সবকা সাথ-সবকা বিকাশের নীতি ত্রিপুরায় গভীরভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে : রাজ্যপাল
নিজস্ব প্রতিবেদন
আগরতলা, জানুয়ারি ১১, : আমার সরকার বিকাশের পথে এগিয়ে চলেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের সহায়তা ও রাজ্য নেতৃত্বের আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলে পরিকাঠামো, স্বাস্থ্য পরিষেবা, শিক্ষা, কৃষি ও জনজাতি কল্যাণ সহ সমস্ত ক্ষেত্রেই রাজ্যের অগ্রগতি হচ্ছে। ১০ জানুয়ারি ২০২৫ সালের ত্রিপুরা বিধানসভার প্রথম অধিবেশনের প্রথম দিনের ভাষণে রাজ্যপাল ইন্দ্রসেনা রেড্ডি নান্নু একথা বলেন। বিধানসভায় রাজ্যপাল বলেন, ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ নীতি হচ্ছে উন্নয়নের পথে সমাজের সকলস্তরের মানুষকে নিয়ে এগিয়ে চলার নীতি, যা ত্রিপুরায় গভীরভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে। অন্ত্যোদয় অর্থাৎ সমাজের অন্তিম ব্যক্তির উন্নয়ন সাধন হচ্ছে ত্রিপুরার উন্নয়নের রূপরেখার মূলমন্ত্র। রাজ্যপাল বলেন, রাজ্য সরকার সকল স্তরের মানুষের জন্য সমান সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন সমাজ গঠনে কাজ করে চলেছে যেখানে প্রতিটি ব্যক্তি রাজ্যের প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধিতে ভূমিকা নেবে এবং তার সুফলও ভোগ করবে।
বিধানসভায় রাজ্যপাল বলেন, শান্তি ও উন্নয়নের জন্য হাতে নেওয়া এক উল্লেখযোগ্য উদ্যোগের ফলে ভারত সরকার, ত্রিপুরা সরকার এবং তিপরা মথার মধ্যে গতবছরের ২ মার্চ এক ঐতিহাসিক ত্রিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির মাধ্যমে ত্রিপুরার জনজাতি গোষ্ঠীর মানুষদের সমস্যাগুলি সমাধানের চেষ্টা করা হবে। রাজ্যপাল বলেন, আমরা দেখেছি সন্ত্রাসবাদের সমাধানে গতবছরের ৫ সেপ্টেম্বর ভারত সরকার ও ত্রিপুরা সরকার ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট অব ত্রিপুরা (এনএলএফটি) এবং অল ত্রিপুরা টাইগার ফোর্স (এটিটিএফ)-এর সাথে একটি সমঝোতাপত্র স্বাক্ষর করেছে এবং উগ্রবাদী দল দুটিকে ভেঙ্গে দিয়ে মূল স্রোতে ফিরিয়ে এনেছে। এই চুক্তি অনুসারে ভারত সরকার ত্রিপুরা জনজাতি সম্প্রদায়ের উন্নয়নের জন্য ২৫০ কোটি টাকার একটি প্যাকেজ অনুমোদন করেছে। যারা সমাজের মূল স্রোতে ফিরে এসেছেন। রাজ্যপাল আশা প্রকাশ করেন মূল স্রোতে ফিরে এসে তারা উন্নত ত্রিপুরা ও ভারত গঠনে তাদের ভূমিকা রাখবেন।
বিধানসভায় রাজ্যপাল বলেন, কৃষি আমার সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকারের ক্ষেত্র। রাজ্যের জিএসডিপিতে কৃষিক্ষেত্রের অন্যতম ভূমিকা রয়েছে। রাজ্যে ধানের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য ২০২৪ সালের আমন ঋতুতে ৯২,৫৮৮ হেক্টর জমিকে মুখ্যমন্ত্রী ইন্টিগ্রেটেড ক্রপ ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামের (এমআইসিএমপি) আওতায় নিয়ে আসা হয়। এজন্য বাজেট বরাদ্দ করা হয় ১৫ কোটি টাকা। রাজ্যে ২০,১৬১ হেক্টর জমি জৈব চাষের আওতায় রয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে অতিরিক্ত ৬,৫০০ হেক্টর জমিকে জৈবচাষের আওতায় আনার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। রাজ্যপাল বলেন, গত আগস্ট মাসের বন্যার পর ১,৪৮,৩৭৯জন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষককে ১,০০০ টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ২,৭৭৭ হেক্টর কৃষিজমি থেকে পলিমাটি সরানোর জন্য ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। বন্যা পরবর্তী সহায়তা হিসেবে ৪৫,৩৪৯ জন কৃষককে ৯.৪৬ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে এবং ১৪.০৩ লক্ষ সংকর জাতীয় সব্জির চারা ৮,৩৫৪ জন কৃষকের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ফসল বীমা যোজনায় ১৩.৯৭ লক্ষ বীমাকৃত কৃষক উপকৃত হয়েছেন। এই যোজনায় তাদের ৩২.৯৩ কোটি টাকা প্রদান করা হয়েছে। ৩.৭২ লক্ষ কৃষককে কিষাণ ক্রেডিট কার্ড দেওয়া হয়েছে এবং ২০২৫.৩০ কোটি টাকা প্রদান করা হয়েছে। পিএম-কিষাণের মাধ্যমে ২.৭৬ লক্ষ কৃষককে ১৮তম কিস্তি পর্যন্ত ৭৯০.৫৩ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে।
