ত্রিপুরাইনফো মেগা ক্যুইজ প্রতিযোগিতা ২০১৯ একটি পর্যালোচনা
জ্ঞান বজ্র রেপা
যীশু খ্রিস্টের আবির্ভাবের বহু আগেই মেধার অনুশীলন তথা চর্যায় বিশ্বজুড়ে ভারত ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ। গুরুকূল পরম্পরা ও প্রাতিষ্ঠানিক বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়- এই দুইরূপে তার বিকাশ ঘটে। ১২০৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারত গৌরব বিশ্ববিদ্যালয় গুলির সর্বশেষ নিদর্শন সোমপুরী ও জগদ্দল মহাবিহার ধ্বংস হয়ে যায়। তার আগে পর্যন্ত মেধাচর্চা ও চর্যার ধারাটি ছিল অতিউজ্জ্বল । গুরুকূল এখনও ভারতে আছে। অন্যদিকে পাশ্চাত্যে গ্রিস ও রোমে গড়ে উঠে ভিন্নধর্মী জ্ঞান চর্চার ধারা। কালান্তরে উপনিবেশিকতার হাতধরে জ্ঞান চর্চা তথা মেধার অনুশীলন এক্ষণে বহুমাত্রিক ও গতিশীল একটি প্রক্রিয়া। তারই সর্বশেষ একটি ধারা হল ক্যুইজ (QUIZ) অর্থাৎ প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে জ্ঞানের পরিচয় ও সমৃদ্ধি।
শিক্ষা ও পেশাগত কারনে এর গ্রহনযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা ক্রমবর্ধমান। জ্ঞান চর্চার এই মাধ্যমটির মাধ্যমে মেধার বিকাশ ছোট্ট প্রান্তিক রাজ্য ত্রিপুরায় আজকাল খুবই জনপ্রিয় একটি মাধ্যম। এই বিশ্বাসে ত্রিপুরাইনফো ডটকম (Tripurainfo.com) ২০০৫ সাল থেকে প্রতিবছর আগরতলায় আয়োজন করছে মেগা ক্যুইজ প্রতিযোগিতা। দীর্ঘ চৌদ্দ বছরের প্রচেষ্টায় অনুষ্ঠানটি ত্রিপুরাবাসীর মধ্যে বিশেষ করে ক্যুইজে উৎসাহী জনগন এবং শিক্ষা জগতের লোকদের মধ্যে একটি বাৎসরিক উৎসবের রূপ নিয়েছে। ২০১৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর আগরতলা টাউন হলে অনুষ্ঠিত হল এবারের মেগা ক্যুইজ প্রতিযোগিতা। খ্যাতনামা বিদ্বান, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিজীবি মহলের বহু মান্যবরদের উপস্থিতিতে কানায় কানায় পূর্ন টাউন হলে এবারেও ছিল উৎসবের আবহ। উপস্থিত ছিলেন কিন্ডার গার্ডেন থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের ছাত্র সমাজ। বিভিন্ন বয়স ও পেশার সঙ্গে যুক্ত উৎসাহী ও প্রতিযোগীবৃন্দ এবং সমাজের নানা স্তরের মহিলাদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। সন্মানিত অতিথিদের মধ্যে ছিলেন প্রাক্তন মূখ্যমন্ত্রী ও বর্তমান বিরোধী দলনেতা শ্রী মানিক সরকার। বর্তমান উপমুখ্যমন্ত্রী শ্রী যিষ্ণু দেববর্মন, রাজ্য শিশু অধিকার কমিশনের চেয়ারপার্সন নিলিমা ঘোষ, বিধায়ক দিলীপ দাস, ওএনজিসি ত্রিপুরার প্রধান নির্বাহী পরিচালক ওপি সিংহ, রাজনৈতিক নেতা রাজীব ভট্টাচার্জি, প্রাক্তন ডেপুটি স্পিকার ও মন্ত্রী