লকডাউনে রানার ছুটেছে জরুরী ঔষুধের প্যাকেট নিয়ে হাতে
প্রদীপ চক্রবর্তী
সেই প্রাচীনকাল থেকেই বার্তা বিনিময় ব্যবস্হা ছিল। সেই রাজ-রাজাদের যুগে বার্তা বিনিময়ে তোর মাধ্যম ছিল কপোত-কপোতী, বাজপাখি, ময়না, কাকাতুয়া। আগে রাজারা প্রতি বেশী রাজ্যে ও বার্তা বিনিময় এমনকি যুদ্ধের খবরাখবর জানাতেন এভাবেই। এদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তোলা হত। এদের পায়ে বেঁধে দেয়া হত চিরকুট। এরা ঠিক পৌঁছে দিত সেইসব চিরকুট। শত্রুপক্ষ এদের ধরার জন্য কত না কসরত করত। সেগুলো এখন ইতিহাস। তবু হয়তো কোন কোন অঞ্চলে এখনো সেই প্রথা রয়ে গেছে।
এরপর এল ডাক ও তার ব্যবস্হা। সেই ব্যবস্হা এখনও আছে। তবে টেলিগ্রাফ ব্যবস্হা এখন নেই বলা চলে। টরে টক্কা সিস্টেমে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে টেলিগ্রাম পাঠানো হত। তবে এই ব্যবস্হার পত্তন হয় ডাক ও তার ব্যবস্হা চালুর পর। কোন এক সময় ডাকের ব্যাগ বহন করে নিয়ে যেতেন ডাক হরকরা, যাদের আর এক নাম ছিল রানার। এরা খবরের বোঝা নিয়ে দিনরাত ছুটতেন পাহাড়ের গা বেয়ে। সুকান্ত ভট্টাচার্য রানার কবিতায় তা ফুটিয়ে তুলেছেন দারুন ভাবে। প্রথিতযশা গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁর গানে রানার ফুটিয়ে তুলেছেন।এই গান আজও জনপ্রিয়তার শীর্ষে। রানার যে এখনো নেই তা নয়। বরং এরা আছেন এখনো নানা প্রান্তে, যেখানে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা তেমন ভাবে গড়ে উঠেনি। এই রানারদের পিঠে থাকত ডাকব্যাগ,এক হাতে লন্ঠন আর বর্শা। আমরা এসব দেখেছি ছোট বেলা থেকেই।
কিন্তু ক্রমশঃ এরা ইতিহাস হয়ে যাচ্ছে। এদের হাত ধরেই পোষ্ট অফিস হয়ে চিঠিপত্র বাড়ী বাড়ী পৌছে যেত। এখনও পোস্ট অফিস আছে,আছে ডাকপিয়ন। আগে তো ডাক পিয়নের আশায় সবাই পথ চেয়ে থাকত। চিঠি,চিঠি ডাকে ছুটে যেতে হত। টেলিগ্রাম ও ওরাই নিয়ে যেত। টেলিগ্রাম শুনলেই ভেতর আঁতকে উঠত। জরুরী প্রয়োজনেই টেলিগ্রাম পাঠানোর চল ছিল। দূর প্রদেশের বিয়োগান্তক খবর ও আসতো টেলিগ্রামে। আবার খুশীর খবর ও বয়ে আনতে টেলিগ্রাম ব্যবহার করা হত। মহকুমা শহরের পোষ্ট অফিসে আসতো তার বেয়ে এই টেলিগ্রাম। অপা্রেটর ছিলেন। এদের বাইরে প্রশিক্ষণ দেয়া হত। সংবাদ ও পাঠানো হত। ১৯৭৬ সালে ভয়াবহ বন্যায় খোয়াই সড়কপথে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আমাকে তখন প্রেস টেলিগ্রামের মাধ্যমে আগরতলায় খবর পাঠাতে হয়েছে। এক্ষেত্রে দিলীপদা খুব সাহায্য করেছেন।উনিই টেলিগ্রাম পাঠাতেন। খুব দক্ষ ছিলেন তিনি। বাড়ী উনার শ্যামলীবাজারে। এখনও আছেন তিনি। পুলিশের বেতার বার্তা ও এদের মাধ্যমেই আসত। এখন তো সে দিন নেই। এখন উন্নত প্রযুক্তির যুগ। মোবাইলের যুগ। এখন তো কথা বার্তা প্রায় বন্ধ। ম্যাসেঞ্জার,হোয়াটসঅ্যাপ এ কথাবার্তা, ছবি,ভিডিও ক্লিপ চালাচালি হয়। ভিডিও চ্যাটের মাধ্যমে দূরদেশে থাকা ছেলে,মেয়ের সাথে মা,বাবা কথা বলেন। বোনেরা ভিডিওকলের মাধ্যমে মস্কো থাকা বা সেনাবাহিনীতে কর্মরত ভাইকে তার মঙ্গল কামনা করে। এটাই বর্তমান যুগ।