বিধানসভায় রাজ্যপাল বলেন, ইউনিফায়েড ফার্মার্স সার্ভিস প্ল্যাটফর্মে রাজ্যে ৩.৪৩ লক্ষ কৃষক নিবন্ধিত হয়েছেন। তথ্য প্রযুক্তি সুবিধাযুক্ত ৫টি এগ্রিকালচার ডেভেলপমেন্ট সেন্টার গঠন করা হয়েছে। ১.৮৫ লক্ষ কৃষককে সয়েল হেলথ কার্ড দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, রাজ্যে ৫৮২ হেক্টর এলাকায় ফলচাষ, ১৭০ হেক্টর এলাকায় মশলা চাষ এবং ১,৭০০ হেক্টর এলাকা সংকর জাতীয় সব্জিচাষের আওতায় আনা হয়েছে। এতে ১১ হাজার কৃষক পরিবার উপকৃত হয়েছেন। তাছাড়াও জাতীয় ভোজ্য তেল মিশন-অয়েল পাম প্রকল্পের আওতায় ১,৮৭৮ হেক্টর জমিতে অয়েল পাম চাষের সূচনা হয়েছে। এতে ১,৮৬১জন কৃষক উপকৃত হয়েছেন। রাজ্যপাল বলেন, কৃষকদের আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে রাজ্য সরকার ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে কৃষকদের কাছ থেকে সহায়ক মূল্যে ধান ক্রয় করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এই কর্মসূচিতে গতবছর রাজ্যে ৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩২,০৭৮ মেট্রিক টন ধান কৃষকদের কাছ থেকে ক্রয় করা হয়েছে।
বিধানসভায় রাজ্যপাল বলেন, রাজ্য সরকার দুধের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃত্রিম প্রজনন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্থানীয় কম উৎপাদনশীল ডেয়ারি প্রাণীদের উন্নত করার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। ২০২৪ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত ৩১,৭৪৮টি গবাদি প্রাণীর কৃত্রিম প্রজনন করা হয়েছে এবং ৩৩,৬০৪টি প্রাণীর চিরাচরিত প্রথায় প্রজনন করা হয়েছে। এরফলে ৫,৪৩৮টি বাছুরের মধ্যে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে ৪,৩১২টি স্ত্রী বাছুর জন্ম নিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী প্রাণীসম্পদ বিকাশ যোজনায় ১২,৪২২ জন সুবিধাভোগী উপকৃত হয়েছেন। তাছাড়া ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৫ হাজার জন প্রাণীপালককে মুখ্যমন্ত্রী প্রাণীপালক সম্মাননিধি প্রকল্পের আওতায় আনা হয়েছে।
তাছাড়াও প্রাণীপালন ভিত্তিক ৩জন উদ্যোগীকে জাতীয় প্রাণীসম্পদ মিশনের অধীনে ২.১০ কোটি টাকা আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। বন্যার সময় ক্ষতিগ্রস্ত ১,২৪৩ জন প্রাণীপালক আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন। রাজ্যপাল বলেন, মৎস্য ক্ষেত্রের উন্নয়নে রাজ্য সরকার ত্রিপুরা ফিসারিজ ডেভেলপমেন্ট বোর্ড গঠন করেছে। মাছ ও মাছের পোনার উৎপাদন বৃদ্ধি করতে ৪,৯৪৩ জন সুবিধাভোগীকে এবং ২ ১১টি সমবায় / স্বসহায়ক দলকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মৎস্যচাষে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া ১১,৬১২ জন মৎস্যচাষিকে মৎস্যচাষে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মৎস্য বিকাশ যোজনায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১,৩৩৯ জন মৎস্যচাষির মধ্যে ১০৬টি জাল ও ৪৩৩টি আইস বক্স বিতরণ করা হয়েছে। মৎস্য সহায়ক যোজনায় ২,৪৯২ জন মৎস্যজীবীকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মৎস্য সম্পদ যোজনায় ৪০.৯৪ হেক্টর নতুন জলাশয় সৃষ্টি, ১৬টি মোটরসাইকেল, ৬৭টি থ্রি হুইলার এবং ১১৬টি আইসবক্স সহ বাইসাইকেল দেওয়া হয়েছে এবং ১,৬০৪ জন মৎস্যজীবীকে জীবিকা ও পুষ্টি সংক্রান্ত সহায়তা দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মৎস্যসম্পদ যোজনায় কৈলাসহর মহকুমার বি সি নগরে ইন্টিগ্রেটেড অ্যাকুয়া পার্ক নির্মাণের জন্য ৪২.৪০ কোটি টাকা মঞ্জুর করা হয়েছে। রাজ্যে মৎস্যচাষের উন্নয়নে বিশ্ব ব্যাঙ্কের সহায়তায় টিআরইএসপি প্রকল্পে ২২২৫ কোটি টাকা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মৎস্য কিষাণ সহসমৃদ্ধি যোজনায় এখন পর্যন্ত ৬০,২৮২ জন মৎস্যজীবীকে নথিভুক্ত করা হয়েছে।
