Hare to Whatsapp
নজীরবিহীন অর্থ সঙ্কটে রাজ্য, ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ৫৪ কেন্দ্রীয় প্রকল্পে এক টাকাও পায়নি ত্রিপুরা সরকার
By Our Correspondent
আগরতলা, ফেব্রুয়ারি ৩, : ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ত্রিপুরা সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে ৬১৭৮.২০ কোটি টাকা কম পেয়েছে। বিভিন্ন প্রজেক্ট, স্কিম ও কেন্দ্রীয় শেয়ারের মাধ্যমে ত্রিপুরা সরকার ১২৭৬৩.৩০ কোটি টাকা পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কাঙ্খিত অর্থ না পাওয়ার তীব্র অর্থ সংকটে পড়ে গেছে ডাবল ইঞ্জিনের ত্রিপুরা সরকার। অথচ ২০১৯-২০ অর্থ বছর শেষ হতে আর মাত্র ২ মাস বাকি। এই অবস্থায় দিল্লীতে স্বদলীয় সরকার ক্ষমতাসীন থাকার পরও রাজ্যের এই বেহাল অর্থনৈতিক অবস্থার কথা বিজেপি- নেতারা বা বিজেপি -আইপিএফটি জোট সরকারের মন্ত্রীরা প্রকাশ্যে তা বলতেও পারছেনা। এমনিতেই পূর্বতন বাম সরকার প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা দেনা রেখে যায়, যা সুদে আসলে বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা।
রাজ্য অর্থ দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী প্রায় দুই শতাধিক বিভিন্ন স্কিম ও খাতে ২০১৯-২০ অর্থ বছরে রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে ১২৭৬৩.৩০ কোটি টাকা পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অর্থ দপ্তরের সর্বশেষ যে হিসাব তা থেকে দেখা গেছে কম করেও ৫৪টি বিভিন্ন স্কিমে ২০১৯-২০ অর্থ বছরে রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে কোন অর্থই পায়নি। আর ৩৯ টি খাতে ত্রিপুরা সরকার ২০১৯-২০ অর্থ বছরে কেন্দ্রীয় খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের অস্বাভাবিক ভাবে কম অর্থ পেয়েছে। অবশ্য একাদিক খাতে কেন্দ্র সরকারের মন্ত্রীরা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর বিশেষ অনুরোধে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ ফাণ্ড প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু অর্থ মঞ্জুরি খুব কম ক্ষেত্রেই হয়েছে।
সুদীর্ঘ ৩৫ বছরের বাম আমলে তৎকালীন সরকার গুলির একটিই শ্লোগান ছিল কেন্দ্রীয় সরকার কাঙ্ক্ষিত হারে রাজ্যকে অর্থ দিচ্ছেনা। তাই কেন্দ্র বিরোধী মিছিল মিটিং রাজ্য জুড়ে লেগেই থাকতো। কিন্তু গত ২২ মাসের বিজেপি আইপিএফটি জোট জমানায় দেখা যাচ্ছে বিপরীত চিত্র। কেন্দ্র কাঙ্ক্ষিত হারে প্রাপ্য অর্থ দিচ্ছে না। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব স্বয়ং বলে বেড়াচ্ছেন কেন্দ্র রাজ্যকে অঢেল অর্থ দিচ্ছেন। তিনি প্রতিবারই দিল্লী থেকে ফিরে এসে শত শত কোটি টাকার বিশেষ প্রাপ্তির কথা রাজ্যবাসীকে শুনিয়ে যাচ্ছেন। পক্ষান্তরে রাজ্য অর্থ দপ্তরের হিসাব অন্য কথা বলছে।
