‘বন্দেমাতরম’ - ১৫০ বছর পূর্তি দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধের উন্মেষের এক অনন্য উদ্যোগ
প্রফেসর ডাঃ মানিক সাহা
November 7, 2025
কিছু কিছু সৃষ্টি সময়ের গন্ডিকে অতিক্রম করে কালজয়ী হয়ে উঠে। ব্যক্তি এবং সমাজ জীবনে এই সৃষ্টির গভীরতার শেঁকড় অনেক দূর বিস্তৃত হয়ে পড়ে। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কালজয়ী সৃষ্টি ‘বন্দেমাতরম' আজও সময় ও কালের বিস্তৃতিকে ছাড়িয়ে আমাদের জাতীয় জীবনে প্রতিটি ধারায় বহমান। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তৎকালীন পরাধীন ভারতে জনমানসে যে জনরোষ ধূমায়িত হচ্ছিল, ঠিক সেই সময়ে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে রচিত ‘বন্দেমাতরম’ সংগীত আগ্নেয়গিরির মতো প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠেছিল। ১৮৭৫ সালের ৭ নভেম্বর অমর সৃষ্টি ‘বন্দেমাতরম' দেশবাসীর হৃদয়ে দেশমাতৃকার বন্দনায় আত্ম উৎসর্গ করার অদম্য স্পৃহাকে জাগ্রত করেছিল। লক্ষ লক্ষ দেশবাসী ‘বন্দেমাতরম' ধ্বনি ও সংগীতকে হৃদয়ে, অনুভবে গ্রহণ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন “মুক্তির মন্দির সোপান তলে’। পরাধীন ভারতে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ জাগাতে যে সমস্ত গান, নাটক ও স্লোগান বলিষ্ঠ ভূমিকা নিয়েছিল তারমধ্যে ‘বন্দেমাতরম' অন্যতম।
দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে আজ থেকে ৭৮ বছর আগে। কিন্তু ‘বন্দেমাতরম’ আজও স্বাধীন আজও স্বাধীন দেশবাসীর হৃদয়ে দেশপ্রেম, রাষ্ট্রহিতে এবং জনজাগরণে অম্লান হয়ে আছে। ১৮৭৫ সালে রচিত ‘বন্দেমাতরম’ এর ১৫০ বছর উদযাপিত হচ্ছে। দেশের যশস্বী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিজী পরাধীন ভারতে ‘বন্দেমাতরম’-এর প্রভাব, গভীরতা ও ব্যাপ্তির গুরুত্বকে উপলব্ধি করে সারা দেশে ‘বন্দেমাতরম’- রচনার ১৫০ বর্ষ পূর্তির আহ্বান জানান। সময়ের ভাবনায় দেশবাসীর হৃদয়ে দেশপ্রেম এবং জাতীয়তাবোধকে সুদৃঢ় এবং প্রসারিত করতে এ- এক অসাধারণ অনন্য উদ্যোগ৷ গত ১ অক্টোবর, ২০২৫ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিজীর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা National Song 'বন্দেমাতরম' রচনার ১৫০ বছর উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণকরে। ১৫০ বছর আগে দেশমাতৃকার বন্দনায় রচিত বন্দনামন্ত্র ‘বন্দেমাতরম' নিছক একটি গান, কবিতা বা একটি ধুনিনয়, লক্ষ লক্ষ ভারতবাসীকে দিয়েছিল মুক্তির উন্মাদনা ও আত্মত্যাগের প্রেরণা। এই কালোত্তীর্ণ সৃষ্টির ইতিহাস আজ আমাদের জানা প্রয়োজন। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই দেশজুড়ে ১৫০বছর উদ্যাপনের আয়োজন করা হয়েছে। আমাদের রাজ্যেও এই উদ্যাপনের আয়োজন চূড়ান্ত। আমরা চাই, আমাদের আগামী প্রজন্ম দেশের মুক্তির আন্দোলনের ইতিহাস ও প্রেক্ষাপটকে সঠিকভাবে জানুক। উপলব্ধি করুক মনন ও চেতনায়।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট :
‘আনন্দমঠ’ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস, যেটি সেই সময় অর্থ্যাৎ পরাধীন ভারতবর্ষে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। এই উপন্যাসে ১৮৭৫ সালের ৭ নভেম্বর, রচিত হয় ‘বন্দেমাতরম’ গান। ১৮৯৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে এই গানটি গেয়ে শোনান। পরবর্তী সময়ে ‘বন্দেমাতরম'-এর প্রথম দুটি স্তবক জাতীয় কংগ্রেসের বৈঠকে নিয়মিত গাওয়া হতো। ধীরে ধীরে এই গানের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে এবং স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাছে মুক্তির মন্ত্র হিসাবে পরিণত হয়। ১৯০৫ সালে ব্রিট্রিশ শাসক বাংলাকে ভাগ করার ঘোষণা দেয়। এর প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠে