দুই মলাটে অক্ষরবন্দি অর্ধ শতাব্দী
পান্নালাল রায়
September 20, 2025
সাড়ে চার দশক আগে বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা ও দেশটির প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হবার সংবাদটি যদি এখন ফের চোখের সামনে আসে তবে পাঠকের অনুভূতিটা কেমন হবে? কিংবা পাঁচ দশক আগে দেশে জরুরী অবস্থা জারি ও বিরোধী নেতৃবৃন্দকে মিসায় গ্রেপ্তারের সংবাদ? এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ সংকলন করেছে ত্রিপুরার ঐতিহ্যবাহী দৈনিক পত্রিকা ত্রিপুরা দর্পণ,যাতে পাতায় পাতায় অক্ষরবন্দি রয়েছে অর্ধ শতাব্দী!
আগরতলা থেকে প্রকাশিত ত্রিপুরা দর্পণ পত্রিকাটি অর্ধ শতবর্ষ অতিক্রম করেছে ২০২৪ সালে। এই গৌরবোজ্জ্বল অর্ধ শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষ্যে এ ধরণের এক অভিনব সংকলন প্রকাশ করেছে তারা।বিগত অর্ধ শতাব্দীকাল ধরে ত্রিপুরা দর্পণ পত্রিকায় প্রকাশিত রাজ্য,জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ,সম্পাদকীয় ও নিবন্ধ স্হান পেয়েছে দুই মলাটে।তবে একসঙ্গে নয়,পৃথক পৃথক ছয়টি খণ্ডে ধরা হয়েছে পাঁচটি দশককে।প্রতিটি খণ্ডের পৃষ্ঠা সংখ্যা চারশোর কাছাকাছি বা তার একটু কম বেশি।এর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে পত্রিকাটিতে প্রকাশিত কার্টুন সমূহ নিয়ে রয়েছে একটি খণ্ড। সংকলনটির বিপুল আয়তন আর তার সুদীর্ঘ সময়কালের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি যে কতটা শ্রমসাধ্য তা অনুমান করতে অসুবিধা হয় না।বিগত পঞ্চাশ বছরে রাজ্য,দেশ ও আন্তর্জাতিক স্তরে কতই না ঘটনা ঘটে গেছে! তা থেকে বেছে বেছে সংবাদ,সম্পাদকীয়,নিবন্ধ নির্বাচন করে সংকলনে সন্নিবিষ্ট করা রীতিমত এক দুরূহ কাজ। এই সংকলন প্রকাশের উদ্দেশ্য সম্পর্কে পত্রিকাটির সম্পাদক সমীরণ রায় শুরুতেই বলেছেন যে, রাজ্য,জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে বিভিন্ন ঘটনাবলিকে দুই মলাটের মধ্যে গ্রন্হবদ্ধ করে চলমান ইতিহাসের ধারাকে পাঠক ও গবেষকদের কাছে উপস্থিত করাই এর উদ্দেশ্য। সংকলনের সহযোগী সম্পাদক হলেন দিব্যেন্দুশেখর দত্ত।
১৯৭৪ সালের ১৫ এপ্রিল প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল পত্রিকাটি।তবে তখন এর নাম ছিল 'জনযুগ'।বছর দুয়েক পর ১৯৭৬ সালের ১ জুলাই থেকে পত্রিকার নাম হয় 'ত্রিপুরা দর্পণ'। সংকলনের প্রথম খণ্ডের শুরুতে সম্পাদক সমীরণবাবু পত্রিকাটির জন্মবৃত্তান্ত থেকে তার বেড়ে ওঠা,প্রতিকূল পরিবেশের বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকা সমস্ত কিছু সবিস্তারে বিশ্বস্ততার সঙ্গে তোলে ধরেছেন। সুদীর্ঘকাল ব্যাপী পত্রিকাটি প্রকাশের কন্টকাকীর্ণ পথে যারা নিরলস ভাবে সহযোগিতা করে গেছেন তাদের প্রতিও আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন তিনি।
