শচীন দেববর্মণ ও ত্রিপুরার রাজপরিবার
পান্নালাল রায়
October 1, 2025
রাজার পর সাধারণত রাজপুত্রই সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হন। কিন্তু মাঝে মাঝে এর ব্যতিক্রমও ঘটে।আর এই ব্যতিক্রমী ঘটনার সূত্রেই একদিন ত্রিপুরা যাকে হারিয়েছিল পরবর্তী সময়ে তিনিই হয়ে উঠেছেন দেশবন্দিত সুরকার।
১৮৬২ সালের আগষ্ট।মাত্র ৩৪ বছর বয়সে মৃত্যু ঘটল পক্ষাঘাতে আক্রান্ত ত্রিপুরার রাজা ঈশানচন্দ্র মাণিক্যের। মৃত্যুর দুদিন পরে ত্রিপুরার রাজ সরকারের বিভিন্ন কার্যালয়ে পৌঁছে গেল এক 'রোবকারী'। তাতে পক্ষাঘাতে পীড়িত মহারাজা তাঁর ভাই বীরচন্দ্র ঠাকুরকে 'যুবরাজ' এবং প্রথম পুত্র ব্রজেন্দ্র চন্দ্র ঠাকুরকে 'বড়ঠাকুর' ও দ্বিতীয় পুত্র নবদ্বীপ চন্দ্র ঠাকুরকে 'বড়কর্তা' পদে নিয়োগ করেছেন। এবার এই 'রোবকারী' নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হল রাজধানী আগরতলায়।কেউ বললেন এটি জাল। আবার কেউ বললেন সঠিক, মৃত্যুর আগেরদিন রাজা স্বহস্তে রোবকারীতে স্বাক্ষর করেছেন!
যাইহোক,বীরচন্দ্রের সিংহাসনে আরোহণের পথ নিষ্কন্টক ছিল না।রাজার অন্য ভাইরা এর বিরুদ্ধে মামলা মোকদ্দমা করলেন ইংরেজ আদালতে। মামলার নিষ্পত্তি ঘটল দীর্ঘদিন পর। জয়ী হলেন বীরচন্দ্র। শক্তপোক্ত হয়ে বসলেন সিংহাসনে। কিন্তু এরমধ্যে ঈশানচন্দ্রের প্রথম পুত্র ব্রজেন্দ্র চন্দ্রের মৃত্যু ঘটেছে।সাবালক হয়ে উঠেছেন দ্বিতীয় পুত্র নবদ্বীপ চন্দ্র। কথা ছিল মামলায় জয়ী হলে বীরচন্দ্র যুবরাজ করবেন নবদ্বীপ চন্দ্রকে। কিন্তু তা বাস্তবায়িত হলনা।ফলে আবার মামলা মোকদ্দমা। এবার সিংহাসনে আসীন রাজার বিরুদ্ধে মামলা করলেন রাজার ভ্রাতুষ্পুত্র নবদ্বীপ চন্দ্র। কিন্তু তাতেও জয়ী হলেন বীরচন্দ্র। অবশেষে রাজধানী আগরতলা ত্যাগ করে নবদ্বীপ চন্দ্র তাঁর মাকে নিয়ে চলে গেলেন কুমিল্লায়। এসম্পর্কে ঐতিহাসিক কৈলাস চন্দ্র সিংহ তাঁর সুবিখ্যাত গ্ৰন্হ'রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস'-এ লিখেছেন-"প্রায় এক বৎসর তিনমাস কাল নানা প্রকার যন্ত্রণা ও কষ্ট ভোগ করিয়া কুমার নবদ্বীপ চন্দ্র ১২৮১ ত্রিপরাব্দের(১৮৭১ খ্রীঃ)আষাঢ় মাসের প্রথম ভাগে স্বীয় মাতাকে লইয়া দীন হীনের বেশে কুমিল্লায় উপস্হিত হইলেন।" উল্লেখ করা যায় যে, কুমিল্লা ছিল তখন ত্রিপুরার রাজার চাকলা রোশনাবাদের জমিদারীর সদর। নবদ্বীপ চন্দ্র এবার পাকাপাকি ভাবে কুমিল্লাতেই বসবাস করতে থাকেন। ঊর্ধ্বতন ইংরেজ আধিকারিকের হস্তক্ষেপে মহারাজা বীরচন্দ্র অবশ্য নবদ্বীপ চন্দ্রের জন্য মাসিক ৫২৫ টাকা বৃত্তি মঞ্জুর করেছিলেন।এই নবদ্বীপ চন্দ্রের পুত্রই হলেন ভারত বিখ্যাত এস ডি বর্মণ, ত্রিপুরায় যার পরিচিতি শচীনকর্তা।
জীবনের শেষ পর্বে নবদ্বীপ চন্দ্র ডাক পেলেন আগরতলা থেকে। তখন ১৯০৯ খ্রীঃ। ত্রিপুরার রাজা বীরেন্দ্র কিশোর মাণিক্য।এক ঘোষণায় তিনি নবদ্বীপ চন্দ্রকে রাজমন্ত্রী করে নিয়ে এলেন আগরতলাতে।পুত্র শচীনের শৈশব, কৈশোর কেটেছে কুমিল্লাতেই।প্রথম থেকেই তিনি সঙ্গীত পাগল। তাঁকে কাছে টানে উদাস বাউলের সুর আর নদী নালার মাঝি মাল্লারের গান। পরবর্তী সময়ে শচীন দেববর্মণ তাঁর আত্মজীবনীতে বলেছেন,"...মার্গ সঙ্গীতের সঙ্গে সঙ্গে আমার মন গ্ৰাম্য সঙ্গীতের দিকে ঝুঁকে গেল।... আমাদের বাড়িতে বাউল, ভাটিয়ালী গাইয়ে,গাজন-গান ও কালীনাচের গাইয়ে,ফকির বোষ্টম দূরের গ্ৰাম থেকে সর্বদাই আসত। তাদের গানে আমি অভিভূত হয়ে যেতাম।..."
শৈশবেই পুত্রের মধ্যে সঙ্গীত প্রতিভার আঁচ পেয়েছিলেন পিতা। একবার সরস্বতী পূজার দিনে স্কুলে গান গেয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন শচীন। পিতা চাইলেন পুত্র উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নিক উপযুক্ত গুরুর কাছে। কিন্তু বাংলার মেঠো সুর তখন প্রবল ভাবে কাছে টানছে কুমার শচীনকে। পড়াশোনার পাশাপাশি কুমিল্লাতে চলতে থাকল তাঁর সুরের সাধনাও।
বিএ পাশ করার পর উচ্চ শিক্ষার জন্য নবদ্বীপ চন্দ্র পুত্রকে নিয়ে এলেন কলকাতায়। কিন্তু পড়াশোনা আর হলনা। সঙ্গীতের মধ্যেই ডুবে থাকলেন শচীন।তালিম নিলেন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতেরও। নিজেকে সমৃদ্ধ করে তুললেন। একদিন বেতারে গান গাওয়ার সুযোগ পেলেন তিনি।জীবনকথায় শচীন দেববর্মণ লিখেছেন-"আমার নিজের সুর সংযোজনায় দু-খানা গান গাইলাম। পারিশ্রমিক পেলাম দশ টাকা। আমার জীবনের প্রথম উপার্জন।লক্ষ টাকার থেকেও বেশি মনে হয়েছিল।"একদিন রেকর্ড বের হল শচীনকর্তার।প্রথম রেকর্ড বের হয় হিন্দুস্হান রেকর্ড কোম্পানি থেকে।এক পিঠে ছিল রাগপ্রধান গান ' এ পথে আজ এসো প্রিয়া '। রেকর্ডের অপর পিঠে ছিল লোকগীতি 'ডাকলে কোকিল রোজ বিহানে'। রেকর্ডটি বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে।আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি শচীনকর্তাকে।লোক আর রাগ সঙ্গীতের মিশেলে তিনি সৃষ্টি করলেন এক নতুন শৈলী। হয়ে উঠলেন শচীন দেববর্মণ। বাংলা ও বাঙালির প্রিয় গায়ক। কলকাতায় সঙ্গীতানুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ তখন তিনি।
একদিন মুম্বাই থেকেও ডাক পেলেন শচীনকর্তা। সেখানেও যেন বাংলার মেঠো সুরের যাদু। বিভিন্ন হিন্দি চলচ্চিত্রের গানে নিপুণ দক্ষতায় তিনি ব্যবহার করলেন এই সুর। শ্রোতারা মুগ্ধ।হিন্দি ফিল্মী গানে তখন যেন এস ডি বর্মণ এক নতুন ঠিকানা, তাঁর একচ্ছত্র আধিপত্য। এভাবেই তিনি হয়ে ওঠেন দেশের সঙ্গীত জগতের মধ্যমণি। জীবদ্দশাতেই যেন এক কিংবদন্তি।
এবার আসা যাক আগরতলা তথা ত্রিপুরার সঙ্গে শচীন কর্তার সম্পর্কের কথায়। মুম্বাইতে যাওয়ার পর স্বাভাবিক ভাবেই ত্রিপুরার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে এসেছিল। রাজপরিবারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়েও সাধারণ্যে ধোঁয়াশা।কেউ বলেন তাঁর বাবার রাজা হবার কথা ছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত রাজধানী ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল কুমিল্লায়।এই রাগ অভিমান মনের মধ্যে পুষে রেখেছিলেন শচীন কর্তা। আবার কেউ কেউ তাঁর বিয়ের কথা বলেছেন। মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর মানিক্য বাহাদুরের পুত্র মহারাজ কুমার সহদেব বিক্রম কিশোর প্রায় দুই দশক আগে আমায় বলেছিলেন,শেষের দিকে তিনি রাজপরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চাননি বলেই মনে হয়।