আপামর ভারতবাসী। বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে তৎকালীন সময়ে ‘বন্দেমাতরম' গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ১৯০৭ সালে মাদাম ভিকাজি কামা বার্লিনের স্ট্যুটগার্টে ভারতের বাইরে প্রথমবার ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকা উত্তোলন করেন। পতাকাটিতে ‘বন্দেমাতরম' শব্দটি লেখা ছিল। আজাদ হিন্দ সরকারের ঘোষণা পত্রের সময়েও ‘বন্দেমাতরম’ গানটি গাওয়া হয়েছিল। ১৯৫০ সালের ২৪ জানুয়ারি স্বাধীন ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ গণ পরিষদে একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামে ‘বন্দেমাতরম’-এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে ‘বন্দেমাতরম'-ও জাতীয় সঙ্গীত জন-গণ-মন এর সমান মর্যাদা পাবে এবং সমানভাবে সম্মানিত হবে। ভারতীয় জনগণকে অনুপ্রাণিত করার ক্ষেত্রে এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব স্বীকৃত হয়েছিল। এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে এই প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার দায়িত্ব আমাদের। দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ দেশের মূল সম্পদ। যে গান, ধুনি বা স্লোগান আসমুদ্র হিমাচলকে উদ্বেলিত করেছিল, তার রচনার সার্ধ শতবর্ষ (১৫০ বছর) নিশ্চয়ই জাতি হিসাবে আমাদের গর্বের বিষয়।
উদ্যাপনের কর্মসূচি :
৭ নভেম্বর, ২০২৫ থেকে সারা দেশজুড়ে বর্ষব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ‘বন্দেমাতরম’ গান রচনার ১৫০ বছর পূর্তি উদ্যাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই উদ্যাপনকে স্মরণীয় করে তোলার জন্য পর্যায়ক্রমে সুনির্দিষ্ট বিভিন্ন পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ৭ নভেম্বর, ২০২৫ রাজ্য সদরে কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠানটি উদ্যাপিত হবে। তাছাড়া একই দিনে রাজ্যের সব কয়টি জেলা সদর, সব মহকুমা ও ব্লকের পাশাপাশি সব পুর ও শহুরে স্থানীয় সংস্থাগুলোতেও ‘বন্দেমাতরম' গান রচনার ১৫০বছর পূর্তি অনুষ্ঠানটি উদ্যাপিত হবে বর্ষব্যাপী বিবিধ কর্মসূচিতে উদযাপন করা হবে। যার মধ্যে রয়েছে স্কুল ও কলেজের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ‘বন্দেমাতরম’-এর তাৎপর্যকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠান। সম্মিলিত কণ্ঠে ‘বন্দেমাতরম' এর তাৎপর্য পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে স্কুলে স্কুলে ‘বন্দেমাতরম” এর জন্য বিশেষ সমাবেশ, প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, পোষ্টার তৈরী ইত্যাদি কার্যক্রমের আয়োজন করা হবে। রাজ্য পুলিশের ব্যান্ডের মাধ্যমে জনবহুল স্থানে ‘বন্দেমাতরম” এবং অন্যান্য দেশাত্মবোধক গানের অনুষ্ঠান পরিবেশিত হবে। স্কুল কলেজ বিশ্ব-বিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে ‘বন্দেমাতরম' এর উপর ভিত্তি করে কুইজের আয়োজন করা হবে। এছাড়া ‘বন্দেমাতরম'- এর উপর প্রদর্শনী, মশাল দৌড়ের আয়োজন, বৃক্ষরোপন অভিযান, যুব ম্যারাথন এবং স্কুল কলেজ, এন সি সি ইত্যাদি ব্যান্ড দ্বারা ক্যাম্পাসে 'বন্দেমাতরম' সংগীত অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এইসব আয়োজনকে সর্বাত্মক সফল করার দায়িত্ব ও কর্তব্য আমাদের সকলের। এই উদ্যাপন নিছক কোন অনুষ্ঠান নয়, আমাদের আগামী প্রজন্মের মধ্যে দেশপ্রেমবোধকে জাগ্রত করার এক নতুন অঙ্গীকার। আসুন, আমরা সকলে সমবেত হই। ‘হর ঘর তিরঙ্গা' উদ্যাপনের মতো আমাদের রাজ্যেও ‘বন্দেমাতরম' রচনার ১৫০ বছর উদ্যাপনে নিজেদেরকে নিয়োজিত করি।মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিজীর এই আহ্বানকে আসমুদ্র হিমাচলে নতুনভাবে উদ্বেলিত করে তুলি।
আরও পড়ুন...