২০ লক্ষ টাকা পেয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী জানান, কিছু কিছু প্রকল্পে ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট জমা না দেওয়ার কারনে ফান্ড পাওয়া যাচ্ছে না। রাজ্য সরকার চেষ্টা করছে সেগুলি রেগুলারাইজেশন করার জন্য।
শিক্ষামন্ত্রী জানান, কেন্দ্রীয় প্রকল্প ছাড়াও রাজ্য সরকার রাজ্যের উন্নয়নে নতুন নতুন প্রকল্প চালু করেছে। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ফসল বিমা যোজনার আওতায় আসা ২১ হাজার ৫০০ হেক্টর জমির মধ্যে যদি কৃষকরা টাকার অভাবে বিমার প্রিমিয়ামের টাকা দিতে না পারে সেক্ষেত্রে রাজ্য সরকার দায়িত্ব নিয়েছে সেই বিমার প্রিমিয়ামের টাকা প্রদান করার। এছাড়াও বি এড অনুপ্রেরণা যোজনা, নবম শ্রেনীর ছাত্রীদের জন্য বাইসাইকেল প্রদান, রেশনশপে চিনি প্রদান, সামাজিক ভাতা ৩০০ টাকা বৃদ্ধি, চিফ মিনিস্টার স্টেট অ্যাওয়ার্ড ফর অ্যাকাডেমিক এক্সিলেন্স ইত্যাদি নতুন প্রকল্প রাজ্য সরকার চালু করেছে। শিক্ষামন্ত্রী আরও জানান, রাজ্য সরকার ১৩টি এক্সটারনাল এইডেড প্রকল্পের প্রস্তাব কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট পাঠিয়েছে। সেগুলি হলো বিদ্যুৎ দপ্তরের পাওয়ার জেনারেশন, আপগ্রেডেশন ও ডিসট্রিবিউশনের জন্য ১৯২৫ কোটি টাকা, পর্যটন দপ্তরের পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য ৫০০ কোটি টাকা। আগরতলা শহরের উন্নয়নের জন্য নগরোন্নয়ন দপ্তরের ৫০০ কোটি টাকা। বন দপ্তরের ১৬৩০ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা, রাজ্যের ৭টি জেলা সদরের পরিকাঠামোর উন্নয়নের জন্য ১৬৫০ কোটি টাকা, শিল্পাঞ্চলের পরিকাঠামোর উন্নয়নের জন্য ৪০৬ কোটি ৭০ লক্ষ টাকা, জুমিয়া এবং জমিহীন জনজাতিদের উন্নয়নের জন্য ৩২৯ কোটি ৭৫ লক্ষ টাকা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য ১৪০৫ কোটি ৭০ লক্ষ টাকা, নদীর বাঁধ সংরক্ষন ও উন্নয়নের জন্য ১ হাজার কোটি টাকা, রাজ্যের স্টেট হাইওয়ের উন্নয়নের জন্য ৬৫ কোটি টাকা, গ্রামীন এলাকায় পানীয় জল সরবরাহের জন্য ১৫১৯ কোটি ৫৫ লক্ষ টাকা এবং আগরতলা পুরনিগম এলাকার পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য ১৩৪২ কোটি ৬৪ লক্ষ টাকার প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, বর্তমান কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার চায় জনগণের টাকা যেন সঠিকভাবে খরচ হয় এবং অপচয় যাতে না হয়। সেই দিশায় দেশের প্রধানমন্ত্রী ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কাজ করেছেন বলে শিক্ষামন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান।
সরকারী প্রেস রিলিজের উপরে উল্লেখিত বয়ান থেকে স্পস্টতই দেখা যাচ্ছে ত্রিপুরাইনফো ডটকম এবং ত্রিপুরা দর্পণ কিংবা পরবর্তীকালে আরও একাধিক স্থানীয় পত্রিকায় রাজ্যের আর্থিক করুন দশার ব্যাপারে যে সংবাদ প্রচারিত হয়েছে শিক্ষামন্ত্রী সাংবাদিক সন্মেলনে সেক্ষেত্রে একাধিক বিষয়ই এড়িয়ে গেছেন বা বলতে ভুলে গেছেন বা বলতে চান নি। যেমন-
