Hare to Whatsapp
সুপার সাইক্লোন আমফানে কলকাতার পর তছনছ বাংলাদেশ
By Our Correspondent
আগরতলা, মে ২১, : সমুদ্রে গর্জন, উঁচু উঁচু ঢেউ, জলোচ্ছ্বাস, প্রবল বৃষ্টি, ঝোড়ো হাওয়া—এমন রুদ্রমূর্তি নিয়ে স্থলভাগে তাণ্ডব চালিয়ে বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করেছে ১৯৯৯ সালের পর প্রথম সৃষ্ট সুপার সাইক্লোন আমফান। ভয়ংকর আমফান তছনছ করেছে গাছপালা, মানুষের ঘরবাড়ি। আমফান উপকূলে আছড়ে পড়ার আগেই গতকাল বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত উপকূলীয় নদ-নদীগুলোর জল ৩ থেকে ৬ ফুট বেড়ে যায়। এ কারণে পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুরসহ বিভিন্ন জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। রাত পর্যন্ত শতাধিক গ্রাম তলিয়ে হাজার হাজার পরিবার জলবন্দি হয়ে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। আমফান যখন উপকূলে আছড়ে পড়ে, তখন ৫-১০ ফুট পর্যন্ত জলোচ্ছ্বাস হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। পুরো অঞ্চল জুড়ে লাখ লাখ মানুষের বাড়ির বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে টেলিফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ।
আমফানের প্রভাবে বৃষ্টিপাত ও দমকা বাতাসের কারণে উপকূলীয় নদ-নদীগুলো উত্তাল হয়ে ওঠায় সাতক্ষীরা, খুলনা, বরগুনা, পটুয়াখালী, লক্ষ্মীপুরসহ বিভিন্ন জেলায় বেড়িবাঁধে ভাঙন দেখা দেয়। অনেক স্থানে ফাটল ধরেছে বাঁধে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোর অন্তত ২৪ লাখ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার পথে গতকাল দুপুরে বরগুনায় এক ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছেন। এ ছাড়া ঝোড়ো বাতাসে গাছ ভেঙে পড়ে ভোলার চরফ্যাশনে মারা গেছেন একজন। একইভাবে পটুয়াখালীর গলাচিপায় মারা গেছে এক শিশু। জেলার কলাপাড়ায় নৌকা ডুবে মারা গেছেন সিপিপির এক টিম লিডার। গাছের ডাল ভেঙে পড়ে সাতক্ষীরা সদরের কামালনগরে মারা গেছেন এক নারী। পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় ঘরের দেয়াল ধসে চাপা পড়ে মারা গেছেন একজন।
বিবিসি বাংলার খবরে বলা হয়, ঘূর্ণিঝড় আমফান ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। সেখানে অন্তত ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। আবহাওয়া অফিসের তথ্য ভারতের সমুদ্র উপকূল দিঘা, বকখালী, কাকদ্বীপ, তাজপুর ও সুন্দরবন অংশে তাণ্ডব চালিয়ে আমফানের অগ্রভাগের প্রভাব বাংলাদেশে পড়তে শুরু করে গতকাল বিকেল ৪টা থেকে। সুপার সাইক্লোনিক ঘূর্ণিঝড়টি দুর্বল হয়ে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় আম্ফান সাতক্ষীরা-খুলনা দিয়ে প্রবেশ করে ১৬০ থেকে ১৮০ কিলোমিটার বেগে। ঘূর্ণিঝড়টি সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ বাংলাদেশের সুন্দরবন এলাকা দিয়ে পরবর্তী তিন থেকে চার ঘণ্টায় বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করে। যশোর, মাগুরা, ঝিনাইদহ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামালপুুর ও গাইবান্ধা হয়ে আবার ভারতের পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করে রাত ১টার দিকে।
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড় আমফানের ব্যাস ছিল ৪০০ কিলোমিটার। এর প্রভাবে বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বৃষ্টি হতে পারে।
আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন ঘূর্ণিঝড়কেন্দ্রের ৭৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৬০ কিলোমিটার। যা দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়া আকারে ১৮০ কিলোমিটার পর্যন্ত বেড়েছে। তিনি বলেন, আম্ফানের প্রভাবে মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত বহাল আছে। এ ছাড়া উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখলী, বরিশাল, ভোলা, লক্ষ্মীপুর, চাদপুর এবং এসব জেলার দ্বীপ ও চড়গুলো ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত এর আওতায় রয়েছে। এর বাইরে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ৯ নম্বর সতর্কসংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
রবিবার লঘুচাপ থেকে তৈরি হয় সুস্পষ্ট লঘুচাপ। সেখান থেকে নিম্নচাপ, তারপর গভীর নিম্নচাপ থেকে সোমবার ঘূর্ণিঝড় আমফান সাগরে অবস্থান করে। এরপর মঙ্গলবার আমফান সুপার সাইক্লোনিক ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়।
ছয় মাস আগে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের মতো আবারও বুক চিতিয়ে উপকূলবাসীকে রক্ষা করেছে বিশ্ব ঐতিহ্যের স্থান সুন্দরবন। আম্ফান সুন্দরবন অতিক্রম করার সময় শক্তি অনেক ক্ষয় হয়ে গেছে। ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডরের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বরগুনার পাথরঘাটা। বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ২২৩ কিলোমিটার বেগে বাংলাদেশ অংশে ঢুকে ব্যাপক প্রাণহানি হয়েছিল সিডরের সময়।
পরিবেশবিদদের মতে, সিডর যদি দক্ষিণাঞ্চলের জেলা সাতক্ষীরা সুন্দরবন দিয়ে ঢুকত, তাহলে ক্ষয়ক্ষতি কম হতো। দুই বছর পর আইলার গতিপথ ছিল খুলনা-সাতক্ষীরা সুন্দরবন এলাকা। ঘণ্টায় ১১৩ কিলোমিটার বেগে আসা ওই ঘূর্ণিঝড়ে তুলনামূলক কম ক্ষতি হয়েছিল সুন্দরবনের কারণে। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানও বাংলাদেশ অংশে ঢুকেছে সাতক্ষীরা সুন্দরবন দিয়ে। আইলার চেয়ে বাতাসের গতিবেগ বেশি থাকায় আইলার চেয়ে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। যদিও ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের ক্ষতি সিডরের মতো হওয়ার আশঙ্কাটা ক্ষীণ।
ভারতের আবহাওয়া অফিসের তথ্য মতে, অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ভারত উপকূলে আঘাত হানে দুপুর আড়াইটায়। ঝড়ের গতি ছিল ১১০ কিলোমিটারের ওপরে। আইলা, বুলবুল, ফণী পশ্চিমবঙ্গের যতটা ক্ষতি করেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি করেছে আমফান। এমনটাই বলছে ভারতের আবহাওয়া অফিস।
গতকাল সন্ধ্যায় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় ভারতের বর্তমান পত্রিকার সাংবাদিক রাহুল দত্তের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমফান এর কাছে ২০০৯ সালের আইলা নস্যি।’ রাহুল যখন এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন তাঁর ঘরটি জলবন্দি। তিনি বলছিলেন, এমনটি এর আগে কোনো ঘূর্ণিঝড়ে হয়নি।