বিগত অর্ধ শতাব্দীর মধ্যে দেশ যেমন নানা রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের সম্মুখীন হয়েছে,তেমনই ব্যতিক্রম নয় ত্রিপুরাও।জাতীয় ক্ষেত্রে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকারের পতন,অকংগ্রেসী সরকার গঠন,ইন্দিরার প্রত্যাবর্তন,নিজ দেহরক্ষীর গুলিতে ইন্দিরার হত্যাকাণ্ড,রাজীব গান্ধী নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার,আবার অকংগ্রেসী সরকার,তারপর আবার কংগ্রেস,তারপর দুই বছরের মধ্যে তিনটি অকংগ্রেসী সরকার,বাজপেয়ী নেতৃত্বাধীন বিজেপি জোট সরকার, তারপর মনমোহন সিং নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার এবং বর্তমানে রয়েছে নরেন্দ্র মোদী নেতৃত্বাধীন বিজেপি জোট সরকার।ত্রিপুরাতেও জরুরী অবস্থা শেষে সুখময় সেনগুপ্ত নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকারের পতনের পর সিপিএমের সঙ্গে সিএফডি ও জনতা মিলে দুটি কোয়ালিশন,তারপর এক দশক বামফ্রন্ট, পরে পাঁচ বছর কংগ্রেস-উপজাতি যুব সমিতি জোট সরকার, তারপর আড়াই দশক এক নাগাড়ে বামফ্রন্ট, বাম শাসনের অবসানে বর্তমানে রয়েছে বিজেপি জোট সরকার।জাতীয় ও রাজ্য স্তরে নানা রাজনৈতিক উত্থান পতনের যে দিনলিপি ধরা আছে কাগজের পাতায় পাতায় তা থেকে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি তোলে আনা হয়েছে আলোচ্য সংকলনে।দেশ ও রাজ্যের রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা নেয়া যাবে তাতে।ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় সন্ত্রাসবাদী তৎপরতার খবরাখবর, ত্রিপুরায় টিএনভি চুক্তি,মন্ত্রী বিমল সিংহের হত্যাকাণ্ড--সংকলনের খণ্ড সমূহের পৃষ্ঠা ওল্টালে যেন চোখের সামনে ভেসে উঠবে ঘটনা প্রবাহ।আন্তর্জাতিক নানা ঘটনার মধ্যে রয়েছে বিশ্বজনমত অগ্রাহ্য করে ভুট্টোর ফাঁসি,ভারতীয় বিমান ছিনতাই হয়ে লাহোরে,বাংলাদেশে এরশাদের ক্ষমতা দখল ইত্যাদি নানা খবরাখবর।
রাজনৈতিক নানা ঘটনার পাশাপাশি অর্ধ শতাব্দীকালের আর্থ-সামাজিক নানা বিষয়ও উঠে এসেছে সংকলনে।সত্তর দশকে ত্রিপুরার পাহাড়ি এলাকায় কাজ খাদ্যের অভাব, অনাহার মৃত্যু ইত্যাদি ঘটনা,সিপিএমের আন্দোলন,লাগাতর কর্মচারী ধর্মঘট- সব উল্লেখযোগ্য বিষয় সমূহ আবার ভাবীকালের জন্য নিয়ে আসা হয়েছে দুই মলাটের ভেতরে।সম্পাদক লিখেছেন- পত্রিকাটি যেমন খরা,বন্যা,মহামারী সহ নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখেছে,তেমনই দেখেছে সাম্প্রদায়িক হানাহানি,জাতি দাঙ্গা,উগ্রপন্হী তৎপরতা,অপহরণ,রাজনৈতিক সন্ত্রাস ইত্যাদি।যেহেতু সংবাদপত্র,তাই সব খবরই প্রকাশ করতে হয়েছে তাকে।কিন্তু সর্বত্রই ছিল একটি সতর্কতার ছাপ।
জাতীয় স্তরের সংবাদের ক্ষেত্রে দেশের বিভিন্ন শহরে সন্ত্রাসবাদীদের হামলা, আবার একসময় বছরের পর বছর ধরে ত্রিপুরায় জঙ্গী তাণ্ডব,মৃত্যুর মিছিল ইত্যাদির পাশাপাশি নানা ক্ষেত্রে উন্নয়নের চিত্রও ধরা পড়েছে এই সময়কালে।সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও বিভিন্ন সময়ে পত্রিকাটির গুরুত্বপূর্ণ কভারেজ নিঃসন্দেহে আগামী দিনের সংস্কৃতি প্রেমীদেরও পুষ্ট করবে।পুস্তকপ্রেমীদের তৃপ্ত করবে বইমেলার স্বর্ণালী অধ্যায়।ত্রিপুরাবাসীর মঙ্গল কামনা করে রাজ্যের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী নৃপেন চক্রবর্তীকে মাদার টেরেসার একটি চিঠিও সংকলনটির এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। যে কোনও প্রতিষ্ঠানের জীবনে অর্ধ শতবর্ষ নিশ্চিত সুদীর্ঘকাল।দেশ-বিদেশে এর মধ্যে কত না পরিবর্তন। ত্রিপুরায় রেলপথের সমীক্ষার খবর যেমন ছাপা হয়েছে এই সময়কালের মধ্যে,তেমনই ছাপা হয়েছে ব্রডগেজ লাইনে ট্রেন চালুর খবরও।সব মিলিয়ে এই সংকলনের মধ্যে যেন ধরে রাখা হয়েছে এক দীর্ঘ সময়কালকে!