১) প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ত্রিপুরা সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে ৬১৭৮.২০ কোটি টাকা কম পেয়েছেন। শিক্ষামন্ত্রী এব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলেন নি। সাংবাদিকদের প্রশ্নের পরও এটা বলতে পারেন নি ২০১৭-১৮, ২০১৮-১৯ এবং ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ত্রিপুরা সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে কত হাজার কোটি টাকা পেয়েছেন বা কত পাওয়ার কথা ছিল।
২)প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ত্রিপুরা সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে ৫৪টি বিভিন্ন স্কিম বা খাতে কোন অর্থই পায়নি। এক্ষেত্রে অবশ্য শিক্ষামন্ত্রী সংবাদের সত্যতা কিছুটা স্বীকার করেছেন যে না ৫৪টি নয় ২৪ টি স্কিমে ত্রিপুরা সরকার ২০১৯-২০ অর্থ বছরে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে কোন টাকা পায়নি। অবশ্য এর জন্যে তিনি দায় চাপানোর চেষ্টা করেন পূর্বতন বাম সরকারের উপর। পূর্বতন সরকার নাকি এসব স্কিমের এল ও সি দিয়ে যাননি। এক্ষণে নয়া সরকার এল ও সি সংগ্রহের চেষ্টা করছেন। এক্ষেত্রে শিক্ষামন্ত্রী হয়তো এটা ভুলে গেছেন বিজেপি-আই পি এফতি-র-র স্রকারতি এক্ষণে আর নয়া নয়। তার নয়া সরকারের বয়স দুই বছর হতে চলেছে। দুই বছরেও আপনারা ২৪টি স্কিমের এল ও সি দিল্লীতে পাঠাতে পারলেননা?
৩) প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল পূর্বতন বাম সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে টাকা পেলেও বলতো কেন্দ্র পর্যাপ্ত অর্থ দিচ্ছেনা। আরও চাই দাবী করে বছর জুড়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে মিছিল জারী রাখতো। কিন্তু নয়া সরকার পর্যাপ্ত অর্থ না পাওয়া সত্বেও বলে চলেছেন- কেন্দ্র প্রচুর টাকা দিচ্ছেন। ডাবল ইঞ্জিনের সরকার থাকার কারনে এটা সম্ভব হচ্ছে। সাংবাদিক সন্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী এ ব্যাপারে অবশ্য কোন মন্তব্য করেননি। এর প্রেক্ষিতে ইতিমধ্যে সাধারণ মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ায় কথা উঠেছে কেন্দ্র ও রাজ্যে একই দলের সরকার হওয়ায় রাজ্যের কি ক্ষতি হয়ে গেলো নাকি? কারন কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যের চাহিদা ও দাবি মতো টাকা না দিলেও রাজ্য মন্ত্রিসভার সদস্যরা দিল্লীতে গিয়ে খুব বেশি চাপ সৃষ্টি করতে পারছেন না। আবার দিল্লীতে একই দলের সরকার থাকায় রাজ্যে মিছিলও বের করতে পারছেন না।
৪) প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল রাজ্য অর্থ দপ্তরের ২৪শে জানুয়ারী ২০২০ সালের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী ত্রিপুরা সরকার ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ‘শেয়ার অব সেন্ট্রাল টেক্সেস’- খাতে ৬৬৫৬ কোটি টাকা পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে মাত্র ৩৪২৭.২৪ কোটি টাকা। একই রকমভাবে ‘গ্যাপ গ্রেন্ট’ খাতে পাওয়ার কথা ছিল ৮৭৫ কোটি। কিন্তু পাওয়া গেছে ৭২৯.