শক্তিপীঠ উদয়পুরে দেওয়ালি

পান্নালাল রায়

October 16, 2025

দেওয়ালি মেলাকে কেন্দ্র করে ত্রিপুরার উদয়পুরের ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দির সেজে উঠেছে এখন।শুধু ত্রিপুরা কেন,গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলেরই এক উল্লেখযোগ্য ধর্মীয় পর্যটন ক্ষেত্র হচ্ছে মাতা ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দির প্রাঙ্গণ। তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইতিহাস,পুরাণ আর কিংবদন্তী!একান্ন পীঠভূমির এক পীঠভূমি হচ্ছে উদয়পুর। সারা বছর রাজ্য ও বহির্রাজ্যের পুণ্যার্থী মানুষ ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দির দর্শনে উদয়পুর আসেন। ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দির সাধারণ্যে মাতাবাড়ি নামেও পরিচিত। বিভিন্ন শক্তিপীঠে যেমন গভীর নিষ্ঠা আর আড়ম্বরের সঙ্গে শ্যামা পূজা হয়ে থাকে তেমনই ব্যতিক্রম নয় এই মন্দিরও। শ্যামা পূজার সময় মাতা ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দির প্রাঙ্গণে দেওয়ালী মেলায় লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাবেশ ঘটে।

উদয়পুর ত্রিপুরার প্রাচীন রাজধানী।প্রায় বারশো বছর এখানে ত্রিপুরার রাজধানী ছিল। এত দীর্ঘকাল ব্যাপী কোনও এলাকা রাজধানীর গৌরব বহন করছে এমনটা গোটা ভারতবর্ষেই এক বিরল দৃষ্টান্ত। উল্লেখ করা যায় যে,মাণিক্য রাজবংশ প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই সেখানে ছিল ত্রিপুরার রাজধানী।অবশ্য উদয়পুর নয়,তখন এই জনপদের নাম ছিল রাঙ্গামাটি।ষষ্ঠ শতাব্দীতে রাজা যুঝার ফা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী লিকা রাজাকে পরাস্ত করে এখানে তাঁর রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।ত্রিপুরায় মাণিক্য রাজবংশের প্রতিষ্ঠা হয় পঞ্চদশ শতকে।ষোড়শ শতকে রাজা উদয় মাণিক্য নিজের নাম অনুসারে রাজধানীর নাম রাখেন উদয়পুর। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে রাজা কৃষ্ণ মাণিক্য উদয়পুর থেকে তাঁর রাজধানী সরিয়ে নেন আজকের পুরান আগরতলায়।যাইহোক, সুদূর অতীত কাল থেকে এক ঐতিহ্য বয়ে নিয়ে চলেছে ত্রিপুরার প্রাচীন রাজধানী উদয়পুর।সেখানে ছড়িয়ে আছে নানা স্হাপত্য আর প্রত্ন নিদর্শন।রয়েছে অনেক জলাশয়। ছড়িয়ে আছে বহু প্রাচীন মন্দিরও। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মাতা ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দির। পাঁচ শতাধিক বছর আগে ত্রিপুরার বীর নৃপতি ধন্য মানিক্য এই মন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন। দেশের অন্যান্য পীঠভূমির মতো এই মন্দিরকেও জড়িয়ে আছে কিংবদন্তী। কথিত আছে,রাজা বিষ্ণু বিগ্রহ স্হাপনের উদ্দেশ্যে এখানে মন্দির নির্মাণে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে শেষ পর্যন্ত দেবীকে এনে এই মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। ত্রিপুরা সুন্দরী বিগ্রহ ঘিরে আছে অন্য জনশ্রুতিও। চট্টগ্রামে নাকি এক আশ্চর্য শিবলিঙ্গের দেখা পাওয়া গিয়েছিল। ত্রিপুরার রাজা তা নিয়ে আসতে লোকলস্কর পাঠান চট্টগ্রামে। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও সেই শিবলিঙ্গ মাটি থেকে উত্তোলন সম্ভব হয়নি।রাজা তখন স্বপ্নাদিষ্ট হলেন। শিবলিঙ্গ নেয়া যাবেনা। তবে পাশেই রয়েছেন দেবী। দেবীকে নেয়া যাবে। তবে শর্ত হলো এক রাতের মধ্যে যতটা পথ নেয়া যায় দেবী ততটা পথই যাবেন।দেবীর বিগ্রহ ত্রিপুরায় নিয়ে আসার সময় ভোরের আলো ফুটে উঠে রাজধানী উদয়পুর সংলগ্ন কুর্মাকৃতির এক টিলা ভূমির কাছে।তারপর রাজা সেখানেই মন্দির গড়ে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করেন।

ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দির প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে ' রাজমালা'তে রয়েছে -

"আর এক মঠ দিতে আরম্ভ করিল,

বাস্তু পূজা সঙ্কল্প বিষ্ণুপ্রীতে কৈল।

ভগবতী রাজাকে স্বপ্ন দেখায় রাত্রিতে,

এই মঠে রাজা আমা স্হাপ মহাসত্ত্বে।

চাটিগ্রামে চট্টেশ্বরী তাহার নিকট,

প্রস্তরেতে আমি আছি আমার প্রকট।

তথা হতে আনি আমা এই মঠে পূজ,

পাইবা বহুল বর যেই মতে ভজ।...."

