শব্দ জঞ্জাল: অদৃশ্য দূষণে প্রশ্নের মুখে মানবস্বাস্থ্য
অভিষেক ভৌমিক
November 3, 2025
পরিবেশদূষণের তালিকায় জল, বায়ু, মাটি, প্লাস্টিক এসব পরিচিত শব্দের মাঝেই একটি দূষণ নীরবে বাড়ছে, যার অস্তিত্ব চোখে দেখা যায় না, কিন্তু মানুষের স্নায়ুতন্ত্র থেকে শুরু করে মানসিক স্থিতি পর্যন্ত নষ্ট করে দিচ্ছে। এই অদৃশ্য দূষণটি হলো শব্দদূষণ, যার প্রধান এক উৎস রাস্তার যানবাহনের অপ্রয়োজনীয় শব্দচাপ।
আধুনিক নগরজীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ব্যস্ততাপূর্ণ রাস্তাঘাট, যেখানে প্রতিনিয়ত চলাচল করে অসংখ্য গাড়ি, বাইক ও ভারী যান। প্রয়োজনে নয়, অভ্যাসে, বিরক্তিতে, অধৈর্যতায় বা প্রায়ই নিছক ‘অভ্যাসবশত’ শব্দচাপ তৈরি করা হয়। অথচ আমাদের শরীরের স্বাভাবিক সহ্যক্ষমতা রয়েছে নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) মানুষের জন্য দিনে ৫৫ ডেসিবেল এবং রাতে ৪০ ডেসিবেল শব্দমাত্রাকে নিরাপদ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু বাস্তবে শহুরে রাস্তাগুলিতে এই মাত্রা প্রায়শই ৮০–৯০ ডেসিবেল ছাড়িয়ে যায়, যা কেবল বিরক্তিকরই নয়, দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক ক্ষতির কারণও।
প্রথমত, অতিরিক্ত শব্দের প্রভাব সরাসরি আঘাত হানে হৃদপিণ্ডে। চিকিৎসাশাস্ত্রে প্রমাণিত, শব্দচাপ বাড়লে রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়, হরমোনের অসাম্য সৃষ্টি হয় এবং দীর্ঘমেয়াদে হৃদরোগের সম্ভাবনা নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়। দ্বিতীয়ত, শ্রবণশক্তি ক্ষয় হওয়া একটি ধীর কিন্তু নিশ্চিত প্রক্রিয়া, চোখে ধরা না পড়লেও কানে স্থায়ী ক্ষতির সূচনা ঘটে। তৃতীয়ত, অবিরাম শব্দ মানসিক চাপে রূপ নেয়, ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়, মনোযোগ নষ্ট করে এবং শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশেও বাধা সৃষ্টি করে। এমনকি গর্ভবতী নারীদের ওপরও এর প্রভাব বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত।
উন্নত দেশগুলিতে এই বিপদের গুরুত্ব বহু আগেই উপলব্ধি করা হয়েছে। ইউরোপের বহু শহরে নির্দিষ্ট এলাকাকে ‘নো-সাউন্ড জোন’ ঘোষণা করা আছে, যেখানে শব্দসীমা আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। জাপানে গাড়ির সিগন্যাল ব্যবহার হয় কেবল জরুরি পরিস্থিতিতে। জার্মানিতে স্কুল, হাসপাতাল ও আবাসিক অঞ্চলের কাছে শব্দসীমা লঙ্ঘন করলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। সেখানে পরিবেশবান্ধব ট্রাফিক সংস্কৃতি মানে কেবল দূষণমুক্ত বায়ু নয়, শব্দমুক্ত জীবন–ও।
অন্যদিকে ভারতের বহু মহানগরেই পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তথ্য অনুযায়ী, দেশের অধিকাংশ বড় শহরে নিরাপদ সীমার উপরে শব্দমাত্রা রোজই নথিভুক্ত হচ্ছে, যেমন: এক খবর মতে, Bengaluru-র BTM Layout এলাকায় ২০২৩ সালে দিনের সর্বোচ্চ শব্দমাত্রা ছিল ৯৩.৪ dB, ২০২৫ সালে তা বাড়ে ৯৫.৭ dB-এ। ত্রিপুরার, আগরতলাতেও একই প্রবণতা স্পষ্ট পরিকল্পিত উদ্যোগ না হলেও এটি ধীরে ধীরে এক নীরব মহামারিতে রূপ নেবে। আন্তর্জাতিকভাবে, প্রতি-দিন ৮ ঘন্টার জন্য যদি শব্দমাত্রা ৮৫ dB এর বেশি হয়, তবে স্থায়ী শ্রবণশক্তি ক্ষয়ের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্য।
এই সমস্যার সমাধান আইন, প্রযুক্তি ও সামাজিক অভ্যাস তিনটির সম্মিলিত প্রয়োগে সম্ভব। ট্রাফিক নিয়ম কঠোরভাবে প্রয়োগ, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, ইলেকট্রিক যানবাহনের প্রসার, হাসপাতাল-স্কুলের পাশে নীরব অঞ্চল ঘোষণা, এবং সর্বোপরি মানুষের নিজস্ব আচরণে নিয়ন্ত্রণ। একটি উন্নত সমাজ শব্দে নয়, শৃঙ্খলায় পরিচিত হয় এটাই হতে পারে ভবিষ্যতের স্লোগান।
শব্দদূষণ চোখে দেখা না গেলেও, তার ক্ষতি নিঃশব্দে জমতে থাকে; সময় থাকতে নিয়ন্ত্রণ না করলে মানবস্বাস্থ্য একদিন এর কাছে পরাস্ত হবেই। তাই প্রশ্নটা শুধু পরিবেশের নয়, জীবনযাত্রার আমরা কি শব্দে ভরা শহর চাই, না সুস্থ নীরবতা?
আরও পড়ুন...