গত অর্ধ শতাব্দীকালের মধ্যে মুদ্রণ মাধ্যমেও নানা বিবর্তন এসেছে।লেটার হেড থেকে লাইনো টাইপ,তারপর অফসেট।স্বাভাবিক ভাবেই পত্রপত্রিকাতেও পর্যায়ক্রমে এর প্রভাব পড়েছে।ত্রিপুরা দর্পণ-এর অতীত ও সাম্প্রতিক কালের বেশ কিছু সংখ্যার ফটো কপিও দেয়া হয়েছে সংকলনে, যাতে ধরা পড়বে মুদ্রণ বিবর্তনের ছবিটি।ত্রিপুরা দর্পণ-এর গ্রন্হ প্রকাশনা বিভাগও রয়েছে।কয়েক দশক ধরে ত্রিপুরা সম্পর্কিত বহু গুরুত্বপূর্ণ বই তারা প্রকাশ করে চলেছে।তাদের রয়েছে একটি বহুল পঠিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যপঞ্জী।ত্রিপুরা সম্পর্কে বিশেষ ভাবে জানার জন্য কিংবা গবেষণার জন্য নিশ্চিত ত্রিপুরা দর্পণ-এর দ্বারস্থ হতেই হবে।আলোচ্য অর্ধ শতবর্ষ সংবাদ সংকলনটিও এমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।শুধু বর্তমান নয়,ভবিষ্যতে,আরও অনেক বছর পরেও ত্রিপুরা নিয়ে চর্চায় তা সাহায্য করবে। ১৯৭৪ সাল থেকে অর্ধশত বছরের ত্রিপুরার নানা সংবাদ রয়েছে সংকলনটিতে।কিন্তু এর পূর্ববর্তী ইতিহাস,যেমন মাণিক্য রাজাদের শাসনাধীন সময়কাল,ত্রিপুরার ভারতভুক্তি ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা,পূর্ণ রাজ্যোত্তর ত্রিপুরায় প্রথম কংগ্রেস সরকার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি নিয়ে সংক্ষিপ্ত একটি আলোচনা সংকলনের শুরুতে থাকলে ভালো হতো।সংকলনের প্রতিটি খণ্ডে কয়েক বছরের নির্বাচিত সংবাদ, নিবন্ধ সংকলিত হয়েছে।তা থেকে বাছাই করে বছর ভিত্তিক অধিক গুরুত্বপূর্ণ সংবাদগুলোর শিরোনাম সূচিতে দিলে অনুসন্ধিৎসু পাঠকদের সুবিধা হতো।
সংকলনের খণ্ড সমূহের মুদ্রণ, বাঁধাই এক কথায় চমৎকার। উদ্যোগও অভিনব।ত্রিপুরাতে এমন উদ্যোগ ইতিপূর্বে দেখা যায়নি,অন্য কোথাও হয়েছে কিনা জানা নেই তাও! যারা পুরনো ঘটনা জানতে চান তাদের সংকলনটি কাজে আসবে।উপকারে আসবে গবেষক,সাংবাদিক সহ অনুসন্ধিৎসু পাঠকদের, ক্ষেত্র বিশেষে উপকৃত হবে ছাত্রছাত্রীরাও।স্কুল-কলেজের গ্রন্থাগার সহ বিভিন্ন গ্রন্থাগারে 'ত্রিপুরা দর্পণ ৫০' সংকলনটি নিশ্চিত স্হান করে নেবে এমন আশা করা যায়।
আরও পড়ুন...