১০ কোটি। এফ সি এওয়ার্ড (Local Bodies Grant) হিসাবে পাওয়ার কথা ছিল ১৬৯ কোটি টাকা। কিন্তু পাওয়া গেছে মাত্র ১৫৪.০৬ কোটি টাকা। লোক্যাল বডি গ্র্যান্ট (আরবান) খাতে পাওয়ার কথা ৬৮.২৬ কোটি টাকা। কিন্তু পাওয়া গেছে ৬৩.৪৪ কোটি টাকা। লোক্যাল বডি গ্র্যান্ট রুরাল খাতে পাওয়ার কথা ১০১.৭১ কোটি টাকা। কিন্তু পাওয়া গেছে মাত্র ৯০.৬২ কোটি টাকা। জিএসটি কম্পেন্সেশান স্কিমে পাওয়ার কথা ছিল ১৮২.৪০ কোটি কিন্তু পাওয়া গেছে ১৭১ কোটি। একই রকমভাবে এমজিএন রেগা প্রকল্পে পাওয়ার কথা ছিল ১০০০ কোটি, পাওয়া গেছে মাত্র ১১৫.১৯ কোটি টাকা। শুধু তাই নয়, স্কুল কলেজে ছাত্রছাত্রীদের হোস্টেল ভাতা, বিভিন্ন স্কলারশিপ/স্টাইপেন্ড খাতেরও বরাদ্দকৃত কেন্দ্রীয় শেয়ারের টাকা ২০১৯-২০ অর্থবছরে পুরোটা এখনও পাওয়া যায়নি।
এক্ষেত্রে শিক্ষামন্ত্রী রেগার অর্থ প্রাপ্তির ব্যপারে বলেছেন যে, ১০০০ কোটির মধ্যে ৬৭৬ কোটি ৯১ লক্ষ টাকা (১১৫ কোটি নয়) পাওয়ার কথা জানিয়েছেন। উপরে উল্লিখিত অন্যান্য স্কিম বা খাতে প্রকাশিত সংবাদে সংখ্যা তথ্য নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী দ্বিমত পোষণ করেন নি। সরকারি প্রেস রিলিজেও দ্বিমত পোষণ ক্রা হয়নি।
৫) প্রকাশিত সংবাদে আরও বলা হয়েছিল শুধু ফিনান্স কমিশন-এর গ্র্যান্ট বা শেয়ার অব সেন্ট্রাল টেক্সেস, এমজিএন রেগা প্রকল্পে বা স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের হোস্টেল ভাতা, বিভিন্ন স্কলারশিপ/স্টাইপেন্ড খাতেই ত্রিপুরা সরকার এবছর দিল্লী থেকে কম টাঁকা পেয়েছে এমনটা নয়, কম করেও ৩৯টি অন্যান্য খাতেও ত্রিপুরা সরকার ২০১৯-২০ অর্থ বছরে প্রতিশ্রুতিবদ্দ কেন্দ্রীয় বরাদ্দের অর্থ অস্বাভাবিক ভাবে কম পেয়েছে। এবং ৫৪টি বিভিন্ন স্কিমে ২০১৯-২০ অর্থ বছরে রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে কোন অর্থই পায়নি।
প্রকাশিত সংবাদের এই অংশটির ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন ৫৪ টি নয়, ২৪ টি স্কিমে এবছর সরকার কোন টাকা কেন্দ্রের কাছ থেকে পায়নি।
৬) প্রকাশিত সংবাদে আরও বলা হয়েছিল, অর্থ বছরের আর মাত্র দুই মাস সময় বাকি। এই অবস্থায় বিভিন্ন খাতে বরাদ্দকৃত কেন্দ্রীয় খাতের অর্থ কম আসায় রাজ্য সরকারের প্রতিটি দপ্তরের উন্নয়নমূলক কাজকর্ম প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ইতিপূর্বে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তর গুলির কাছে পুরানো যেসব স্কিমের অর্থ নানা কারনে অব্যয়িত ছিল সেই অর্থ রাশিও বহু দপ্তর অন্য খাতে খরচ করে ফেলছেন। যেসব কর্পোরেশনের কাছে জমাকৃত অতিরিক্ত ফান্ড রয়েছে, রাজ্য সরকারের অর্থ দপ্তর সাড়ে সাত শতাংশ সুদের প্রলোভন দিয়ে সেই অর্থ চেয়ে সার্কুলার পাঠিয়েছে বিভিন্ন কর্পোরেশন বা নিগম সমূহের কাছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে, আগামী মাসের পর থেকে রাজ্য সরকারের কর্মচারীরা সবাই বেতন পাবেন কিনা বা দিতে পারবেন কিনা এনিয়ে দপ্তর প্রধানরা চিন্তায় পড়ে গেছেন। প্রতিটি সরকারী দপ্তরের দেনা বেড়ে গেছে। ঠিকাদার, কন্ট্রাক্টার সাপ্লায়ারদের বকেয়া অর্থ পেমেন্ট করা যাচ্ছেনা। বহু পুরানো বকেয়ার অর্থরাশিতো বটেই বিজেপি আইপিএফটি জোট জামানায় বরাত প্রদান করা হয়েছে এমন ঠিকাদারি কাজের বিলও মেটানো যাচ্ছেনা।