মন্দিরে প্রথমে শুধু পশ্চিমমুখী দরজা ছিল। পরবর্তী সময়ে উত্তর দিকেও একটি দরজা নির্মিত হয়। সামনে রয়েছে একটি নাট মন্দির।১৫০১ খ্রিষ্টাব্দে ধন্য মানিক্য কর্তৃক মন্দিরটি নির্মিত হওয়ার পর পরবর্তী রাজাদের আমলে বেশ কয়েকবার মন্দিরটির সংস্কার কাজ হয়েছে। মন্দির গাত্রে যেসব শিলালিপি পাওয়া গেছে তাতে অন্যূন পাঁচ বার মন্দিরটি সংস্কারের কথা জানা যায়।বর্হিশত্রু কর্তৃক ত্রিপুরা আক্রান্ত হওয়ার সময় এই মন্দিরও আক্রমণের শিকার হয়েছে। ষোড়শ শতকে অমর মানিক্যের সময়ে যখন আরাকানের মগ বাহিনী ত্রিপুরা আক্রমণ করে তখন মন্দিরের চূড়াটি বিনষ্ট করে দেয় তারা।কল্যাণ মাণিক্য (১৬২৬-৬০খ্রিঃ) এই চূড়াটির সংস্কার কাজ করেছিলেন। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, অতীতে মন্দিরে ধনরত্নের লোভেও বর্হিশত্রুর আক্রমণ নেমে আসতো।এটা শুধু ত্রিপুরা নয়,দেশের বিভিন্ন জায়গাতেই এ রকম ঘটনা ঘটতো।মন্দির গুলোর গঠন প্রকৃতিও অনেকটা দুর্গের মতো ছিল। কোথাও আবার দুর্গের মধ্যেই সুরক্ষিত অবস্থায় মন্দির থাকতো।মন্দিরের ভেতরে সযত্নে রাখা হতো ধনরত্ন।

যাইহোক, ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দিরের পূর্ব দিকে রয়েছে কল্যাণ সাগর নামে একটি দীঘি। মহারাজা কল্যাণ মাণিক্য সপ্তদশ শতকে এই দীঘিটি খনন করিয়েছিলেন।'রাজমালা'তে রয়েছে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে রাজা এই দীঘিটি খনন করিয়েছিলেন।'রাজমালা'তে রয়েছে -

" সেই কালে মহারাজার স্বপ্নেতে আদেশ,

কালিকা দেবীয়ে স্বপ্ন দেখায় বিশেষ।

আমা সেবা কষ্ট হয় জলের কারণে,

জলাশয় দেও রাজা আমা সন্নিধানে।

রাত্রিকালে মহারাজা দেখয়ে স্বপন,

প্রভাতে কহিল রাজা স্বপ্নের কথন।..."

কল্যাণ সাগরের বিরল দর্শন কচ্ছপ ও গজার মাছ পুণ্যার্থীদের এক বড় আকর্ষণ।এইসব কচ্ছপ ও মাছ মানুষের কাছে নির্ভয়ে চলে আসে।দীঘির জলে পুণ্যার্থীরা তাদের জন্য খাবার ছিটিয়ে দেন।

ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দিরে মায়ের বড় বিগ্ৰহের পাশে রয়েছে ছোট অপর একটি বিগ্ৰহ। ছোট মা হিসেবে পরিচিত এই বিগ্ৰহ।লোকশ্রুতি, মন্দিরের পাশে সুদূর অতীতে একটি জলাশয়ে পাওয়া গেছে এই বিগ্ৰহটি।কেউ কেউ বলেছেন একদা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী লিকা সম্প্রদায়ের আরাধ্য দেবী ছিলেন এই ছোট মা।ষষ্ঠ শতাব্দীতে ত্রিপুরার ফা রাজার কাছে ‌পরাস্ত হয়ে পালিয়ে যাবার সময় লিকারা ছোট মাকে ফেলে যায়।

ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দিরকে ঘিরে আছে এরকম নানা লোকশ্রুতি।মন্দির প্রতিষ্ঠা থেকে বিগ্ৰহ স্হাপন পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই রয়েছে দেবীর স্বপ্নাদেশের কথা।ধন্য মানিক্য স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে দেবীকে চট্টগ্রাম থেকে এনে প্রতিষ্ঠা করেছেন।কল্যাণ মানিক্য স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে দেবীর সেবার্থে জলাশয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। এমনকি আধুনিক কালের নৃপতি বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্যও স্বপ্ন দেখে একটি ত্রিশূল স্হাপন করেছেন মায়ের বিগ্ৰহের পাশে।

ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দির যেন এক সমন্বয়েরও প্রতীক।রাজা চেয়েছিলেন বিষ্ণু মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন ভগবতীকে।মূল বিগ্ৰহের পাশে মন্দিরে আছেন ছোট মা,যিনি নাকি একদা লিকাদের আরাধ্য দেবী ছিলেন। ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দিরে দেবীর বিগ্ৰহের সামনে রয়েছে শালগ্ৰাম শিলাও। মন্দিরের পূজা সহ নানা কাজে রয়েছেন নানা সম্প্রদায়ের মানুষ। দেওয়ালী মেলা সহ অন্য সময়েও নানা সম্প্রদায়ের মানুষ মন্দির প্রাঙ্গণে আসেন।কেউ কেউ তাদের জমির উৎপাদিত ফসল প্রথম উৎসর্গ করেন দেবীর উদ্দেশ্যে।সমসের গাজী ত্রিপুরার ইতিহাসের এক বর্ণাঢ্য চরিত্র।এক সাধারণ প্রজা থেকে তিনি ত্রিপুরার সর্বময় কর্তা হয়ে উঠেছিলেন। উদয়পুর অধিকারের যুদ্ধে সমসের মায়ের পূজা করেছিলেন বলে উল্লেখ রয়েছে 'গাজীনামা' নামে তাঁর জীবন কাহিনি নির্ভর এক কাব্যগাঁথাতে।

অতীত ঐতিহ্যের আলোয় উদ্ভাসিত একান্ন পীঠের এক পীঠ এই ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দির। প্রতিদিনই এই মন্দিরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পুণ্যার্থী মানুষ পূজা দেন।প্রসাদ হিসেবে মায়ের বাড়ির পেঁড়ার সুনাম আজ ছড়িয়ে পড়েছে দেশের নানা অঞ্চলে। মন্দিরের পাশে রয়েছে পেঁড়ার অনেক দোকান।বহু মানুষ এর উপর জীবিকা নির্বাহ করে।ত্রিপুরার বিভিন্ন অঞ্চলতো বটেই,দেশের নানা অঞ্চলেও আজ মাতাবাড়ির পেঁড়া নিয়ে যাওয়া হয়।অদূর ভবিষ্যতে দেশের বাইরেও এই পেঁড়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।শ্যামাপূজা উপলক্ষ্যে এখন মাতাবাড়ির পেঁড়া উৎপাদকদের মধ্যেও চরম ব্যস্ততা চলছে।মন্দিরে বলির জন্য ত্রিপুরার ভারতভুক্তির চুক্তি অনুযায়ী পাঁঠা মহিষ সরবরাহ করা হয়।অমাবস্যায় মহিষ বলি হয়।দেশের কোনও মন্দিরে বলির জন্য সরকার থেকে পাঁঠা-মহিষ সরবরাহও এক বিরল দৃষ্টান্ত।দেবীর রয়েছে বহু মূল্যের স্বর্ণালঙ্কার।সেসব ট্রেজারীতে রাখা হয়।বিশেষ পূজায় দেবীকে অলঙ্কারে সাজানো হয়।

ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দিরের দেওয়ালি মেলা ত্রিপুরার সবচেয়ে বড় মেলা। ত্রিপুরা ও দেশের অন্যান্য অংশ থেকে বহুসংখ্যক পুণ্যার্থী মানুষ দেওয়ালি মেলা উপলক্ষ্যে এসময় উদয়পুরের মাতাবাড়ি অর্থাৎ ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দিরে আসেন।মেলা উপলক্ষ্যে মন্দির প্রাঙ্গণে বিভিন্ন সরকারি দপ্তর থেকে মন্ডপ খোলা হয়। রাতভর নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন হয়। ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দির প্রাঙ্গণে দেওয়ালি মেলা ঘিরে এখন ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে।দূর দূরান্তের ব্যবসায়ীরা ইতিমধ্যে মেলা প্রাঙ্গণে এসে তাদের পসরা সাজাবার প্রস্তুতি শুরু করেছেন। যাত্রা শুরু করেছেন দূর দূরান্তের পুণ্যার্থীরাও। দেওয়ালি মেলা উপলক্ষ্যে এখন যেন সবার গন্তব্য শক্তিপীঠ উদয়পুর।

আরও পড়ুন...


Post Your Comments Below

নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।

বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।

Free Download Avro Keyboard

Fields with * are mandatory





Posted comments

Till now no approved comments is available.