Hare to Whatsapp
শুধু লকডাউন করে বসে থাকলে চলবেনা, কৃষি ও শিল্পকেও বাঁচাতে হবে
By Our Correspondent
আগরতলা, এপ্রিল ১৬, : করোনা মুক্তির পথ খুঁজতে গিয়ে আপাতত লকডাউন করে মানুষকে বাঁচানোর প্রাথমিক উদ্যোগটি নিঃসন্দেহে একটি শুভ উদ্যোগ, কিন্তু কোন মতেই সর্বোত্তম উদ্যোগ নয়। মানুষ বাঁচলে দেশ বাঁচবে- এই আপ্ত বাক্যটিকে কেন্দ্র বিন্দু করে যদি আমরা এগিয়ে যাই তাহলে এটাও নিঃসন্দেহে বলা যায় দেশ বাঁচলেই মানুষ বাঁচবে। অন্যথায় লকডাউন পরবর্তী পরিস্থিতিতে শুধু দেশটাই থাকবে। মানুষ থাকবেনা।
কেননা, কৃষি, শিল্প, কলকারখানা, পরিষেবা প্রদানকারী ছোট বড় কোম্পানী গুলিকে বাঁচানো না গেলে, দেশ ও জাতীর সামনে যে মহা বিপদ ঘনিয়ে আসবে তাকে সামলাতে না পারলে কিছুই বাঁচানো যাবেনা।
এক্ষেত্রে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদীর সরকার মানুষ বাঁচানোর পাশাপাশি দেশ বাঁচানোর জন্যে শিল্প, কলকারখানা, কৃষিকে বাঁচানোর জন্য লকডাউনের প্রথম দিন থেকেই যে সাধু উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন তা অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু কোন উদ্যোগ গ্রহণ করলেই চলে না। রাজ্য ও দেশীয় পর্যায়ে তার যতাযথ বাস্তবায়নও প্রয়োজন। যা দেশের অধিকাংশ রাজ্য গুলিতেই দেখা যাচ্ছে না। আর এর থেকে বাদ দেওয়া যাচ্ছে না আমাদের পার্বত্য ক্ষুদ্র রাজ্য ত্রিপুরাকেও।
গত ২৪ মার্চ প্রথম লকডাউনের দিন থেকেই যেভাবে পাহাড়ী একটি রাজ্যের জাত্-ধর্ম-বর্ন নির্বিশেষে মানুষ লকডাউনের সিদ্ধান্তকে মেনে ঘরে রয়েছেন (ক্ষুদ্র একটি অংশের কথা বাদ দিলে) তা শুধু প্রশংসার যোগ্যই নয়, তা অনুকরণ বা অনুসরণ যোগ্যও। বিশেষত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও পরবর্তী্ সময়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর আহ্বানে লকডাউনের প্রথম দিন থেকেই এরাজ্যের সর্বস্তরের মানুষ দলমত নির্বিশেষে যেভাবে একে অপরের পাশে দাঁড়িয়েছেন তা এক কথায় এরাজ্যের মানুষের উচ্চ গনতান্ত্রিক ও ধনাত্মক মুল্যবোধের পরিচায়ক। তাই এখনো এরাজ্যে লকডাউন পরিস্থিতিতে গ্রাম পাহাড়ে কেউ না খেতে পেয়ে মারা যায়নি। অভাবের তাড়নায় দুই একটি বিক্ষিপ্ত আত্মহত্যার ঘটনা ঘটলেও তা লকডাউনের আগেই ঘটেছে।
গোটা বিশ্বজুড়েই আজ একটি কথাই বেশী করে চর্চিত হচ্ছে তা হল- লকডাউন করেতো আপাতত কিছু মানুষকে বাঁচানো যাচ্ছে, কিন্তু এর পর কি হবে? লকডাউনের কারনে শুধু দোকানপাঠ, স্কুল-কলেজ, ব্যবসা বানিজ্য, শিল্প, কলকারখানা আজ বন্ধ নয়। বন্ধ হয়ে পড়েছে কৃষি সংশ্লিস্ট কাজকর্মও। আর এভাবে যদি ক্ষেত খামারে কাজকর্ম বন্ধ হয়ে পড়ে বা ছোটখাটু শিল্প উৎপাদন বন্ধ করে রাখা হয় তাহলে এটা সবাই বলছেন যে, করোনা আক্রমনে যত না লোক মারা পড়েছেন বা পড়বেন তার চেয়ে বেশী লোক মারা পড়বেন খাদ্যাভাব জনিত কারনে। এভাবে কৃষি কাজকর্ম বন্ধ রাখলে, খাদ্য সামগ্রীর উৎপাদন বন্ধ করে রাখা হলে, আগামী দিনে মানুষ খাবে কি? এই প্রশ্নটি ইতিমধ্যেই উঠে গেছে। অবশ্য ইতিমধ্যেই কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ে ছাড় দেওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে তাতে কতটা ফল মিলবে?
