সাহিত্য নিয়ে একটি দিন
রিদ্ধিমান দাস
November 8, 2025
২২শে অক্টোবরের দিনটা আমার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় একটি দিন হয়ে থাকবে। সেদিন ভবনস্ ত্রিপুরা বিদ্যামন্দিরের প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এক অনন্য সাহিত্য কর্মশালা যেখানে শুধু নতুন জ্ঞানের আলোই নয়, বরং অনুভব করেছি লেখার প্রতি গভীর ভালোবাসার শক্তিটাকেও। কর্মশালার শুরুটা ছিল অত্যন্ত উষ্ণ এবং সম্মানজনক। বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে উপস্থিত সকল অতিথিকে ফুলের টব ও উত্তরীয় দিয়ে সংবর্ধনা জানানো হয়। এই ছোট্ট অথচ সুন্দর আয়োজনটা পুরো পরিবেশকে এক অন্যরকম মাধুর্যে ভরে দেয়।
প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আমাদের বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের লেখা সংকলন বই “চিন্তন”এর প্রকাশ। এই বইয়ের ভাবনা ও প্রেরণা এসেছিল বিদ্যালয়ের চেয়ারম্যান স্যারের পক্ষ থেকে, যাতে ভবনস্ ত্রিপুরার ছাত্রছাত্রীদের হিন্দি, ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় লেখা কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ একত্রে প্রকাশিত হয়েছে যা সত্যিই গর্বের বিষয়। অনুষ্ঠানের শুরুতেই চেয়ারম্যান স্যার এবং প্রিন্সিপাল ম্যাডাম তাঁদের বক্তব্যের মাধ্যমে আমাদের গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। তাঁদের কথায় ফুটে উঠেছিল সাহিত্যচর্চার গুরুত্ব, চিন্তার স্বাধীনতা এবং নিজের ভাবনাকে সাহসের সঙ্গে প্রকাশ করার মানসিকতা। তাঁদের সেই কথাগুলো আমাদের মনে নতুন উদ্দীপনা জাগিয়ে তোলে, যেন আমরা বুঝতে পারি লেখালিখি শুধু প্রতিযোগিতা নয়, এটা নিজের সত্তাকে জানার এক যাত্রা।
যে মানুষটির অক্লান্ত পরিশ্রম ও নেতৃত্বে এই কর্মশালাটি সম্ভব হয়েছে, তিনি সৌম্যদীপ দেব স্যার। তাঁর উপস্থিতি, নির্দেশনা ও প্রেরণামূলক কথা আমাদের সত্যিই অনুপ্রাণিত করেছিল আরও বেশি লিখতে, আরও ভালোভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে। স্যারের কথায় আমরা বুঝেছিলাম সাহিত্য মানে শুধু শব্দ নয়, এটা অনুভবের শক্তি। তিনি আমাদের ভেতরের লেখককে জাগিয়ে তুলেছিলেন যেন আমরা ভবিষ্যতে আরও আত্মবিশ্বাস নিয়ে কলম ধরতে পারি।
এরপর শুরু হয় লেখালিখি বিষয়ক কার্যক্রম। আমাদের একটি বিশেষ অনুশীলন করানো হয়, যেখানে একই শব্দকে ভিন্ন ভিন্ন অনুভবে প্রকাশ করতে বলা হয়। প্রথমে মনে হয়েছিল সহজ, কিন্তু লিখতে বসে বুঝলাম একটিমাত্র শব্দের মধ্যেও কত রঙ, কত অনুভূতি লুকিয়ে থাকে! সেই দিন আমি সত্যিই বুঝেছিলাম, প্রতিটি লেখকের কলম আলাদা, কারণ তাদের দৃষ্টি আলাদা।
কর্মশালার দ্বিতীয় পর্বে অতিথিরা তাঁদের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেন। তাঁরা বলেছিলেন ধৈর্য, নিয়মিত চর্চা আর মননশীলতা ছাড়া লেখালিখি সম্ভব নয়। তাঁদের কথা শুনে মনে হচ্ছিল সাহিত্য মানে শুধু কলমের শক্তি নয়, এটি চিন্তার পরিসর বাড়ানোর এক অন্তহীন যাত্রা।
সবশেষে অনুষ্ঠিত হয় প্রশ্নোত্তর পর্ব। আমরা ছাত্রছাত্রীরা একে একে আমাদের প্রশ্ন রাখি কিভাবে লেখার মান উন্নত করা যায়, কিভাবে একটি গল্পে বাস্তব অনুভূতি আনা সম্ভব, বা কিভাবে পাঠকের মন ছোঁয়া যায়। অতিথিরা ধৈর্য ধরে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দেন, এবং তাঁদের প্রতিটি উত্তর আমাদের শেখার ঝুলিকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলে।
এই কর্মশালার আরেকটি বিশেষ মুহূর্ত ছিল ‘বেস্ট ভবনস্ রাইটার অ্যাওয়ার্ড ২০২৫’ প্রদান অনুষ্ঠান। বিদ্যালয়ের দশজন শ্রেষ্ঠ লেখককে সেই পুরস্কার দেওয়া হয়। আমি তাঁদের মধ্যে না থাকলেও, আমার মনে কোনো আফসোস ছিল না, কারণ আমি জানতাম আজকের এই অভিজ্ঞতাটাই আমার সবচেয়ে বড় পুরস্কার।
পুরো দিনজুড়ে চলা কর্মশালার শেষে জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে অনুষ্ঠানটির পরিসমাপ্তি ঘটে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল এটি কোনো সমাপ্তি নয়, বরং এক নতুন যাত্রার সূচনা। সেদিন আমি শুধু সাহিত্য নয়, নিজের ভেতরের কণ্ঠটাকেও চিনেছিলাম। শিখেছিলাম একই শব্দ, একই অনুভূতি, কিন্তু ভিন্ন কলমে কতটা নতুন রূপ নিতে পারে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখালিখি কোনো একদিনে শেখা যায় না, এটা এক আজীবনের যাত্রা, যেখানে প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি ভুল, প্রতিটি ভাবনা আমাদের আরও পরিণত করে তোলে।
আজও যখন কলম হাতে নেই, মনে পড়ে যায় সেই ২২শে অক্টোবরের দিনটা। ভবনস্ ত্রিপুরা বিদ্যামন্দিরের সাহিত্য কর্মশালাটা শুধু একটা অনুষ্ঠান ছিল না, আমার কাছে সেটা ছিল এক প্রেরণার অধ্যায়, যেখান থেকে আমি শিখেছি লিখতে নয়, অনুভব করতে। (নবম শ্রেণি, ভবনস্ ত্রিপুরা বিদ্যামন্দির)
আরও পড়ুন...