ভারতের আবহাওয়াবিদরা বলছেন, গত ৫০ বছরের মধ্যে এত বড় দুর্যোগ আর হয়নি যেটা আমফান করেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, ঘূর্ণিঝড় আমফানে কৃষিতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। আম, লিচু, কাঁঠাল এখনো গাছে। কৃষকের বোরো ধান মাঠে। বাদামও মাঠে। এ বছর ৪৭ লাখ ৫৪ হাজার ৭৩৪ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত প্রায় ৭১ শতাংশ ধান কাটা সম্পন্ন হয়েছে। উপকূলের ১৫টি জেলায় চলতি বোরো মৌসুমে পাঁচ লাখ ৮৯ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত কাটা হয়েছে পাঁচ লাখ ৬৫ হাজার হেক্টর।
পটুয়াখালীতে নদীর জলের উচ্চতা বেড়েছে ৩-৪ ফুট। এর ফলে জেলার পাঁচ উপজেলার প্রায় অর্ধশত গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বাউফল উপজেলার তেঁতুলিয়া নদীর চরাঞ্চল চন্দ্রদ্বীপ ইউনিয়নের পানিবন্দি অর্ধশত মানুষকে ট্রলারে করে আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়া হয়। উপজেলার পাকডাল, রঘুনাদি, চর আমরখালী, চর বাসুদেবপাশা, উত্তর মঠবাড়িয়া, পূর্ব মমিনপুর, চর ফেডারেশন এলাকার প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি। দশমিনা উপজেলার চর হাদি, চর বোরহান, বাঁশবাড়িয়া, পাতারচর, চর শাহজালাল, আমবাড়িয়া, চর ডনডনিয়া এলাকা প্লাবিত হয়ে প্রায় ১৬ হাজার মানুষ পানিবন্দি। গলাচিপা উপজেলার গ্রামর্দ্দন, গোলখালী এবং কালিশুরী গ্রাম প্লাবিত হয়ে প্রায় দুই হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
রাঙ্গাবালীর ইউএনও মো. মাসফাকুর রহমান জানান, মধ্য চালিতাবুনিয়া, বিবির হাওলা, চরলতা, গোলবুনিয়া, চর আণ্ডা, খালগোড়া, গোঙ্গীপাড়া, চর কাশেম প্লাবিত হয়েছে। এতে প্রায় ৭৪০টি বাড়িঘর তলিয়ে গেছে।
মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে থেমে থেমে হালকা ও মাঝারি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। মাঝে মাঝে বইছে দমকা হাওয়া। গতকাল সকালে স্বাভাবিকের চেয়ে জোয়ারের পানি ৩-৪ ফুট বৃদ্ধি পায়। এতে বেড়ি বাঁধের বাইরের নিম্নাঞ্চলগুলো তলিয়ে গেছে।
লালুয়া ইউনিয়নের ১৪টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে প্রায় আট হাজার মানুষ জলবন্দি হয়ে পড়েছে ।
গতকাল সকাল ৯টায় পায়রা, বিষখালী ও বলেশ্বরে জোয়ারের জলের উচ্চতা ছিল ২.৮৫ সেন্টিমিটার। যা বিপত্সীমার সমান সমান। এর এক ঘণ্টা পর এই নদীতে জলের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে ৩.১০ সেন্টিমিটার হয়। আমতলী ফেরিঘাট এলাকার বাসিন্দা জাহাঙ্গীর হোসেন মৃধা বলেন, ফেরিঘাটের গ্যাংওয়ে তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া বেড়ি বাঁধের বাইরে বসবাসরত এখানকার শতাধিক পরিবারের বসতঘর তলিয়ে গেছে। দুই উপজেলার বালিয়াতলী, পশুরবুনিয়া, লোচা, নয়াভেঙ্গুলী, ফেরিঘাট, লঞ্চঘাট, আমুয়ারচর, বৈঠাকাটা, আঙ্গুলকাটা, নাইয়াপাড়া, ফকিরহাট, জয়ালভাঙ্গা, গাবতলী, মৌপাড়া, তুলাতলী, বগী, পচাকোড়ালিয়া এলাকায় বেড়ি বাধের বাইরে বসবাসরত কয়েক হাজার পরিবারের বাড়ি-ঘর জোয়ারের জল উঠে তলিয়ে গেছে।
মেঘনার তীরবর্তী কমলনগর উপজেলার মতিরহাট, বাত্তিরখাল ও রামগতি উপজেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মঙ্গলবার মেঘনার জল স্বাভাবিকের চেয়ে এক ফুট বেড়েছিল। কিন্তু গতকাল সকাল থেকে মেঘনা উত্তাল হয়ে ওঠে, জলের উচ্চতা বেড়ে যায় প্রায় ৩ ফুট। দুপুর ১২টার দিকে প্রবল বাতাস ও ঢেউয়ের আঘাতে রামগতিঘাটে একটি মাছ ধরার নৌকা তছনছ হয়ে যায়।