দেশ জুড়েই এক্ষণে লকডাউনের কারনে কৃষি কাজকর্ম বন্ধ। লক্ষ লক্ষ টন আনাজ ক্ষেতে নষ্ট হচ্ছে। আমাদের ছোট্ট রাজ্য ত্রিপুরাতে শোনা যাচ্ছে কৃষকরা ক্ষেতে খামারে যেতে পারছে না। নতুন করে শাকসবজি চাষ করবেন তো দূরের কথা ইতিমধ্যেই যেসব মরশুমি সবজি রোপন করেছিলেন সেই ফসলও ঘরে তুলতে পারছেন না। একদিকে লকডাউনের বিধিনিষেধ, অন্যদিকে মহামারী। কৃষি শ্রমিকদের ক্ষেতের ফসল আজ ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে।
একই রকম অবস্থা ছোট বড় শিল্প সংস্থা গুলিরও। প্রয়োজনীয় শ্রমিকের অভাবে উৎপাদন বন্ধ হয়ে পড়েছে। তাই ছাড়ের কথা জানানোর পরেও অনেক সংস্থা ভবিষ্যতে আরও কঠিন পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে শিল্প কারখানার দরজা খুলতেই ভয় পাচ্ছেন। এমনিতেই দেশের আর্থিক মন্দা পরিস্থিতির কারনে দেশজুড়ে বহু শিল্প কলকারখানার দরজা আগে থেকেই বন্ধ। তার মধ্যে করোনা- পরিস্থিতিতে কারখানার দরজা খোলা আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।
গত ১৪ই এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী শিল্প উদ্যোগীদের প্রতি অনুরোধ করেছেন কোথাও কোন শিল্প সংস্থার মালিক যেন এই মুহূর্তে কোন শ্রমিক কর্মচারীকে ছাঁটাই না করেন। এটা সত্য যে কোন শিল্প কলকারখানার মালিকই চাননা তার কারখানা বন্ধ হয়ে যাক। ভালো কাজ করলে কোন কারখানার মালিকই চাইবেন না তিনি তার কোন শ্রমিককে ছাঁটাই করে দেবেন। কিন্তু কঠিন ও বাস্তব অবস্থার বিচারে অনেক সময় অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। যার কারনে কলকারখানা বাঁচানোর স্বার্থে শ্রমিক ছাঁটাইও করতে হয়। কিন্তু বর্তমানে করোনা পরিস্থিতিতে কর্মী ছাঁটাই-র কারনটি অনেকটাই ভিন্ন। কল কারখানার উৎপাদন সরকার নিজেই নির্দেশিকা জারী করে বন্ধ করেছেন। তাই শিল্প কল কারখানা বাঁচানোর কিছুটা দায়ভার সরকারকেও নিতে হবে। কেননা, সরকারকেও এটা বুজত্রে হবে, যেই মালিক ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে কারখানা চালাচ্ছেন তিনি কিভাবে লোনের টাকা পরিশোধ করবেন?