ডাক বিভাগ এখনও গুরুত্বপূর্ণ। তবে তার ব্যবস্হা এখন নেই। এখন মেইলে সব কাজ সাড়া হয়ে থাকে।
ডাক বিভাগ সাধারনত চিঠি আর পার্সেল নিয়ে কাজ করে। এছাড়াও রয়েছে পোষ্টাল ব্যাঙ্ক, পেনশন, পোষ্টাল সেভিংস রয়েছে এদের। এদের সেভিংস খুব গুরুত্বপূর্ণ। এদের অনেক এজেন্ট রয়েছে। এরা কমিশনের ভিত্তিতে টাকা আদায় করে জমা দিয়ে থাকে। আগরতলা প্রধান ডাকঘরে গেলে এজেন্টদের ভীড়ে মাথা গরম হয়ে যায়। একেকজন মোটা অংকের টাকা জমা দিয়ে থাকেন। এদের ভীড়ে অন্যান্য পরিষেবা বিঘ্নিত হয়ে থাকে।
কিন্তু এই ডাক বিভাগ এখন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। করোনা ভাইরাস সংক্রমণ রোধে গোটা বিশ্ব এখন প্রায় স্তব্দ। মানবসভ্যতা অনেকটাই প্রায় বিপর্যস্ত। জীবনের জয়গান সংশয়ের মুখে। জয়গান কবে গাইবে এই সবুজ পৃথিবী তা আজ লাখো টাকার প্রশ্ন। প্রায় দেশ লকডাউনে বন্দী। যাতায়াত বন্ধ। রেলের গতি রুদ্ধ।উড়ান বন্ধ। সাধারণ মানুষ জরুরী চিকিৎসা পরিষেবা পাচ্ছেন না। জীবনদায়ী ঔষুধ নেই। কুরিয়ার সার্ভিস না থাকায় ঔষুধ আনাতে পারছেন না। এই অবস্থায় এগিয়ে এসেছে ডাক বিভাগ। এরা জীবনদায়ী ঔষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম পৌঁছে দিতে শুরু করেছে। এ যেন অন্ধকারে আশার আলো। এ নিয়েই আজকের প্রতিবেদন। বিষয়টি সবারই জানা। তবু না জানার গল্প শুনাবো আজ।
আমাদের দেশে প্রায় ৬ লাখ ডাকঘর রয়েছে। এদের সুবিস্তৃত নেটওয়ার্ক। এমন নেটওয়ার্ক অন্য কোন বিভাগ বা সরকারী সংস্থায় নেই।
লকডাউনের ফলে ঔষুধ না পাঠাতে পারায় ঔষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলি বিপাকে পড়ে যায়।এরা বিকল্পের সন্ধান করতে শুরু করতেই এগিয়ে আসে ডাক বিভাগ।এরা ঔষুধ পৌঁছে দিতে সন্মত হয়। যেহেতু এদের পার্সেল সার্ভিস রয়েছে এবং রয়েছে স্পীড পোস্ট সার্ভিস সেকারনে ওরা কাজ শুরু করে দিয়েছে। প্রস্তুতকারকরা এদের মাধ্যমেই শুরু করে গন্তব্যে পাঠানোর কাজ। হাফ ছেড়ে বাঁচলেন হৃদরোগ ও ক্যান্সার রোগীরা। শুধু তাই নয় বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলি এদের মাধ্যমে আনাতে শুরু করে চিকিৎসা সরঞ্জাম। বেঁচে গেল ঔষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলি এবং হাসপাতাল ও নার্সিং হোমগুলি। ক্রান্তিকালে ডাক বিভাগের এই ভূমিকা ইতিহাসের উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে থাকবে। মানুষ ও হৃদয়ের মনিকোঠায় স্হান দেবে ডাক বিভাগকে।
তথ্য ব্যবস্থাপনা: ব্রিটিশ ব্রডকাষ্টিং কর্পোরেশন (বিবিসি) ও ডাক বিভাগ।