পৌষ পার্বণে ত্রিপুরা: এক অনন্য সংস্কৃতি ও সম্প্রীতির মেলবন্ধন
অশেষ সেনগুপ্ত
January 13, 2025
সংক্রান্তি হলো পরিবর্তনের বার্তা, যেখানে প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে এক নবজাগরণের সূচনা হয়। তাই ত্রিপুরাবাসীর অন্যতম দুটি প্রধান সংক্রান্তি হলো বছর শেষে চৈত্র সংক্রান্তি এবং শীতের মাঝে পৌষ সংক্রান্তি। ত্রিপুরায় পৌষ সংক্রান্তি এক অন্যতম ঐতিহ্যবাহী উৎসব, যা একসময় কৃষিনির্ভর সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে এই উৎসবের ধরণ ও উদযাপনের রীতিতে পরিবর্তন এলেও, এর মূল সত্তা আজও টিকে আছে। পৌষ সংক্রান্তি কেবল একটি ধর্মীয় বা কৃষি উৎসব নয়, এটি ত্রিপুরার জনজীবনের এক অনন্য সংস্কৃতির প্রতিফলন।একসময় ত্রিপুরার গ্রামাঞ্চলে পৌষ সংক্রান্তি ছিল কৃষিজীবী মানুষের অন্যতম প্রধান উৎসব। ফসল কাটার পর নতুন ধান থেকে উৎপন্ন চাল ঘরে তোলার আনন্দে কৃষক পরিবারগুলোর মধ্যে এক উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হতো। প্রাচীনকাল থেকেই দেবীদেবতা তথা পূর্বপুরুষদের নতুন চালের গুঁড়ো দিয়ে নানান পিঠে বানিয়ে নৈবেদ্য হিসেবে নিবেদনের রীতি চলে আসছে। মূলত হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী সূর্যদেব এইদিনে মকর রাশিতে গমন করেন বলে একে মকর সংক্রান্তিও বলা হয়। তাছাড়া এইদিনে দ্বাপর যুগে শ্রেষ্ঠ ক্ষত্রিয় পিতামহ ভীষ্ম শরশয্যায় থাকাকালীন স্বেচ্ছা মৃত্যু বরণ করেছিলেন। তাই বহু মানুষ এইদিনে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ ও শ্রাদ্ধ করে থাকেন। ত্রিপুরায় দোল পূর্ণিমার পরিবর্তে পৌষ সংক্রান্তির দিন ভোরে বুড়ির ঘর পড়ানোর প্রথা চলে আসছে। এবং তারই সঙ্গে প্রচলিত আছে পৌষ সংক্রান্তির আগের দিনটিতে চুড়ুইভাতি করার। যদিও এখন তার রূপ অনেক বদলেছে। তবে আজ থেকে দশ- বারো বছর আগেও এই চড়ুইভাতি ছিল একেবারে অন্যরকম। পাড়ার ছোটদের হাত ধরেই মূলত আয়োজিত হতো এই চড়ুইভাতি। শীতে শুষ্ক গাছের পাতা, খেজুর গাছের সরু পাতা জড়ো করে বাঁশের খুঁটি দিয়ে তৈরী করা হতো বুড়ির ঘর। সবাই যে যার সাধ্যমতো চাঁদা দিত। বাড়ির বড়দের কাজ ছিল এই আয়োজন সুষ্ঠ ভাবে তদারকি করা। সামান্য টাকায় মুখরোচক একটি সান্ধ্য জলখাবার এবং বাকি টাকা দিয়ে মাংস ভাত কিংবা সঙ্গে দু - একটি ছোট পদ আর মুচমুচে পাঁপড়। বুড়ির ঘরে বসে কিংবা বাইরে আগুন জ্বালিয়ে তার চারদিকে বসে খাওয়া হতো পিকনিক। তার সঙ্গে ছোট একটা মিউজিক বক্স হলে তো কথাই ছিল না। নাচে গানে একটি নির্ভেজাল আনন্দ মুখর রাত্রি উদযাপন করত আট থেকে আশি সকলে।আগুন জ্বালিয়ে উষ্ণতা গ্রহণ, গল্পগুজব ও আনন্দ-উল্লাসের মাধ্যমে দিনটি অতিবাহিত হত। খাওয়ার পর্ব শেষ করেই বড়োদের সঙ্গে শুরু হতো রাত জাগা। কারন লোক মুখে শোনা যায় পৌষ সংক্রান্তিতে নির্দোষ চুরি করলে নাকি পাপ হয় না। তাই রাতে জমানো কাঠ, ডাব আর খাঁচায় বন্দী হাঁস,মুরগি রীতিমতো পাহারা দিতে হতো। সঙ্গে অন্য পাড়ার ছেলেদের রাতেই বুড়ির ঘর পুড়িয়ে দেবার ভয় তো থাকতই। এই টানটান উত্তেজনা আর মজা নিয়েই রাত পোহাত সবার।
ব্রহ্ম মুহূর্তে সংকীর্তন মুখরিত হয়ে উঠত চারিদিক।