শিক্ষামন্ত্রী তার সাংবাদিক সন্মেলনে প্রকাশিত সংবাদের উপরে উল্লিখিত বিষয়েও কোন বাক্য ব্যয় করেন নি।
৭) প্রকাশিত সংবাদে আরও উল্লেখ করা হয়েছিল যে, গত বিধানসভা এবং ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে যেসব ঠিকাদারি সংস্থা এবং সাপ্লায়াররা ভোটের সময় গাড়ী ভাড়া বা বিভিন্ন জিনিসপত্র সরবরাহ করেছিলেন এমন বহু ঠিকাদার, সাপ্লায়ার তাদের বকেয়া অর্থ রাশি এখনো পাননি। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে রাজ্যে নির্বাচন সংক্রান্ত খরচ হিসাবে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে ৮২ কোটি টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু পাওয়া গেছে মাত্র ২০.৫ কোটি টাকা। একই রকমভাবে নিরাপত্তা খাতে ১৭ কোটি টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু এক টাকাও পাওয়া যায়নি। এমনকি রিয়াং শরনার্থীদের দেখভালের খরচ হিসাবে ৩৫ কোটির মধ্যে পাওয়া গেছে মাত্র ১৪ কোটি টাকা।
শিক্ষামন্ত্রী তার সাংবাদিক সন্মেলনে এক্ষেত্রে গত নির্বাচনী ব্যয় ও রিয়াং শরনার্থীদের দেখভালের খরচ দুটি রিএমবার্সেবল স্কিমে টাকা পেয়ে যাবেন বলে দাবী করেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন টাকা পেয়েছেন কিনা কিংবা পেয়ে থাকলে কত টাকা পেয়েছেন এ ব্যাপারে কোন তথ্য দিতে না পারলেও সংবাদে প্রকাশিত তথ্যটি ভুল বলে দাবী করেছেন।
৮) প্রকাশিত সংবাদে আরও উল্লেখ করা হয়েছিল, তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের কারনে গত বেশ ক’মাস ধরে বিভিন্ন সামাজিক ভাতা প্রদান থেকে শুরু করে, হাসপাতালে বিনামূল্যে ঔষধ সরবরাহ, কৃষকদেরকে বিনামূল্যে সার, কীটনাশক, বীজ সরবরাহ, বিনামূল্যে কৃষি, সেচ ও কৃষকদের আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ, গ্রাম ও শহরে ইন্দিরা আবাস যোজনায় গৃহ নির্মাণে সাহায্য, প্রধানমন্ত্রী সড়ক যোজনায় রাস্তা নির্মাণ, নিবির শিশু উন্নয়ন (আইসিডিএস) পরিষেবার কাজকর্ম এক রকম বন্ধ হয়ে পড়েছে। বন্ধ হয়ে পড়েছে স্কিল ডেভেলপমেন্ট স্কিমে বেকারদের কর্মমুখী করে তুলতে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দানের কাজ থেকে শুরু করে গ্রামীন জীবিকা মিশনের কাজকর্ম। নতুন করে কোন উন্নয়ন কর্মসূচী হাতে নেওয়া দূরের কথা পুরানো ও চালু বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ড গুলিই চালু রাখা যাচ্ছেনা। রাজ্য অর্থ দপ্তরের সদ্য প্রাক্তন একাদিক আমলা এবং রাজ্যের একাদিক অর্থনীতির বিশেষজ্ঞর সাথে কথা বলেছি। কিন্তু তারা কেউই এটা হলপ করে বলতে পারছেন না যে খুব সহসায় রাজ্যের এই বেহাল অর্থনৈতিক দুর্দশা ঘুচবে। কেননা, দেশের আর্থিক হালও তলানিতে। দেশে কর্পোরেট ও ব্যক্তিগত কর আদায় এবছড় আশানুরূপ হয়নি। দু’দশকে এই প্রথমবার প্রত্যক্ষ কর আদায়ে ঘাটতি ঘটেছে দেশে। দেশে ১৩.