রাজ্য অর্থ দপ্তরের ২৪শে জানুয়ারী ২০২০ সালের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী ত্রিপুরা সরকার ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ‘শেয়ার অব সেন্ট্রাল টেক্সেস’- খাতে ৬৬৫৬ কোটি টাকা পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে মাত্র ৩৪২৭.২৪ কোটি টাকা। একই রকমভাবে ‘গ্যাপ গ্রেন্ট’ খাতে পাওয়ার কথা ছিল ৮৭৫ কোটি। কিন্তু পাওয়া গেছে ৭২৯.১০ কোটি। এফ সি এওয়ার্ড (Local Bodies Grant) হিসাবে পাওয়ার কথা ছিল ১৬৯ কোটি টাকা। কিন্তু পাওয়া গেছে মাত্র ১৫৪.০৬ কোটি টাকা। লোক্যাল বডি গ্র্যান্ট (আরবান) খাতে পাওয়ার কথা ৬৮.২৬ কোটি টাকা। কিন্তু পাওয়া গেছে ৬৩.৪৪ কোটি টাকা। লোক্যাল বডি গ্র্যান্ট রুরাল খাতে পাওয়ার কথা ১০১.৭১ কোটি টাকা। কিন্তু পাওয়া গেছে মাত্র ৯০.৬২ কোটি টাকা। জিএসটি কম্পেন্সেশান স্কিমে পাওয়ার কথা ছিল ১৮২.৪০ কোটি কিন্তু পাওয়া গেছে ১৭১ কোটি। একই রকমভাবে এমজিএন রেগা প্রকল্পে পাওয়ার কথা ছিল ১০০০ কোটি, পাওয়া গেছে মাত্র
১১৫.১৯ কোটি টাকা। শুধু তাই নয়, স্কুল কলেজে ছাত্রছাত্রীদের হোস্টেল ভাতা, বিভিন্ন স্কলারশিপ/স্টাইপেন্ড খাতেরও বরাদ্দকৃত কেন্দ্রীয় শেয়ারের টাকা ২০১৯-২০ অর্থবছরে পুরোটা এখনও পাওয়া যায়নি।
শুধু ফিনান্স কমিশন-এর গ্র্যান্ট বা শেয়ার অব সেন্ট্রাল টেক্সেস, এমজিএন রেগা প্রকল্পে বা স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের হোস্টেল ভাতা, বিভিন্ন স্কলারশিপ/স্টাইপেন্ড খাতেই ত্রিপুরা সরকার এবছর দিল্লী থেকে কম টাঁকা পেয়েছে এমনটা নয়, কম করেও ৩৯ টি খাতে ত্রিপুরা সরকার ২০১৯-২০ অর্থ বছরে প্রতিশ্রুতিবদ্দ কেন্দ্রীয় বরাদ্দের অর্থ অস্বাভাবিক ভাবে কম পেয়েছে। এবং ৫৪টি বিভিন্ন স্কিমে ২০১৯-২০ অর্থ বছরে রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে কোন অর্থই পায়নি।
অর্থ বছরের আর মাত্র দুই মাস সময় বাকি। এই অবস্থায় বিভিন্ন খাতে বরাদ্দকৃত কেন্দ্রীয় খাতের অর্থ কম আসায় রাজ্য সরকারের প্রতিটি দপ্তরের উন্নয়নমূলক কাজকর্ম প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ইতিপূর্বে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তর গুলির কাছে পুরানো যেসব স্কিমের অর্থ নানা কারনে অব্যয়িত ছিল সেই অর্থ রাশিও বহু দপ্তর অন্য খাতে খরচ করে ফেলছেন। যেসব কর্পোরেশনের কাছে জমাকৃত অতিরিক্ত ফান্ড রয়েছে, রাজ্য সরকারের অর্থ দপ্তর সাড়ে সাত শতাংশ সুদের প্রলোভন দিয়ে সেই অর্থ চেয়ে সার্কুলার পাঠিয়েছে বিভিন্ন কর্পোরেশন বা নিগম সমূহের কাছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে, আগামী মাসের পর থেকে রাজ্য সরকারের কর্মচারীরা সবাই বেতন পাবেন কিনা বা দিতে পারবেন কিনা এনিয়ে দপ্তর প্রধানরা চিন্তায় পড়ে গেছেন। প্রতিটি সরকারী দপ্তরের দেনা বেড়ে গেছে। ঠিকাদার, কন্ট্রাক্টার সাপ্লায়ারদের বকেয়া অর্থ পেমেন্ট করা যাচ্ছেনা। বহু পুরানো বকেয়ার অর্থরাশিতো বটেই বিজেপি আইপিএফটি জোট জামানায় বরাত প্রদান করা হয়েছে এমন ঠিকাদারি কাজের বিলও মেটানো যাচ্ছেনা।
গত বিধানসভা এবং ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে যেসব ঠিকাদারি সংস্থা এবং সাপ্লায়াররা ভোটের সময় গাড়ী ভাড়া বা বিভিন্ন জিনিসপত্র সরবরাহ করেছিলেন এমন বহু ঠিকাদার, সাপ্লায়ার তাদের বকেয়া অর্থ রাশি এখনো পাননি। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে রাজ্যে নির্বাচন সংক্রান্ত খরচ হিসাবে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে ৮২ কোটি টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু পাওয়া গেছে মাত্র ২০.৫ কোটি টাকা। একই রকমভাবে নিরাপত্তা খাতে ১৭ কোটি টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু এক টাকাও পাওয়া যায়নি। এমনকি রিয়াং শরনার্থীদের দেখভালের খরচ হিসাবে ৩৫ কোটির মধ্যে পাওয়া গেছে মাত্র ১৪ কোটি টাকা।
তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের কারনে গত বেশ ক’মাস ধরে বিভিন্ন সামাজিক ভাতা প্রদান থেকে শুরু করে, হাসপাতালে বিনামূল্যে ঔষধ সরবরাহ, কৃষকদেরকে বিনামূল্যে সার, কীটনাশক, বীজ সরবরাহ, বিনামূল্যে কৃষি, সেচ ও কৃষকদের আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ, গ্রাম ও শহরে ইন্দিরা আবাস যোজনায় গৃহ নির্মাণে সাহায্য, প্রধানমন্ত্রী সড়ক যোজনায় রাস্তা নির্মাণ, নিবির শিশু উন্নয়ন (আইসিডিএস) পরিষেবার কাজকর্ম এক রকম বন্ধ হয়ে পড়েছে। বন্ধ হয়ে পড়েছে স্কিল ডেভেলপমেন্ট স্কিমে বেকারদের কর্মমুখী করে তোলতে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দানের কাজ থেকে শুরু করে গ্রামীন জীবিকা মিশনের কাজকর্ম। নতুন করে কোন উন্নয়ন কর্মসূচী হাতে নেওয়া দূরের কথা পুরানো ও চালু বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ড গুলিই চালু রাখা যাচ্ছেনা। রাজ্য অর্থ দপ্তরের সদ্য প্রাক্তন একাদিক আমলা এবং রাজ্যের একাদিক অর্থনীতির বিশেষজ্ঞর সাথে কথা বলেছি। কিন্তু তারা কেউই এটা হলপ করে বলতে পারছেন না যে খুব সহসায় রাজ্যের এই বেহাল অর্থনৈতিক দুর্দশা ঘুচবে। কেননা, দেশের আর্থিক হালও তলানিতে। দেশে কর্পোরেট ও ব্যক্তিগত কর আদায় এবছড় আশানুরূপ হয়নি। দু’দশকে এই প্রথমবার প্রত্যক্ষ কর আদায়ে ঘাটতি ঘটেছে দেশে। দেশে ১৩.৫ ট্রিলিয়ন প্রত্যক্ষ কর আদায়ের টার্গেট করেছিল মোদী সরকার। যা ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষের থেকে ১৭ শতাংশ বেশি। কিন্তু ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারের ঘরে যে কর আদায় হয়েছে তা গত অর্থবর্ষে জানুয়ারিতে জমা হওয়া করের তুলনায় ৫.৫ শতাংশের থেকেও কম। এই প্রথম প্রত্যক্ষ কর সংগ্রহে এত ঘাটতি হচ্ছে এবছর। দেশের অর্থনীতির এই বেহাল দশা নিয়ে দেশ জুড়ে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে সরব বিরোধীরাও। আর তার প্রভাবেই ত্রিপুরার এই বেহাল অর্থনৈতিক অবস্থা বলে মনে করেন রাজ্য অর্থ দপ্তরের সদ্য প্রাক্তন একাদিক আমলা এবং রাজ্যের একাদিক অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা।
কেননা, ত্রিপুরা সরকারের বাজেট বরাদ্দের প্রায় ৯০ শতাংশ অর্থই কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে আসে। তাই, কেন্দ্র কাঙ্খিত অর্থ প্রদান না করলে ত্রিপুরার মত রাজ্যের সমস্যা হতে বাধ্য। তাই ত্রিপুরার নয়া মুখ্যমন্ত্রী ত্রিপুরার মানুষকে
নিজের পায়ে দাড়া করানোর কথা বলছেন। কাজটা দুরুহ হলেও উদ্যোগটাকে সাধুবাদ দেওয়া যেতেই পারে। কিন্তু তার বাস্তবে রুপ দিতে গিয়ে গত ২২ মাসেই ত্রিপুরার অর্থনীতির যে বেহাল অবস্থাটা হয়েছে, তাই তারাহুরু করে আম জনতার উপর একের পর এক অর্থনৈতিক এবং করের চাপ না বারিয়ে, এই বেহাল অবস্থা থেকে ত্রিপুরাকে বের করে আনতে আগে বাস্তবমুখী সুদৃঢ়, সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ জরুরী এটা বলাই বাহুল্য। (তথ্য সুত্র অর্থ দপ্তর, ত্রিপুরা সরকার, ত্রপুরাইনফো কনটেন্ট ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ)