বদলে যাওয়া বিশ্বে স্তব্দ জীবনের জয়গান

প্রদীপ চক্রবর্তী

প্রত্যাশা ছিল, নতুন দশক ফেলে আসা দিন বদলে দেবে। মানুষ গাইবে জীবনের জয়গান, যে জয়গান হবে মানুষ মানুষের জন্য। কিন্তু না, হলো না,সব কিছু বদলে গেল,স্বপ্ন থমকে গেল। স্বপ্ন হয়ে দাঁড়াল দুঃস্বপ্নে। মুহূর্তে মুহূর্তে ঝটকায় ঝড়ে পড়ছে প্রান। এতো প্রত্যাশিত ছিল না। যদিও প্রত্যাশা সবসময় পূরন হয় না। এও এক গনিত। বেঁচে থাকার সংগ্রামের নিরন্তর গনিত, গবেষণা।

বিশ্বের প্রত্যাশা ছিল নুতন দশক আসবে পরিবর্তিত রূপে। নুতন ভাবে নতুন রুপে আসবে জাতীয়তাবাদ, সামাজিক মাধ্যম দ্রুত বিস্তার হবে, সমাজ জীবনে নিয়ে আসবে ঝলমলে দিনের সাত রঙা রামধনু। অবসান হবে শরনার্থী স্রোত, সমস্যার। যবনিকাপাত হতে পারে সিরিয়ার যুদ্ধ। ব্রেক্সিট হয়ে উঠতে পারে পরিবর্তিত রুপ। কিন্তু না,হল না। সবকিছু তছনছ হয়ে গেল বা মিনিটে মিনিটে হচ্ছে তছনছ,একের পর এক প্রান সংহার করে চলেছে ভয়ংকর করোনা। এতো এক নুতন মহামারী।গত এক শতকে বিশ্ববাসী দেখেছে সাত মহামারী আর নুতন দশকে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ বিস্তার মহামারী। এই মহামারী অব্যাহত। কবে থামবে তার কোন নিশ্চয়তাই নেই, আছে শুধু মুহূর্তে মুহূর্তে দূঃসংবাদ। প্রান ছিনিয়ে নিয়ে চলেছে করোনা। টলমল বিশ্বের মানব সভ্যতা। এর অস্তিত্ব নিয়ে টান ধরেছে, তবু আমরা এখনো লড়াই সংগ্রাম করে আছি, কতক্ষণ থাকব, তার নিশ্চয়তা নেই। আকাশজুড়ে ঘন কালো মেঘ,বজ্রবিদ্যুতের দাবড়ানি। কবে শান্ত হবে বিশ্বপ্রান, তাই এখন বড় প্রশ্ন।

দিনটি ছিল ৩১ শে ডিসেম্বর। সন ২০১৯। ঘড়ির কাঁটা তখন দুপুর ১ টা ৩৮ মিনিট। চীনের সরকারি ওয়েব সাইট জানাল নিউমোনিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। তবে সেটি অজ্ঞাত। এই নিউমোনিয়ায় মানুষ সংক্রামিত হচ্ছে এবং খুব দ্রুত সংক্রমণ ঘটছে। এর বিশেষ কিছু বিশ্ববাসী জানতে পারেনি বা জানানোও হয়নি তেমন ভাবে।সেই থেকেই শুরু। এখনতো বিশ্বজুড়ে স্হবির হয়ে পড়া জীবন, বিশ্ববাসী ঘরবন্দী। জীবনের চলার ছন্দ হারিয়ে যাচ্ছে,বলতে বলতে থেমে যাচ্ছে জীবন। সর্বত্র শুধু শূন্যতা, রাস্তাঘাট জনশুন্য, সবকিছু খাঁ খাঁ। নুতন বছর পালনের আলোর রোশনাই সব থেমে গেছে।

২০২০ এর প্রথম দিন ১লা জানুয়ারি বেজিং থেকে জানানো হয় এঁরা কিছু সন্দেহ জনক ভাইরাসের নমুনা উহানের সামুদ্রিক খাবারের বাজার থেকে সংগ্রহ করেছে। আরো জানানো হয় যে প্রতিদিন অশুভ সব লক্ষন নিয়ে রোগী আসছেন, এবং এরা ভর্তি হচ্ছেন। সরকারী মাধ্যমে সতর্কবার্তা দিয়ে জানানো হয়,বলা হয় যে সবাই যেন সতর্ক থাকেন। এই সতর্কবার্তার পর তাইওয়ান বিষয়টি খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখে। এরা উহান থেকে যেসব উড়ান আসে তার যাত্রীদের পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করে, নজরদারি শুরু করে হংকং ও সিঙ্গাপুর সীমান্তে। বিমানবন্দরেও সতর্কতা নেয়া শুরু হয়।

চীনের বিশিষ্ট চিকিৎসক লি ওয়েনলিয়াং সহকর্মীদের কাছে পাঠানো বার্তায় জানান তিনি সার্সের মত একটি ভাইরাস সনাক্ত করতে পেরেছেন। এই কথা বলে তিনি বিপদে পড়ে যান,তার কাছ থেকে একটি হলফনামা লিখিয়ে নেন।

দশ দিন বাদেই চীনা বিজ্ঞানীরা বলেন নুতন ভাইরাস মারাত্মক। এই ভাইরাস সার্স ও মার্স ভাইরাসের সংমিশ্রণ। ইতিমধ্যে একজনের মৃত্যু হয়েছে। চীনের বিজ্ঞানীরা কিন্তু ইতিমধ্যেই জেনেটিক সিকোয়েন্স ও বের করে গবেষনা শুরু করে। কিন্তু দ্রুত বিস্তার করতে শুরু করে এই ভাইরাস। দেখা যায় সাতদিনের সংক্রমণ দ্বিগুণ হয়ে চলেছে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন চিকিৎসক লি ওয়েনলিয়াং।

কিন্তু অবাক কান্ড প্রায় দশদিন ধরে চিন কোন তথ্য জানায় নি। বরং তাঁরা নীরব ছিল। যখন জানাজানি শুরু হয় ততদিনে এটি মারাত্মক আকার ধারণ করে। লন্ডনে ডাকা হয় সম্মেলন। বলা হতে থাকে বৃটেনে সংক্রমণের ঝুঁকি প্রায় নেই।

বেজিং বলতে শুরু করে ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়না। বা তাদের কাছে এমন প্রমান ও নেই। সিনহুয়া জানায় এই করোনা ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না। কোন চিকিৎসক এতে আক্রান্ত ও হননি।

বেজিং তাই বলতে থাকুক উহান প্রদেশে মারনব্যাধির বিস্তার লাভ করতে থাকে। হাসপাতালে রোগীদের ভীড় উপচে পড়তে থাকে। দেখা যায় যাদের সিফুড মার্কেট এর সাথে সম্পর্ক নেই তাঁরা ও এই ভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে ভর্তি হয়েছেন।

২০ শে জানুয়ারি চীনের সরকারি টেলিভিশন সম্প্রচারে বলেন করোনা ভাইরাস সংক্রমণ বিস্তার মানুষের সংস্পর্শে ও হয়। কয়েক জন রোগী তাঁরা পেয়েছেন। এই সম্প্রচারের পর বিশ্ব অবাক হয়ে দেখল ভাইরাস সংক্রমণ দ্রুত বিস্তার লাভ করছে, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, বেজিং, সাংহাইয়ে করোনা ছড়িয়ে পড়েছে। ততক্ষণে উহানের পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। হাসপাতালের সামনে দীর্ঘ লাইন। সবাই সংক্রামিত।

ডোনাল্ড ট্রাম্প করোনা নিয়ে প্রথম জানতে পারেন যেদিন এক মার্কিন যুবক জ্বর নিয়ে উহান থেকে ফেরেন সেদিন। উহান থেকে ফিরেই সে ওয়াশিংটন হাসপাতালে ভর্তি হন।

ইতিমধ্যেই এটি ভয়ংকর ভাবে বিস্তার লাভ করতে থাকে। উহানেই ২৫ জনের মৃত্যু হয়। সনাক্ত হয় প্রায় একহাজার। ইউরোপ জুড়ে যখন ছড়িয়ে পড়তে থাকে তখন চিনের প্রেসিডেন্ট পরিস্হিতির ভয়াবহতার কথা স্বীকার করতে বাধ্য হন। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন চিকিৎসক লিয়াং উডং। তিনি প্রথম চিকিৎসক যিনি করোনায় প্রান হারান। ওই সময় কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প করোনা নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা বলেন। ৩১ শে জানুয়ারি অর্থাৎ ভাইরাস সংক্রমণের ৩১ দিন। ততদিনে চীনে ২৫৮ জনের মৃত্যু হয়। সংক্রামিত হয়ে পড়ে প্রায় ১২ হাজার। তাও আবার চীনেই। ভয়াবহতা আঁচ করে ওয়াশিংটন চীনাদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

চীনে কিন্তু আক্রান্তের সংখ্যা যেমন বাড়তেই থাকে তেমনি মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে হয় ৪৩০ জন। ম্যানিলায় শুরু হয় মৃত্যু।

যখন দ্রুত বিস্তার বাড়ছে তখন হু বলে এই বিস্তার ধীরগতির। কিন্তু লি ওয়েনলিয়াং ,তিনি প্রথম ভাইরাসের কথা বলেছিলেন তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুতে সর্বত্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তবু ডোনাল্ড ট্রাম্প বলতেই থাকেন সব ঠিক হয়ে যাবে। গরমে আর সমস্যা থাকবেই না। অদ্ভুত সব ব্যাপার। ১৯ শে ফেব্রুয়ারি আরো অনেক লোক আক্রান্ত হয়ে পড়েন। দক্ষিণ কোরিয়া,ইরানের পর গোটা বিশ্বে সংক্রামিতের সংখ্যা ৮০ হাজারের বেশি পৌঁছে যায়। চীনের পর ইতালী লকডাউন করে। ৬ ই মার্চ জানানো হয় ইতালিতে প্রতিদিন গড়ে ১২০০ আক্রান্ত হচ্ছেন।

১১ ই মার্চ ট্রাম্প ঘোষনা করতে বাধ্য হন যে যুক্তরাষ্ট্র স্ংক্রমন রোধে আগ্রাসী ব্যবস্হা নিচ্ছে। ততদিনে বিশ্বজুড়ে আক্রান্ত প্রায় ২ লাখের বেশি। ইতালিতে একদিনে ১৬৮ জনের মৃত্যু হয়। ভয়াবহতা দেখে হু করোনা ভাইরাস সংক্রমণ বিস্তার কে মহামারী হিসাবে ঘোষনা করে। যুক্তরাজ্যে লকডাউন করাহয়। সীমান্ত বন্ধ করে দেয় ইউরোপ। ইতালিতে দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা ৫০৯ রং কাছাকাছি দাঁড়ায়।১৭ ই মার্চ পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে আক্রান্ত ১ লাখ ৬৫ হাজার।২৩ শেষ মার্চ আক্রান্ত র সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ লাখ ৮০ হাজারের মতো।স্পেনে একদিনে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় ৪০০। মাত্র সাতদিনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি করোনা রোগী সনাক্ত হয়।

আমাদের দেশেও বাড়তেই থাকে আক্রান্তের সংখ্যা। তিন সপ্তাহের লকডাউন ঘোষনা করা হয়েছে। ১৪ ই পর্যন্ত থাকবে। তবে এর মেয়াদ বাড়তে পারে বলে আভাস।

জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী এখন পর্যন্ত বিশ্বে আক্রান্তদের সংখ্যা ১৫ লাখের উপর। মৃত্যু হয়েছে ৮২ হাজারের বেশি। ইতালিতে মৃত্যু হয়েছে ১৭,২২৭ জনের। তবে আশার কথা আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হয়েছেন ৩ লক্ষ তিন হাজারের বেশি মানুষ।

বিশ্ব এখন বলা চলে প্রায় লকডাউনে। ব্যস্ত জীবন প্রায় স্তব্দ। জীবন অনিশ্চিত। কখন করোনা কাকে থাবা বিস্তার করবে তাও অনিশ্চিত। বিশ্ববাসী কবে আবার সমন্বিত কন্ঠে জীবনের জয়গান গাইবে ?

( তথ্য কৃতজ্ঞতা: নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট ও হপকিনস ইউনিভার্সিটি)


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.