রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ত্রিপুরা সফর
অভিষেক ভৌমিক
October 13, 2025
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ত্রিপুরা সফর ভারতের সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাসে একটি বিশেষ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। রবীন্দ্রনাথ শুধু একজন কবি বা সাহিত্যিক ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন চিন্তাবিদ, সমাজসংস্কারক এবং সাংস্কৃতিক দূত। তাঁর ভ্রমণগুলি কেবল পর্যটন বা অবকাশ কাটানোর উদ্দেশ্যই নয়, বরং তিনি প্রতিটি সফরের মাধ্যমে স্থানীয় সমাজ, সংস্কৃতি, প্রশাসন এবং মানুষের জীবনধারা পর্যবেক্ষণ করতেন। ত্রিপুরার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কের মূল ভিত্তি স্থাপিত হয় ত্রিপুরার রাজপরিবারের সঙ্গে। বিশেষ করে রাজা বীরচন্দ্র মানিক্য বাহাদুর এবং তাঁর উত্তরসূরীরা রবীন্দ্রনাথকে আন্তরিকভাবে সমাদর করতেন। এই সম্পর্ক কেবল ব্যক্তিগত আতিথ্যের সঙ্গে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তা ত্রিপুরার সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
রাজা বীরচন্দ্র মানিক্য বাহাদুর ছিলেন ত্রিপুরার একটি সময়ের অন্যতম শক্তিশালী ও প্রভাবশালী শাসক। তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা ‘ভগ্ন হৃদয়’ পড়ে গভীরভাবে প্রভাবিত হন। এই কবিতাটি তাঁর প্রিয় রাণী ভানুমতীর মৃত্যু পরবর্তী শোকমুক্তির জন্য সাহায্য করেছিল। এই ঘটনার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে রাজপরিবারের সম্পর্কের সূচনা ঘটে। পরবর্তীতে, রাজা বীরেন্দ্র কিশোর মানিক্য বাহাদুর, বীরচন্দ্রের পুত্র, রবীন্দ্রনাথের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা ও সাহিত্যকর্মের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতেন এবং ‘বিশ্বভারতী’ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নিয়মিত অনুদান প্রদান করতেন। ১৯১৯ সালে, রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর, রাজা বীরেন্দ্র কিশোর ত্রিপুরায় একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করেন, যেখানে রবীন্দ্রনাথকে বিশেষভাবে সম্মানিত করা হয়।
রবীন্দ্রনাথের ত্রিপুরা সফর বিভিন্ন পর্যায়ে সংঘটিত হয়। সর্বশেষ সফরটি ঘটে ১৯২৬ সালে, যখন তিনি রাজা বীরবিক্রম কিশোর মানিক্য বাহাদুরের আমন্ত্রণে আগরতলায় আসেন। রাজা বীরবিক্রম কিশোর ঠাকুরকে ‘Pushpabanta Palace’-এ অবস্থান করার সুযোগ প্রদান করেন, যা তাঁর পিতার আমলে ১৯১৭ সালে নির্মিত হয়। এই সফরের সময়, রাজা বীরবিক্রম ঠাকুরকে ‘ভারত ভাস্কর’ উপাধি প্রদান করেন, যা ত্রিপুরার রাজপরিবার ও রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কের গুরুত্ব এবং রাজ্যের সংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রতি উৎসাহের প্রমাণ হিসেবে ধরা হয়।
ত্রিপুরার রাজপরিবার এবং রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক শুধুমাত্র ব্যক্তিগত নয়, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। রাজা বীরেন্দ্র কিশোর মানিক্য বাহাদুরের আমলে ত্রিপুরায় সংস্কৃতির বিকাশে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। তিনি শান্তিনিকেতনে রাজকুমার বুদ্ধিমান সিংহকে মণিপুরি নৃত্য শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন, যা ত্রিপুরার লোকনৃত্য ও শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ প্রভাব ফেলে। এছাড়াও, ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের ৮০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে রাজা বীরবিক্রম বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিলেন। