করোনা নিয়ে সংক্ষিপ্ত রাউন্ড আপ
গৌরব চক্রবর্তী
করোনা ভাইরাস সংক্রমনে গোটা বিশ্বকে প্রায় বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। নিত্যদিন শত শত লোকজনের প্রান চলে যাচ্ছে। অথচ নেই যুদ্ধ, মহাযুদ্ধ, প্রলয়,সুনামী। আছে শুধু মহামারী তাও আবার ভয়াবহ প্লেগ, কলেরা, ম্যালেরিয়া নয়,এ করোনা ভাইরাস। ইতিমধ্যে প্রান গেছে প্রায় ৮২ হাজার আর আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ভারতে এই মারনব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছেন এমনরা ভাল হচ্ছেন। রোগমুক্ত হয়েছেন ৩২৬ জন। রোগমুক্তির প্রবনতা উৎসাহজনক। প্রমানিত হচ্ছে ভারতের চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির। বিশ্বের বহু দেশ থেকে ভারতের চিকিৎসা বিজ্ঞান অনেক অনেক উন্নত। বিজ্ঞানীরা নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত ভাইরাসের সন্ধান মিলেছে ৪৪২৪ জনের দেহে। আরো যে কতজনের দেহে পাওয়া যাবে এই মারন ভাইরাস তা বলাই যাচ্ছে না। নুতন করে সংক্রমণ রোধে যুদ্ধকালীন ভাবে ব্যবস্হা গৃহীত হচ্ছে ,আরো প্রক্রিয়া জারী রয়েছে। অব্যাহত লকডাউন। ১৪ই এপ্রিল পর্যন্ত চলবে। তাঁর মেয়াদ আরো বাড়তেই পারে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।লকডাউন মূলত স্ংক্রমন এর বিস্তার রোধ করার জন্য। বেশ কিছু রাজ্য লকডাউনের মেয়াদ বৃদ্ধির পক্ষে মতামত জানিয়েছে। কেননা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাই করোনা ভাইরাস সংক্রমণ রোধে এখন পর্যন্ত কার্যকর ব্যবস্হা।
তবে সম্ভবত পর্যায় ক্রমিক ভাবে লকডাউন প্রত্যাহার করা হতে পারে। ঘোষনা করা হতে পারে হটস্পট। মানে যে সব জেলায় সংক্রমন বেশি সেসব এলাকাকে হটস্পট বলে ঘোষিত হতে পারে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পতো সরাসরি বলেই দিয়েছেন লকডাউনের পক্ষপাতী তিনি নন। কেননা লকডাউন করে তো জীবনযাত্রা স্তব্দ করে দেওয়া যায়না। উৎপাদন কিভাবে বন্ধ রাখা হবে? এটা ট্রাম্পের প্রশ্ন।
এই মারনব্যাধি নিয়ে আগে বিজ্ঞানীদের মধ্যে কোন ধারণাই ছিল না। সাধারন সর্দি ,কাশি,গায়ে গায়ে জ্বর, অল্পবিস্তর কফ, মাঝে মধ্যে শ্বাসের হালকা কষ্ট হয়েই থাকে। এই সময়ে এই সব রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। কিন্তু এই উপসর্গ মানেই যে করোনা ভাইরাস মারন ব্যাধি তাতো বিজ্ঞানীদের ও জানা ছিল না বা কল্পনার মধ্যে ও ছিল না। এখন করোনা হয়ে দাঁড়িয়েছে মহামারী।
ইতিমধ্যে করোনা বিশ্বের ১৪০ টি দেশে বিস্তার লাভ করেছে। আরো নতুন নতুন দেশে স্হল, জল, আকাশ পথে বিস্তৃত হচ্ছে। মহাকাশে, চাঁদে ও বিস্তৃত হবে কিনা তা বলবে ভবিষ্যৎ। অবশ্য কপাল ভালো সেখানে মনুষ্য প্রজাপতি নেই।
এই বিশ্ব দেখেছে দুই দুটি বিশ্বযুদ্ধ,আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ,ইরাক-ইরান যুদ্ধ, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, ভারত-চীনের লড়াই,একাওরের বাংলাদেশ যুদ্ধ। আরো বেশ কিছু যুদ্ধ দেখেছে মানব সভ্যতা। বিশ্ব চাক্ষুষ করেছে অগুন্তি প্রাকৃতিক বিপর্যয়, ভয়াবহ বন্যা,সুনামীতে হাজার হাজার লোকের প্রানহানি।
বিশ্ব দেখেছে দুর্ভিক্ষক, মহামারী, প্রাকৃতিক বিপর্যয়। কিন্তু করোনা্রই মত মহামারী বিশ্ব দেখেনি। আজকের এই প্রতিবেদনে বিশ্ব যে সব মহামারী দেখেছে তার কিছু ফিরে দেখা।
শুরুতেই বলে রাখা প্রয়োজন যে এবার করোনা ভাইরাস মারাত্মকভাবে আক্রমন শুরু করেছে তেমন মারাত্মক গত দুশ বছরে হয়নি। এবার মারাত্মক ভাবে আক্রমন করতে শুরু করেছে করোনা। এর শুরু হয়েছিল কমিউনিষ্ট শাসিত চীন থেকে। তা এখন বিশ্বের ১৪০-র বেশি দেশে। চীন থেকেও বেশী ভয়ন্কর অবস্থা ইতালির। বহু লোক মারা গেছে ইতালির। এমনকি চীন থেকে বেশী। চী্নে দাপট অনেক কমেছে। করুনা দাপট দেখাচ্ছে এখন ইতালী ও অন্যান্য দেশে। ভ্যাকসিন বের হয়নি তা দিয়ে করুনার সংক্রমণ রোধ করা যেতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে অনেক ধরনের ভাইরাসের ভয়ঙ্কর গ্রুপ করোনা ভাইরাস।