রাতজাগা ও আধঘুম ভেঙ্গে উঠে এসে সকলে একত্রিত হয়ে আগুন দিত বুড়ির ঘরে। তারপরেই একে একে সকলে স্নান সেরে নিতো। শীতের ভোরে উষ্ণ গরম জলে স্নান করে মায়েরা নতুন চালের গুঁড়ো দিয়ে নানান পিঠে - পুলি বানিয়ে তা দিয়ে গৃহদেবতার অর্চনা করতেন। যার মধ্যে অন্যতম হলো ভাপা, পাটিসাপটা, দুধ চিতই, মুগ পুলি আর মালপোয়া। তারই সঙ্গে উঠোনে তুলসী বেদীর নীচে নতুন চালের গুঁড়ো দিয়ে নানান আকৃতির পিঠে এঁকে সূর্য নারায়ণকে নিবেদন করা হতো। সংকীর্তনের দল বাড়ি বাড়ি এসে হরির লুট দিতেন সঙ্গে থাকত মাধুকরী। লুটের সবচেয়ে বড়ো প্রাপ্তি হতো গোটা ফল, বাতাসা কিংবা কদমা। আর মাধুকরীর চাল, আনাজ, ফল এবং প্রাপ্ত দক্ষিণা সব একত্রিত করে অন্নভোগের আয়োজন করা হতো। এই আয়োজনের দায়িত্ব থাকত কীর্তনের শেষ লুটদানকারী বাড়ির উপর। কারন সেই বাড়িতেই ভোগ রান্না, নাম কীর্ত্তন ও অন্নভোগ ঠাকুরকে নিবেদন করে সবাইকে প্রসাদ বিতরণ করা হতো। এই আয়োজনেও ছিল বিভিন্নতা। যেমন কেউ একে হরি সেবা বলতেন, কেউ নরণারায়ন সেবা, আবার কেউ বালক সেবা। বালক সেবায় আগে কিশোর ছেলেদের একসাথে বসিয়ে প্রসাদ খাইয়ে তারপর বাকিদের প্রসাদ দেওয়া হতো।আবার অনেকের বাড়িতে এইদিনে পালিত হয়ে আসছে লক্ষ্মী পুজো। উঠোনে অশ্বত্থ, খেজুর কিংবা কচু পাতা ইত্যাদি লাগিয়ে তার নীচে নতুন চালের পায়েস ও পিঠে দিয়ে লক্ষ্মী পুজো করা হতো।
অন্যদিকে এই পুণ্য দিনে বহু জাতি-জনজাতি মানুষ তাদের স্বর্গত আপনজনদের অস্থি পুণ্যতোয়া গোমতীর জলে বিসর্জন দিতে সমবেত হয় গোমতী জেলার ডুম্বুরে আয়জিত তীর্থমুখের মেলায়। রাজ্য সরকার আয়োজিত এই ঐতিহ্যবাহী মেলায় বহু পুণ্যার্থী পুণ্যস্নান করে তাদের পিতৃপুরুষের উদ্যেশ্যে তর্পণ ও শ্রাদ্ধ করে থাকে। কেউ কেউ পরিবারের কল্যান কামনায় দেবতার উদ্দেশ্যে বলিদান করে। কোথাও আবার সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বালানোর প্রচলন দেখা যায়।
ত্রিপুরার বিভিন্ন জনজাতি এই উৎসবকে নিজেদের সংস্কৃতির অংশ হিসেবে পালন করত। রাজন্য আমল থেকেই এই পার্বনের সঙ্গে জনজাতি মানুষেরা সম্পৃক্ত হয়। মূলত দেবতার আরাধনা এবং নৃত্যগীতের মাধ্যমে তারা আনন্দ প্রকাশ করত।যদিও অধুনিক ত্রিপুরায় পৌষ সংক্রান্তি সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে এর উদযাপনের ধরনেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। শহরাঞ্চলে এই উৎসব এখন মূলত পারিবারিক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ এবং ছোটদের আয়োজনের চাইতে এর আকার বেড়েছে অনেক বেশী। যেখানে এর মূল ভিত্তির সন্ধান পাওয়া বেশ কঠিন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পিকনিকের নামে অতি উল্লাস আর মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণে তিক্ততার উদাহরন বাড়ছে ক্রমাগত। তবে এখনো কিছু জায়গায় পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে মেলা বসে, যেখানে স্থানীয় হস্তশিল্প, খাদ্যপণ্য এবং লোকসংগীতের পরিবেশনা হয়। পার্বনের আগের দিন রাজ্যের বহু জায়গায় বাড়ির উঠোন সেজে উঠে মনোরম আলপনায়। কেউ কেউ মজা করে উঠোনে লিখে থাকে ' সূর্য ঠাকুর পিঠে খাও'। নৃত্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এখনো কিছু কিছু অঞ্চলে টিকে আছে। যেমন সেকেরকোটে অবস্থিত 'অর্কনীড়ে' পৌষ পার্বণে আয়োজিত হয় পিঠে- পুলি উৎসব এবং হস্ত- কারু শিল্পের প্রদর্শনী। তবে তরুণ প্রজন্মের অনেকের মধ্যেই আধুনিক বিনোদন মাধ্যম গুলোর ব্যাপক প্রভাবে এই উৎসবের প্রতি আকর্ষণ কমছে। যদিও পৌষ সংক্রান্তি শুধু একটি ঐতিহ্যগত উৎসব নয়; এটি সমাজের ঐক্য, সম্প্রীতি ও সংস্কৃতির ধারক। তাই এই উৎসবের প্রচার ও সংরক্ষণ জরুরি। প্রশাসন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো যদি আরো বেশি উদ্যোগ নেয়, তাহলে নতুন প্রজন্মের কাছে এই ঐতিহ্যকে আকর্ষণীয় করে তোলা সম্ভব। আধুনিকায়নের ফলে উৎসবের অনেক কিছু বদলে গেলেও, এর মূল ভাবনা ও চেতনা এখনো বেঁচে আছে। সঠিক প্রচেষ্টা ও সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণের মাধ্যমে এই উৎসবকে আগামীর জন্য সংরক্ষণ করা সম্ভব।
আরও পড়ুন...