ত্রিপুরায় সাংবাদিকতার সংকট: দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক নেতারা তথাকথিত সাংবাদিকদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন!
জয়ন্ত দেবনাথ
October 18, 2025
ত্রিপুরার সাংবাদিকতা আজ এক গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সমাজের নির্লজ্জ এক অংশ তথাকথিত ডিজিটাল সাংবাদিকতা বা কনটেন্ট ক্রিয়েটর সাংবাদিকতা-র নামে এক অনিয়ন্ত্রিত দুনিয়া তৈরি করছে, যেখানে সংবাদ নয়, বরং কুৎসা, কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য, ও ভুয়ো প্রচারই যেন প্রধান লক্ষ্য।এই তথাকথিত ফেসবুক সাংবাদিক ও ইউটিউবাররা বিনা নিমন্ত্রণে বিভিন্ন সামাজিক ও সরকারি অনুষ্ঠানে হাজির হন, নিজেদের ‘মিডিয়া’ পরিচয়ে ভুয়ো প্রভাব খাটান, এবং রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রেক্ষাপটে অবাধে দাপিয়ে বেড়ান। আশ্চর্যের বিষয় হল, রাজ্যের বহু দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিক ও কিছু মন্ত্রী এদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন। কারণ সহজ, এই তথাকথিত ডিজিটাল কন্টেন্ট ক্রিযেটররা টাকা বা রাজনৈতিক সুবিধার বিনিময়ে তাঁদের প্রচার করে থাকেন। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হল, এসব কন্টেন্ট ক্রিযেটররা নিজেদের সাংবাদিক ভাবেন। এবং একাংশ নেতা মন্ত্রীরা তাদের সাংবাদিকদের থেকেও বেশী গুরুত্ব দেন, যেহেতু পরম্পরাগত সাংবাদিকদের কাছ থেকে তারা খুব বেশী সুবিধাজনক প্রচার নিজেদের ইচ্ছা মতন পাননা। তাই টাকার বিনিময়ে এসব কন্টেন্ট ক্রিযেটরদের কাছ থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জন্য তারা ডিজিটাল প্রচার ক্রয় করেন। আর এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই
ত্রিপুরায় এখন এক নতুন মিডিয়া মাফিয়া চক্র তৈরি হয়েছে। কেউ মুখ্যমন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে, কেউ আবার বিজেপি সভাপতির সঙ্গে তোলা ছবি ব্যবহার করে নিজের পরিচয়কে বৈধ দেখাতে চাইছেন। তাঁদের সোশ্যাল মিডিয়া পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলেই এখন বিজ্ঞাপন ও সংবাদ বিক্রির বাজার গড়ে উঠেছে। বহু জনপ্রতিনিধি বা পুরসভা সদস্যরাও টাকা দিয়ে নিজেদের প্রচার করান এইসব ডিজিটাল চ্যানেলে, যা মূলধারার সাংবাদিকতার মর্যাদাকে ক্রমে ধ্বংস করছে।
এ অবস্থায় ত্রিপুরার সত ও প্রবীণ সাংবাদিকরা এক অনিশ্চয়তার মুখোমুখি। অনেকেই এখন নিজেদের সাংবাদিক পরিচয় প্রকাশ করতে চান না। কারণ, সমাজে সাংবাদিক মানেই আজ ‘ভুয়ো মিডিয়া’, ‘ইউটিউব নিউজ’, ‘ফেসবুক রিপোর্ট’ — এই শব্দগুলির সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে।এমনকি আজকাল দেখা যায়, রাজনৈতিক নেতারা বা মন্ত্রীরা প্রেস কনফারেন্সে মূলধারার সংবাদমাধ্যমকে ডাকেন না। বরং, সামনের সারিতে বসে থাকে এইসব অর্ধশিক্ষিত কন্টেন্ট ক্রিযেটর তথাকথিত ডিজিটাল সাংবাদিকরা। আর তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে বহু প্রকৃত সাংবাদিক এখন মাঠে নামা বন্ধ করে দিয়েছেন।তাঁরা আর নিউজ কভার করেন না, প্রেস মিটে যান না, প্রশাসনিক কার্যক্রমের প্রতিবেদনও লেখেন না।
মাত্র এক দশক আগেও ত্রিপুরায় কোনও সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অনৈতিকতার অভিযোগ শোনা যেত না। অথচ এখন প্রায় প্রতি মাসেই রাজ্যের কোনও না কোনও থানায় এদের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের হচ্ছে। কার বিরুদ্ধে কখন কি অপপ্রচার হবে, কে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের শিকার হবেন, তার কোনও ঠিক নেই। মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে শান্তিকালী আশ্রমের মতন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত, সবাই এই ডিজিটাল অপপ্রচার ও অনৈতিকতার শিকার।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, এত অভিযোগ, মামলা, ও সামাজিক ক্ষতির পরও রাজ্য প্রশাসন বা পুলিশ এখনও পর্যন্ত কোনও নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। সরকার এখনও এই তথাকথিত ফেসবুক সাংবাদিক বা ইউটিউবারদের কোনও আইনি স্বীকৃতি দেয়নি। ফলে তারা নিজেদের মতো করে সংবাদ প্রচারের নামে এক অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করছে।
ত্রিপুরার সাংবাদিক সমাজের অনেকেই মনে করেন, এই পরিস্থিতি যদি অবিলম্বে নিয়ন্ত্রণে না আনা যায়, তবে রাজ্যের সংবাদজগতের প্রতি মানুষের আস্থা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাবে। প্রয়োজন মিডিয়া রেজিস্ট্রেশন আইন, যেখানে শুধুমাত্র স্বীকৃত ও প্রশিক্ষিত সাংবাদিকরাই সংবাদ প্রচার করতে পারবেন।
যে রাজ্যে একসময় সাংবাদিকতা ছিল সমাজের নৈতিক ভিত্তি ও ন্যায়ের কণ্ঠস্বর, সেখানে আজ তা পরিণত হয়েছে ভুয়ো প্রভাবশালীদের রমরমা ব্যবসায়। সত্যিকারের সাংবাদিকরা যখন হতাশ, তখন দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদদের মুখে হাসি, কারণ তাঁদের জন্য এই তথাকথিত ডিজিটাল সাংবাদিকরাই এখন সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার।
শেষ কথা:
ত্রিপুরার প্রশাসনের উচিত অবিলম্বে এদের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা, এবং সত্যিকারের সাংবাদিকদের মর্যাদা ফিরিয়ে আনা। অন্যথায় রাজ্যের গণমাধ্যমের প্রতি মানুষের আস্থা একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে, যা এক গভীর সামাজিক বিপর্যয় ডেকে আনবে। ( লেখক জয়ন্ত দেবনাথ একজন সিনিয়র সাংবাদিক ও ত্রিপুরা ইনফো-র সম্পাদক)
আরও পড়ুন...