শচীন কর্তার বিয়ের ব্যাপারে রাজপরিবারের অনেকেই অসন্তুষ্ট ছিলেন এটা ঘটনা। উল্লেখ করা যায় যে,শচীন কর্তা তাঁর ছাত্রী মীরা দেবীকে বিয়ে করেছিলেন। এদিকে প্রায় চার দশক আগে ত্রিপুরার বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক মহেন্দ্র দেববর্মা লিখেছেন-" এ নিয়ে রাজদরবারে কথা উঠে। কোনো রাজকন্যা বা ক্ষত্রিয় বংশের রাজ আত্মীয়াকে বিয়ে না করে তিনি সাধারণ 'ধর' পরিবারের কন্যার পানিগ্ৰহণ করাতে নাকি ত্রিপুরার রাজবংশের মর্যাদা হানি হয়েছে।..." আগরতলার সঙ্গে কুমার শচীন দেববর্মণের সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার এটিও একটি কারণ বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।
কুমিল্লাতেই কুমার শচীন দেববর্মণের বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা। কিন্তু আগরতলার সঙ্গে ছিল নিবিড় সম্পর্ক। মাঝে মাঝে তিনি আগরতলায় আসতেন। রাজ্যেশ্বর মিত্র এক লেখায় জানিয়েছেন যে, তিনি শচীনকর্তাকে আগরতলাতে সাধারণের ব্যবহৃত পথেঘাটে হেঁটে বেড়াতে দেখেছেন। রাস্তার লোকজন কর্তার জন্য সসম্ভ্রমে সরে দাঁড়ালেও তিনি কিন্তু কারো দিকে অবহেলার দৃষ্টিতে তাকাননি।আগরতলায় ফুটবল মাঠে রেফারিও থাকতেন তিনি। সঙ্গীত চর্চায় বিরতি ছিলনা এখানেও। রাজপরিবারের কারো কারো বাড়িতে সাহেব আলী নামে এক জন লোকশিল্পী গান শোনাতে আসতেন। শচীন কর্তা গভীর আগ্রহে তাঁর গান শুনতেন। কিছু কিছু লিখেও রাখতেন। কলকাতা অবস্থান কালেও শচীন কর্তার সঙ্গে আগরতলার যোগাযোগ একেবারে ছিন্ন হয়নি।
রাজপরিবারের অপর এক সদস্য পূর্ণেন্দু কিশোর দেববর্মণ প্রায় দুই দশক আগে আমায় বলেছিলেন, একবার অসুস্থ অবস্থায় কাকি মীরা দেবীকে দেখতে গিয়েছিলেন কলকাতায়। তখন রাহুলকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ত্রিপুরায় আসার কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন অনেক ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। সেসবের অবসান প্রয়োজন।কাকির সেই কথায় খুবই আন্তরিকতা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর আর ত্রিপুরায় আসা হয়নি।
অভিমান করে নয়,সুরের সাধনাই তাঁকে প্রথমে কলকাতা এবং পরে মুম্বাই নিয়ে গিয়েছিল। পিতা পড়ার জন্য নিয়ে গেলেন কলকাতা। সেখানেও সঙ্গীত সাধনা।খোলে গেল এক বিপুল সম্ভাবনার দিগন্ত।বাংলার মন জয়ের পর আকৃষ্ট হল মুম্বাই।আরব সাগরের তীরে জীবনের শেষ অধ্যায়ে সাফল্যর শীর্ষে তিনি।ত্রিপুরার রাজপরিবারের কুমার শচীন হয়ে উঠলেন দেশের এস ডি বর্মণ।
মান অভিমান যাই থাক জীবনের অন্তিম পর্বেও যে হৃদয়ে ত্রিপুরাই ছিল তাই যেন তাঁর লেখাতেও ধরা পড়েছে। জীবন কথায় তিনি লিখেছেন -"... ত্রিপুরার ধানের ক্ষেতে চাষীরা গান গাইতে গাইতে চাষ করে, নদীর জলে মাঝিরা গানের টান না দিয়ে নৌকা চালাতে জানে না,জেলেরা গান গেয়ে মাছ ধরে, তাঁতিরা তাঁত বুনতে বুনতে আর মজুররা পরিশ্রম করতে করতে গান গায়। সেখানকার লোকদের গানের গলা ভগবৎ-প্রদত্ত। আমি সেই ত্রিপুরার মাটির মানুষ-তাই বোধহয় আমার জীবনটাও শুধু গান গেয়ে কেটে গেল। সঙ্গীত আমার 'ফার্স্ট লাভ'।..."
আরও পড়ুন...