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ত্রিপুরার রাজপরিবার রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাদের সমর্থন এবং শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের ত্রিপুরা সফরের সময় তিনি শুধু রাজপরিবারের অতিথি ছিলেন না, বরং স্থানীয় জনগণের জীবনধারা, গ্রামীণ অর্থনীতি, কৃষিকাজ এবং সামাজিক কার্যক্রমও পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তিনি দেখেছেন যে ত্রিপুরার গ্রামীণ জনগোষ্ঠী কিভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জীবন পরিচালনা করছে। বিশেষ করে ককবরক এবং অন্যান্য উপজাতীয় সম্প্রদায়ের জীবনধারা, তাদের আচার-অনুষ্ঠান, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক ও উৎসবগুলো তাঁর পর্যবেক্ষণে এসেছে। তিনি স্থানীয় বিদ্যালয়, পাঠশালা এবং শিক্ষার মানও পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, যা তাঁর শিক্ষার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমাজসংস্কারের চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করেছে।
ত্রিপুরার ভৌগোলিক অবস্থানও রবীন্দ্রনাথের পর্যবেক্ষণের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। পাহাড়ি ও নদীমুখী অঞ্চল, নদী তীরবর্তী বসতি, বনাঞ্চল, এই পরিবেশ গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত ছিল। তিনি দেখেছেন যে এই পরিবেশ কিভাবে স্থানীয় অর্থনীতি, চাষাবাদ ও অন্যান্য সামাজিক কার্যক্রমে প্রভাব ফেলে। এই পর্যবেক্ষণগুলি তার সাহিত্যকর্ম এবং সামাজিক চিন্তায় পরবর্তীতে প্রভাবিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের ত্রিপুরা সফর ত্রিপুরার ইতিহাস, সংস্কৃতি ও প্রশাসনের ওপরও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। রাজপরিবারের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থানীয় সমাজে সংস্কৃতির বিকাশ এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে। রাজা বীরেন্দ্র কিশোর এবং রাজা বীরবিক্রমের আমলে ত্রিপুরার প্রশাসন ও শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়নের দিকে বিশেষ মনোযোগ প্রদান করা হয়। রবীন্দ্রনাথ এই সব পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে দেখেছেন যে কিভাবে প্রশাসন, সমাজ এবং সংস্কৃতি একত্রে একটি অঞ্চলের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন নির্ধারণ করে।
রবীন্দ্রনাথের ত্রিপুরা সফর শুধুমাত্র সাহিত্যিক বা সাংস্কৃতিক দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এটি তথ্যভিত্তিক এবং ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকেও মূল্যবান। এই সফরের মাধ্যমে তিনি ত্রিপুরার রাজপরিবারের প্রশাসনিক কাঠামো, সামাজিক আচরণ, শিক্ষা ও অর্থনীতির বিভিন্ন দিক পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছেন। এছাড়া স্থানীয় জনগণের জীবনধারার বিশ্লেষণ এবং সাংস্কৃতিক প্রথার সঙ্গে পরিচিত হওয়া তাঁর সমাজচিন্তা ও গবেষণার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করেছে।
আজও ত্রিপুরার বিভিন্ন স্থানে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিচিহ্ন বিদ্যমান, যা তার ও ত্রিপুরার রাজপরিবারের সম্পর্কের সাক্ষ্য বহন করে। Pushpabanta Palace এবং অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থানগুলো ত্রিপুরার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অঙ্গ হিসেবে সংরক্ষিত রয়েছে। ইতিহাসবিদরা রবীন্দ্রনাথের ত্রিপুরা সফরের তথ্যভিত্তিক পর্যবেক্ষণকে স্থানীয় ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। এই সফর আমাদের শেখায় কিভাবে একজন চিন্তাবিদ বা গবেষক তথ্যভিত্তিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে একটি অঞ্চলের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রশাসনিক চিত্র তুলে ধরতে পারেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ত্রিপুরা সফর কেবল সাহিত্যিক অভিজ্ঞতা বা ব্যক্তিগত সফর হিসেবে নয়, বরং এটি ত্রিপুরার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে একটি তথ্যভিত্তিক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত। রাজপরিবারের সঙ্গে তার সম্পর্ক এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনধারার পর্যবেক্ষণ ত্রিপুরার ইতিহাস ও সংস্কৃতির গবেষণার জন্য গুরুত্বপূর্ণ উৎস হয়ে উঠেছে। এই সফরের মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে সাহিত্য, সংস্কৃতি, প্রশাসন এবং সামাজিক জীবন একত্রিত হয়ে একটি অঞ্চলের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে গঠন করে।
আরও পড়ুন...