পবিত্র কর, প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সুদীপ রায় বর্মন, রাজনৈতিক নেতা ও বিশিষ্ট অ্যাডভোকেট পীযুষ বিশ্বাস, ডিজিপি (ইনচার্জ) রাজীব সিং, আইএলএস হসপিটাল-এর সিইও তথা মুখ্য পরামর্শদাতা কিশোর আম্বুলি, হলিক্রস স্কুলের অধ্যক্ষ ফাদার ববি জন, নর্থ ইস্ট কালার্স পত্রিকার সম্পাদক সঞ্জীব দেব এবং ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক প্রদীপ দত্ত-ভৌমিক, ‘হেডলাইন ত্রিপুরা’ নিউজ চ্যানেল – এর সম্পাদক প্রণব সরকার এবং আরও অনেক অবসরপ্রাপ্ত আইএএস, আইএফএস এবং আইপিএস অফিসার প্রমুখ।
তাদের সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে উঠে এসেছে, জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে মেধা বিকাশের সম্ভাবনা ও গুরুত্বের কথা। শিক্ষা জগতে ত্রিপুরার উজ্জ্বল সম্ভাবনার কথাও ধ্বনিত হয়েছে তাদের মূল্যবান বক্তব্যে। স্বাগত ভাষণে ত্রিপুরাইনফো-র প্রধান সম্পাদক তথা আয়োজক কমিটির চেয়ারম্যান বর্ষীয়ান সাংবাদিক শ্রী শেখর দত্ত মাতৃভাষায় শিক্ষার গুরুত্ব থেকে শুরু করে ত্রিপুরার মতো প্রান্তিক জায়গায় ত্রিপুরাইনফো-র পরিচালনায় ক্যুইজ এর মতো একটা অনুষ্ঠান কিভাবে বার্ষিক একটা অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে তার বিস্তারিত তুলে ধরেন। তিনি বলেন, গত শতাব্দীর ষাটের দশকের গোড়ার দিকে ব্রজগোপাল দেবনাথ ত্রিপুরা থেকে প্রথম আইআইটিতে পড়াশুনা করতে যান এবং তার কিছুদিন পরেই এক্ষনে অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত ডিজিপি অমিতাভ কর আইআইটিতে পড়াশুনা করতে যান। ত্রিপুরার সিদ্ধার্থ পুরকায়স্থ ১৯৬৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের (ডাব্লুবিএসই) উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছিল; এই উজ্জ্বল উদাহরণ গুলি ত্রিপুরার অগণিত অন্যান্য ছাত্র ছাত্রীদের কাছে অনুসরণ যোগ্য হয়েছিল। এর থেকে এটাই প্রমানিত হয় যে ত্রিপুরার ছাত্রছাত্রীদের মেধা ও মননের বিকাশ বহুকাল ধরেই জাতীয় স্তরে স্বীকৃত। যা এক্ষণে দেশের মাটি ছেড়ে বিদেশেও ক্রম প্রলম্বিত।
ত্রিপুরাইনফোর এবারের ক্যুইজ অনুষ্ঠানটিও উপস্থাপনার গুনে ছিল চমকপ্রদ। উপন্থাপক, সুদক্ষ ও নামি ক্যুইজ মাস্টারদের সাবলীল কিন্তু সরস পরিচালনা ও উপস্থাপনায় প্রতিযোগিতাটি হয়ে উঠে মনোজ্ঞ। প্রতিযোগীরা ছাড়াও সাধারণ দর্শক বিশেষ করে কচিকাঁচাদের মধ্যে যে তীক্ষ্ণ মেধা ও অনুসন্ধানী মনের বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে তা ছিল এক কথায় অভাবনীয়। শিশুদের উৎসাহী অংশগ্রহণ এই মেগা ক্যুইজ প্রতিযোগিতাটিকে অন্যমাত্রা দান করেছে। সন্মানিত অতিথিদের গাছের চারা উপহার হিসাবে প্রদানের মাধ্যমে ত্রিপুরাইনফো ডটকম একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। তাদের এই উদ্যোগ ভবিষ্যতে অনুকরণীয় হবে নিঃসন্দেহে।