তাই শিল্প কলকারখানার মালিকরা আশা করছেন দেশজুড়েই হয়তো মোদী সরকার কৃষি শিল্প ও কল কারখানা গুলিকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়তো কিছু বিশেষ সুবিধার কথা ঘোষণা করবেন। এলক্ষ্যে ত্রিপুরার মতো ক্ষুদ্র রাজ্যের ক্ষুদ্র শিল্প সংস্থা, কল কারখানার মালিকরা ইতিমধ্যেই যে দাবী তুলেছেন এখানে এর কিছু উল্লেখ করা হলো-
১) কৃষি ভিত্তিক বা যে কোন শিল্পই হোক বা পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা বা স্বনির্ভর উদ্যোগী, রাজ্য সরকারকে অন্তত আগামী ছয় মাসের জন্যে এসব সংস্থার বিদ্যুৎ বিল, ইন্টারনেট বিল, জলের বিল, পাইপ গ্যাসের মাসিক মূল্য ইত্যাদিতে এককালীন ছাড় দিতে হবে।
২) সম্ভব হলে সমস্ত এম এস এম ই সংস্থা গুলির শ্রমিক কর্মচারীদের ই পি এফ, ই এস আই সহ তাদের বেতনের অন্তত পঞ্চাশ শতাংশ অর্থ রাজ্য সরকারকে বহন করতে হবে।
৩) যারাই ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে কোন শিল্প সংস্থা গড়ে তুলেছেন তাদের ব্যাঙ্ক ঋণের সুদের টাকা পুরোপুরি মুকুব করতে হবে।
৪) বিনা সুদে বা স্বল্প সুদে আগামী দিনে এসব সংস্থা গুলিকে বিনা গ্যারান্টিতে দ্রুত ঋণদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
৫) কৃষি ক্ষেত্রকে বাঁচাতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এম জি এম রেগা শ্রমিকদের কৃষি ক্ষেতে কাজ করার অনুমোদন দেওয়া যেতে পারে।
৬) সার, বীজ বা যে কোন ধরনের প্ল্যান্টেশান ম্যাটেরিয়্যাল বিনামূল্যে সরবরাহ করতে হবে কৃষকদের। যারাই চাইবেন তাদেরকেই দেওয়া যেতে পারে।
৭) সরকারী বেসরকারী নার্সারীতে লাখ লাখ বিভিন্ন ধরনের ফুল ফলের চারা, বাঁশের চারা পরে থেকে নষ্ট হচ্ছে। কেউ চাইলে তাকে বিনা মূল্যে দেওয়া যেতে পারে।
৮) করোনা মহামারী মোকাবেলায় সরকার নির্দিস্ট পন্থা পদ্ধতি গুলি মেনে যাতে অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা গুলির মতো শিল্প কারখানা গুলিও চালু করা যায়, এলক্ষ্যে দ্রুত সরকারী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
৯) ত্রিপুরার ছোট বড় মাঝারী যত জন ঠিকাদার, শিল্প কারখানার মালিক বা বিভিন্ন ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানের কাছে রাজ্য সরকারের অর্থরাশি বকেয়া রয়েছে তা অতিসত্বর প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
১০) সর্বোপরি বহিঃরাজ্য থেকে আমদানী করতে হয় যেসব নিত্যপন্য সামগ্রী তার মজুত যাচাই করে দ্রুত আমদানীর ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে এলক্ষ্যে ব্যবসায়ীদের বিমানে বা মালবাহী রেলে এসব পন্য আমদানীতে বিশেষ ছাড় দেওয়া যেতে পারে। অন্যথায় আগামী দিনে নিত্য পণ্যের বাজারেও সঙ্কট দেখা দিতে পারে।
যতদূর জানা গেছে, ত্রিপুরা সরকারের সংশ্লিষ্ট টাস্কফোর্ম ইতিমধ্যেই এই সব বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা শুরু করেছেন। কিন্তু সিদ্ধান্ত যাই নেওয়া হোক তা দ্রুত নিতে হবে। অন্যথায় মহামারী উত্তর পরিস্থিতিতে খাদ্য শস্যের আকাল রোধ করা যাবে না। ফলত করোনা আক্রান্ত হয়ে যত না লোক মারা পড়বেন তার চেয়ে বেশী লোক খাদ্য সংকটে মরবেন। আর্থিক সমস্যায় অর্ধাহার অনাহারজনিত আত্মহত্যার মতো ঘটনাও বাড়বে। সংবাদপত্র, ক্যাবল টিভি, ওয়েবসাইট মিডিয়াও এরাজ্যের একটি কম বড় বেসরকারি শিল্প নয়। কম করেও পাঁচ সহস্রাধিক লোক এই শিল্পের সাথে যুক্ত। লকডাউনের কারনে এই শিল্পের উপরও কম বড় আঘাত নেমে আসেনি। এক দিকে সরকারি বেসরকারি স্তরে বিজ্ঞাপন হ্রাস, অন্য দিকে মুদ্রণ শিল্পের ক্ষেত্রে নিউজ প্রিন্টের মূল্যবৃদ্ধি ও আকাল। এই অবস্থায় প্রতিটি মিডিয়া ইউনিটই আজ ধুঁকছে। মাসের বেতন মাসে দেওয়া মুশকিল হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় মিডিয়াকে একটি শিল্প সংস্থা ধরে নিয়ে এক্ষেত্রেও বাড়তি কিছু ছাড় যেগুলি অন্যান্য শিল্প ইউনিট গুলিকে দেওয়া হবে সেগুলি মিডিয়া ইউনিটগুলিকেও দেওয়া যেতে পারে।