বিধানসভায় রাজ্যপাল বলেন, রাজ্য সরকার মহিলাদের সাক্ষরতা ও মেয়েদের উচ্চশিক্ষায় উৎসাহিত করছে। এই লক্ষ্যে মুখ্যমন্ত্রী কন্যা আত্মনির্ভর যোজনা নামে একটি প্রকল্প চালু করা হয়েছে। এই প্রকল্পে কলেজগামী মেধাবী ছাত্রীদের বিনামূল্যে স্কুটি দেওয়া হচ্ছে। গন্ডাতুইসা সরকারি ডিগ্রি কলেজে ৫০ আসন বিশিষ্ট ছাত্রী আবাস নির্মাণ করা হচ্ছে। শিক্ষকের চাহিদা মেটাতে সরকার রাজ্যের বিভিন্ন ডিগ্রি কলেজে ২০১ জন সহকারি অধ্যাপক নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকার রাজ্যে একটি বেসরকারি মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনুমোদন দিয়েছে।
এই বেসরকারি মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম হবে মাতা ত্রিপুরাসুন্দরী ওপেন ইউনিভার্সিটি। তাছাড়া রাজ্যে উচ্চশিক্ষার উন্নয়নে ৩টি নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যেমন ধর্মনগরের আর্যভট্ট আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, আগরতলায় টেকনো ইন্ডিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাব্রুমের মনু বনকুলে ধৰ্ম্মদীপা আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় চালু করা হয়েছে। ভারত সরকার শিক্ষাক্ষেত্রের উন্নয়নে লেম্বুছড়ায় কেন্দ্রীয় সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসনিক ভবন নির্মাণের জন্য ১০০.৮৩ কোটি টাকা মঞ্জুর করেছে। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিজী ভার্চুয়ালি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্বোধন করেছেন। রাজ্যপাল বলেন, ২০২৪ সালের ২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী ইন্টার্নশিপ প্রকল্প চালু হয়েছে। এই প্রকল্পের লক্ষ্য হচ্ছে যুবাদের কর্মসংস্থানের দক্ষতা বৃদ্ধি করার জন্য বৃহৎ কোম্পানিগুলিতে ইন্টার্নশিপের সুযোগ করে দেওয়া।
তাছাড়াও পিএম-বিদ্যালক্ষ্মী প্রকল্প উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করবে। রাজ্যপাল বলেন, রাজ্য সরকার বোর্ড পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ২০০ জন ছাত্রছাত্রীকে উচ্চশিক্ষার সুবিধা দিতে সিএম-সাথ নামে একটি নতুন উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। ত্রিপুরা মধ্যশিক্ষা পর্ষদের অধীনে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় সফল মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের চিফ মিনিস্টার্স অ্যানুয়েল স্টেট অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়েছে। পুরস্কার হিসেবে এখন পর্যন্ত ৪৭৫ জন ছাত্রছাত্রী অ্যাপেল আই-প্যাড পেয়েছে। আমার সরকার বিদ্যাজ্যোতি স্কুলগুলির জন্য ৪৮০টি শিক্ষকের পদ সৃষ্টি করেছে। তাছাড়াও ২৪৫৬টি পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া শীঘ্রই করা হবে। আমার সরকার রাজ্যে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি প্রক্রিয়া সহজ করতে অনলাইন ভর্তির জন্য একটি ওয়েব পোর্টাল তৈরি করেছে। রাজ্যপাল বলেন, সরকার ২০২৪-২৫ সালে রাজ্যে আরও ২৭টি স্কুলকে প্রধানমন্ত্রী স্কুল ফর রাইজিং ইন্ডিয়ার (পিএম-শ্রী) আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যার ফলে রাজ্যে পিএম-শ্রী বিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮২টি। ক্লাসরুমে ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান নিশ্চিত করতে রাজ্যের ৮৫৪টি বিদ্যালয়ে স্মার্ট ক্লাসরুম প্রকল্প চালু করা হয়েছে এবং এই বছরে ৩২টি নতুন বিদ্যালয়কে স্মার্ট ক্লাসরুম প্রকল্পের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সিবিএসই আগরতলায় একটি সাব রিজিওনাল অফিস খুলতে সম্মত হয়েছে। রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রের পরিকাঠামো উন্নয়নে এই অফিস উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেবে।
আরও পড়ুন...