ত্রিপুরাইনফোর এবারের ক্যুইজ অনুষ্ঠানে দিনভর অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে আমার মনে হয়েছে, ‘মেগা ক্যুইজ প্রতিযোগিতা ২০১৯’ আঞ্চলিক সীমা পেরিয়ে এবার জাতীয় স্তরে উন্নীত হয়েছে। ত্রিপুরার বিখ্যাত শিক্ষাবিদ তথা ক্যুইজ মাস্টার শ্রী অভিজিৎ ভট্টাচার্য, শ্রী নন্দু পানিক্করের সঙ্গে এবারও উপস্থিত ছিলেন জাতীয়স্তরের ক্যুইজ মাস্টার হায়দ্রাবাদ থেকে আগত ভরত জৈন। তাছাড়া রাজ্য এবং বহিঃরাজ্যের বহু পৃষ্ঠপোষক প্রতিযোগিতাটিকে জাতীয়স্তরে উত্তোলনে সাহায্য করেছে। ডঃ এম জে পানিক্কর যিনি বর্তমানে মধ্য প্রাচ্যের ওমানে চাকরিতে রয়েছেন এবং 'মেগা ক্যুইজ' -এর প্রাক্তন ক্যুইজ মাস্টার ছিলেন, ত্রিপুরায় ছুটিতে এসে তিনিও এই মেগা ক্যুইজ অনুষ্ঠানে ক্যুইজ মাস্টার হিসাবে কিছুক্ষণের জন্যে যোগ দিয়েছিলেন। টান টান উত্তেজনাপূর্ন এই প্রতিযোগিতায় এবছর প্রথম পুরষ্কার দুটি ল্যাপটপ পেয়েছেন অম্লান গুপ্ত এবং সৌপ্তিক চক্রবর্তী জুটি, দ্বিতীয় পুরষ্কার দুটি এলইডি টিভি সেট পেয়েছেন রঞ্জন পাল এবং দেবাঙ্কুর ভৌমিক জুটি এবং তৃতীয় পুরস্কার দুটি স্মার্ট মোবাইল সেট পেয়েছেন দীপঙ্কর কর ও তাপস চন্দ্র দেব জুটি। সব মিলিয়ে দেড় শতাধিক বিভিন্ন পুরস্কার বিতরিত হয়েছে।
সারা দিনব্যাপী এই উপভোগ্য অনুষ্ঠানটির সুপরিচালনায় ও উপস্থাপনায় এবছরও উপস্থিত ছিলেন ত্রিপুরার খ্যাতনামা অ্যাঙ্কর মধুরীমা ভট্টাচার্য্য ও গোল্ডেন মাইক পুরস্কারপ্রাপ্ত রেডিও জকি কলকাতার প্রবীণ শেঠিয়া।
গত ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৯ দিনভর রাজধানীর টাউন হলে ত্রিপুরাইনফো-এর ক্যুইজ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে আরও যে একটা বিষয় বারবারেই মাথায় ঘুরছিল যে, ক্যুইজ বা জ্ঞানের একটা অনুষ্ঠান কিভাবে এত জনপ্রিয়তা পেতে পারে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ভবিষ্যৎ দিনেও ত্রিপুরাইনফো রাজ্যে জ্ঞানের এই উৎসবকে চালু রাখবেন, সেই সঙ্গে আগরতলাকে উত্তরপূর্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মেধার শহর হিসেবে জাতীয় স্তরে প্রতিষ্ঠা দিতে ত্রিপুরাইনফো কর্তৃপক্ষ উপযুক্ত ভুমিকা গ্রহন করবে। 'Destination Quiz Agartala' এই আশা অসম্ভব নয়। আমার আরও বিশ্বাস নিকট দিনে দেশ ও বিদেশ থেকে আরও বেশী করে প্রতিযোগী ও প্রতিযোগিনীরা ত্রিপুরার বাৎসরিক এই ক্যুইজ তথা জ্ঞানের উৎসবে সামিল হবেন।