৫ ট্রিলিয়ন প্রত্যক্ষ কর আদায়ের টার্গেট করেছিল মোদী সরকার। যা ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষের থেকে ১৭ শতাংশ বেশি। কিন্তু ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারের ঘরে যে কর আদায় হয়েছে তা গত অর্থবর্ষে জানুয়ারিতে জমা হওয়া করের তুলনায় ৫.৫ শতাংশের থেকেও কম। এই প্রথম প্রত্যক্ষ কর সংগ্রহে এত ঘাটতি হচ্ছে এবছর। দেশের অর্থনীতির এই বেহাল দশা নিয়ে দেশ জুড়ে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে সরব বিরোধীরাও। আর তার প্রভাবেই ত্রিপুরার এই বেহাল অর্থনৈতিক অবস্থা বলে মনে করেন রাজ্য অর্থ দপ্তরের সদ্য প্রাক্তন একাদিক আমলা এবং রাজ্যের একাদিক অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা। কেননা, ত্রিপুরা সরকারের বাজেট বরাদ্দের প্রায় ৯০ শতাংশ অর্থই কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে আসে। তাই, কেন্দ্র কাঙ্খিত অর্থ প্রদান না করলে ত্রিপুরার মত রাজ্যের সমস্যা হতে বাধ্য। তাই ত্রিপুরার নয়া মুখ্যমন্ত্রী ত্রিপুরার মানুষকে নিজের পায়ে দাড়া করানোর কথা বলছেন। কাজটা দুরুহ হলেও উদ্যোগটাকে সাধুবাদ দেওয়া যেতেই পারে। কিন্তু তার বাস্তবে রুপ দিতে গিয়ে গত ২২ মাসেই ত্রিপুরার অর্থনীতির যে বেহাল অবস্থাটা হয়েছে, তাই তারাহুরু করে আম জনতার উপর একের পর এক অর্থনৈতিক এবং করের চাপ না বাড়িয়ে, এই বেহাল অবস্থা থেকে ত্রিপুরাকে বের করে আনতে আগে বাস্তবমুখী সুদৃঢ়, সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ জরুরী এটা বলাই বাহুল্য।
সংবাদে প্রকাশিত উপরে উল্লিখিত বিষয়ে সাংবাদিক সন্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী কোন মন্তব্য করেন নি। এখানে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য যে, যে পত্রিকা ও ওয়েবসাইট-এ প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ৬ ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যায় সাংবাদিক সন্মেলন করেন সেখানে সেই দুই সংবাদপত্র সংগঠনের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রন জানানো হয়নি। তাই প্রকাশিত সংবাদ সম্পর্কে রাজ্য সরকারের পক্ষে শিক্ষামন্ত্রী যা বলেছেন সে ব্যাপারে পাল্টা কোন প্রশ্ন করা যায়নি। শিক্ষামন্ত্রী সাংবাদিক সন্মেলনে বলেছেন সংবাদ প্রকাশ করার আগে রাজ্য অর্থ দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রকৃত তথ্য জেনে সংবাদ প্রকাশ করা উচিত ছিল। এ ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য হল শিক্ষামন্ত্রী ৬ ফেব্রুয়ারি অর্থ দপ্তরের যে তথ্য বা ডকুমেন্ট মূলে ত্রিপুরাইনফো ডটকম বা ত্রিপুরা দর্পণ পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অসত্য বলে দাবী করেছেন, আমরাও অর্থ দপ্তরের সেই তথ্য বা ডকুমেন্ট মূলেই সংবাদ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছি। তাই আজও আমরা দৃঢ়তার সাথে দাবী করছি প্রকাশিত সংবাদে বর্ণিত প্রতিটি তথ্য ১০০ শতাংশ সত্য। অর্থ দপ্তরের তৈরি রাজ্যের আর্থিক অবস্থার তথ্যাবলী গুলি অসত্য না হয়ে থাকলে প্রকাশিত সংবাদটিও অসত্য নয়। (ত্রিপুরাইনফো ডটকম)