চড়ক ও ঢাকি
বেনিমাধব দেবনাথ
অধূনা কলকাতা নিবাসী ত্রিপূরার জোলাইবাড়ির ছেলে ।
এখনো মনে আছে, চড়ক পূজোর ঢাকে কাঠি পড়তো বারুণীর স্নানের দিন। বড়দের দেখতাম দুই নদীর সঙ্গমে গিয়ে পূর্ব-পুরুষদের নামে তর্পণ করতে। মহালয়াতে তর্পণ আমাদের ওই দিকে চালু ছিলো বলে আমি ছোটো বেলায় দেখি নি। বড় হয়ে আগরতলা এবং কোলকাতায় দেখেছি পিতৃ-পক্ষে তর্পণের হিড়িক!
চড়ক ও 'ঢাকি'র মধ্যে একটা গূঢ় সম্পর্ক আছে, ভাসা ভাসা জানতাম সেই ছোটো বেলায়। অবশ্য সে জানাটার আজ পর্যন্ত তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। ঐ বারুণী স্নানের দিন মা-মাসিদের দেখতাম 'সন্ন্যাসী' গাছকে তেল-সিঁদুর দিয়ে জাগাতে। 'সন্ন্যাসী গাছ' নিয়ে একটু বিশদে বলতে হবে- নইলে ঠিক বোঝা যাবে না।
আমরা তখন নিতান্ত ছোটো, কিন্তু একেক জন সাঁতারে ভীষণ দড়। পারলে সারাদিন পুকুরে কাটিয়ে দিই! পুকুরের জলে প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশ ফিটের একটা বহু পুরোনো গাছ ভেসে বেড়াতো, জল-তলের ঠিক নীচে। উপর থেকে তাই ঠাহর হতো না। সেটাকেই সন্ন্যাসী গাছ বলতাম সবাই। আমরা কয়েক জন খুদে মিলে সেই গাছের কাঁধে চড়ে এতো বড়ো পুকুরের কিনারে কিনারে জল- বিহার করে বেড়াতাম প্রায়ই। গাছটাকে গাছ বলে ভাবতেই পারতাম না, ঘুমন্ত মানুষ বলে মনে হতো। গাছ নিয়ে খেলতে দেখলে বড়োরা ভীষণ বকা-ঝকা করতেন। বিশেষ করে মা দেখলে আর রক্ষে থাকতো না।গাছকে, থুড়ি, সন্ন্যাসীকে, কিনারে নিয়ে আসতে হতো। অবোধ ছেলেদের হয়ে নাক কান মলে মা নিজেই সেই ঘুমন্ত সন্ন্যাসীর কাছে মাপ চেয়ে নিতেন।
প্রতি বছর চড়ক পূজার শেষে শিব নাকি এরকম বৃক্ষ রূপ ধারণ করে সন্ন্যাসীর মতো সারা বছর পুকুরের জলে ধ্যানে মৌন হয়ে ভেসে বেড়ান। বারুণীর স্নানের দিন তেল-সিঁদুর মাখিয়ে, শাঁখ বাজিয়ে তাঁকে আবার আহ্বান করে জাগাতে হয়। সেই 'জাগ্রত' সন্ন্যাসীকে দেখতাম চড়ক পূজার দিন আট-দশজন লোক দড়ি বেঁধে গোটা বাঁশের বাখারির সাহায্যে কাঁধে করে দুলিয়ে দুলিয়ে পূজার জায়গায় নিয়ে যেতো। পিছনে পিছনে গাঁয়ের সব লোক, ঢাক-ঢোল-কাঁসর-ঘণ্টা বাজিয়ে সন্ন্যাসীকে পরম শ্রদ্ধা জানাতো, কেউ বা নমস্কার করতো। মাঝে মাঝে 'হর হর মহাদেব' ধ্বনিতে চারদিক সোচ্চার হতো।
চড়ক পূজা বিকেলের দিকে শুরু হয়। সম্ভবত পূজাপাটের ব্যাপারটা কাছের শিবমন্দিরেই সারা হতো। আমরা যেটা দেখতাম, সেটা হলো সন্ন্যাসী গাছটিকে মাটিতে খাড়া করে পুঁতে দিয়ে তার মাথায় বাঁশের চড়কি বেঁধে দিতো। সেই চড়কিতে দড়ি বেঁধে পদ্মাসন শিবের মাটির মূর্তিকে সাঁই সাঁই করে ঘোরানো হতো। চড়কের ক্ষমতানুসারে একাধিক শিবের মূর্তিকে ঘুরানো হতো। উপস্থিত সব লোক 'বাবাজির' নামে জয়ধ্বনি দিতো। কখনো কখনো দেখতাম শিবের মূর্তির জায়গায় মানুষকে বেঁধে পাক খাওয়ানো হচ্ছে। কয়েক পাক ঘুরতে পারলে সেই ব্যাক্তিকে সবাই পুণ্যবান বলে মনে করতো। এই উড়ন্ত চড়কি খাওয়াটা আরো বেশি ধর্মীয় লৌকিকতায় মূল্য পেতো যখন কিছু ট্রেইনড লোক বা সন্ন্যাসী পিঠে বঁড়শি গেঁথে ঝুলে থেকে ঘুরতো। ভারতের আরো কয়েকটি জায়গায় এরকম বঁড়শির সাহায্যে চড়কি খাওয়া হয় বলে শুনেছি, বিশেষ করে অন্ধ্রে এবং গুজরাতের গ্রামে।
সাধারণত যেখানে চড়ক পূজা হয় সেখানে খোলা মাঠে জম জমাট মেলা বসে। রাত হয়ে গেলে হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে চড়ক এবং মেলা দুইই চলতো।
চড়ক পূজা একদিনে শেষ হয় না। প্রথম দিনের শেষে বাবাজির মূর্তি গুলোকে যত্ন সহকারে কাছাকাছি কোনো শিব মন্দিরে রাখা হয়। অনেক সময় মাটির মূর্তি চড়কির ধকল সইতে না পেরে ভেঙে খুঁত হয়ে যায়, খুঁতো বাবাজিকে চড়ক গাছে তোলা যায় না, অকল্যাণ হয় বলে সবাই মনে করে। তখন আবার কারিগর ডেকে বাবাজিদের পূর্ণতা দিতে হয়। কয়েক দিন চড়ক এবং মেলা চলার পর একদিন সমাপ্ত হয়। তখন সন্ন্যাসী গাছটিকে মাটি থেকে তুলে নিয়ে আবার পুকুরের জলে ছেড়ে দেওয়া হয়। সন্ন্যাসী গাছের আবার এক বছরের জন্য মৌনব্রত শুরু হয়।
ঢাকি
ঢাকি বলতে এখানে যারা ঢাক বাজায় তাদের বোঝাতে চাইছি না। অঞ্চল-ভেদে কখনো কখনো একই নাম অন্য রকম অর্থ বহন করে।
আগেই বলেছি চড়ক ও 'ঢাকি'র মধ্যে অবশ্যই কোনো যোগসূত্র আছে। চৈত্র মাসে বারুণী স্নানের দিন চড়কের সন্ন্যাসীকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে, নদী সঙ্গমে স্নান করে 'ঢাকি'র শুরু। আমি যতটুকু দেখেছি এবং বুঝেছি 'ঢাকি' হচ্ছে চড়ককে উপলক্ষ্য করে গ্রাম্য 'যাত্রা' বা 'পালা'। রামায়ণ, মহাভারত অথবা পুরাণের কোনো ধর্মীয় আখ্যানকে অবলম্বন করে এর পালাটি অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় গ্রামেরই কেউ লিখে দিতো। রিহার্সাল ইত্যাদি একমাস আগে থেকেই শুরু হয়ে যেতো। কুশীলব সব গ্রামেরই চাষা-বাসা তথাকথিত অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত লোকগুলো। বারুণীর দিন পালা নামিয়ে মোটামুটি পনের দিন চালিয়ে চড়ক পূজায় বছর শেষে 'ঢাকি'র সমাপ্তি। আমার মনে হয়েছে, চড়ক পূজার অর্থ সংগ্রহের জন্যই 'ঢাকি'র আয়োজন। আর এখানেই চড়কের সঙ্গে 'ঢাকি'র যোগসূত্র। আর ঢাকির কুশীলবরাই চড়কের সব কাজের ব্যবস্থা করতে দেখতাম।
তবে এই 'ঢাকি'র সঙ্গে ঢাকের যে কোনো যোগসূত্র নেই এমন নয় । 'ঢাকি'র ঘোষণা হয় সশব্দ ঢাকের উচ্চ রবে। ঢাকের কাঠিতে মানুষ সচকিত হয়ে 'ঢাকি'র পালা দেখতে ছুটে ছুটে যায় রাতের অন্ধকারে। এ বাড়ি সে বাড়ি হয়ে রাত কাবার হয়ে যায়।
গাঁ-গঞ্জে পালার পারিশ্রমিক সব সময় ক্যাশে হওয়া সম্ভব ছিলো না। বেশির ভাগই 'অন্যভাবে' অর্থাৎ ধান-চালে মেটানো হতো। এ জন্য পালাকারদের একজন 'ভারী'কে রাখতে হত, যে ভারে করে সংগৃহীত ধান-চাল 'ঢাকি'দের সঙ্গে বাড়ি বাড়ি বয়ে বেড়াতো।
রঙ মাখা, গোঁফ-দাড়ি কামানো সীতা ফুক ফুক করে বিড়ি টানছে দেখে অবাক হয়েছিলাম প্রথম অনভিজ্ঞতায়। ঢাকির সঙ্গে রাত্রিবাসে প্রথম জেনেছিলাম বেয়াড়া ঘুম তাড়াতে চাল চিবানোর জুড়ি নেই। হনুমানের লেজ যে মেয়েদের পুরানো কাপড় জোড়া দিয়ে আর গাঁট দিয়ে দিয়ে তৈরী হয় তাও তো জেনেছিলাম ঢাকি-সঙ্গে। নিরীহ পেইন্টার লালমোহন কাকুই যে দশমুণ্ডু বাজখাঁই রাবণ তা জানবো কি করে? এরকম আরো কতো রহস্যভেদ! সেই মজার ছোটবেলায়!
"সীতার বনবাস", রাবণ বধ, মহীরাবণ বধ, চাঁদ সদাগর, এসব কাহিনী বইতে না পড়েও গ্রামের লোকগুলো সব জেনে যায় আর চর্চা করতে থাকে। এসব অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত লোকগুলোর বুকের ভিতর অজান্তেই এক বৃহত্তর ভারতের ছায়া পড়ে। যা দীর্ঘতর হতে হতে সারা দেশকে একসূত্রে গেঁথে নেয়। এ গুরু দায়িত্ব এদের কে দিলো কে জানে?