১৯০০ তে আমরা দেখেছি গুটি। বহুদিন দাপট বজায় রেখেছিল গুটি। উওর আমেরিকা থেকে শুরু হওয়া গুটি বসন্তে প্রায় ৬৩ মিলিয়ন লোকের প্রানহানি হয়েছিলো। উদ্বেগের বিষয় ছিল আক্রান্ত দের মধ্যে ৩০শতাংশের মৃত্যু হয়েছিল। এখন গুটি বসন্ত আর নেই। এটা বিজ্ঞানের আশীর্বাদ।
১৯১৮ থেকে ১৯২০ স্পানিশ ফ্লু তে ৫০০ মিলিয়ন লোক আক্রান্ত হয়েছিল এবং এর মধ্যে ১০০ মিলিয়ন এর প্রানহানি হয়েছিলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যত প্রানহানি হয়েছিলো তার দ্বিগুণ প্রানহানি হয় স্পানিশ ফ্লুতে।
এর পর থাবা বসাল এশিয়ান ফ্লু। এর সংক্রমণ শুরু হয় ১৯৫৬ তে । এটা ছিল এক ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা। চীনেই এর প্রাদুর্ভাব ও সংক্রমণ শুরু। চীন থেকে সিঙ্গাপুর।তারপর এদেশ ওদেশে। প্রায় এক মিলিয়নের বেশি প্রান ছিনিয়ে নিয়ে যায় এই এশিয়ান ফ্লু।
এরপর এল ভয়াবহ এইডস। এটা অনেকের জানা আবার নাও জানা থাকতে পারে এইডস প্রথম ধরা পরে ১৮৮১ সালে। এই মারনব্যাধি বিশ্বজুড়ে এমন তান্ডব শুরু করে তা রোধ করা দূস্কর হয়ে পড়ে বিজ্ঞানীদের কাছে। ২০১৭ সালেই প্রায় দেড় লক্ষ লোক মারা যায় এইডসের তান্ডবে। আনুমানিক ২৫ মিলিয়ন লোকের জীবন ছিনিয়ে নিয়েছে এইডস। উদ্বেগের বিষয় ছিল শুধু ২০০৪/২০০৫ এ ৩৭ মিলিয়ন মানুষ এইচআইভিতে আক্রান্ত হয়ে পড়েন।
এল এবার সোয়াইন ফ্লু ২০০৯ সালে। গবেষণায় দেখা যায় এই ভাইরাস শুকর থেকে মানব দেহে সংক্রামিত হয়। ক্রমশঃ এটি পশু চিকিৎসকদের মধ্যে, কৃষকদের মধ্যে সংক্রামিত হয়। ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে এটি মহামারী আকারে প্রকাশ পায়। প্রায় ২০ হাজার লোকের মৃত্যু হয় সোয়াইন ফ্লু তে। পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হওয়ায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে।
২০১৪ সালে আবির্ভাব ইবোলার। পশ্চিম আফ্রিকাতে এর ভাইরাস প্রথম দেখা যায়। ছড়িয়ে পড়ে আফ্রিকার কয়েকটি প্রতিবেশী দেশে। দেখতে না দেখতে প্রায় বার হাজার লোকের প্রান কেড়ে নেয় ভয়ঙ্কর ইবোলা।
গুটি থেকে শুরু করে এইডস, ইবোলা, এশিয়ান ফ্লু, স্পানিশ ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু গত একশত বছরের বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছে। এবার বিশ্ব কাঁপছে করোনা ভাইরাসে।
এর সংক্রমণ রোধে গোটা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা দিনরাত গবেষণায়। কিন্তু এখনো কোনো ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়নি, অনিশ্চয়তার দোলাচলে বিশ্ববাসী। তবে আবিস্কার হবে কোন একদিন, ততদিনে বহু প্রান হয়তো ঝড়ে যেতে পারে।
তবে চীনে সম্ভবত এখন প্রকোপ অনেকটা কম। তবে চীন করোনার বিষয়টি প্রথমদিন থেকেই গোপন রেখেছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে প্রকারান্তরে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
চীনের প্রতিবেশী তাইওয়ান। ছোট্ট দেশ হয়েও তাইওয়ান প্রথমদিকেই করোনা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। শুধু সংক্রমণ প্রতিরোধ ব্যবস্থার মধ্যদিয়েই তাইওয়ান এই সফলতা অর্জন করতে পেরেছে। ছোট্ট দেশ কিউবা।সেখানে করোনা তেমন থাবা বসাতেই পারেনি।কেরালা তো করোনা ভাইরাস সংক্রমণ রোধে বা মোকাবেলায় অভূতপূর্ব সাফল্য দেখাচ্ছে।সেখানে মৃত্যুর হার খুব কম।আক্রান্তরা দ্রুত আরোগ্য হচ্ছে।কেরালা শুধু তিনদফা কর্মসূচি নিয়েছে। উচ্চ শিক্ষিত রাজ্য কেরালা। বিদেশে কাজ করেন এমন লোকের সংখ্যা ও অনেক অনেক বেশী।
করোনা ভাইরাস সংক্রমণ এক মহামারী । মহামারীর সাথে তো দূর্ভিক্ষের তুলনাই হতে পারেনা। অথচ এরাজ্যের কয়েক জন বিজ্ঞবাগিশ দুর্ভিক্ষ টেনে আনছেন। এদের পান্ডিত্যকে বাহবাই দিতে হয়।
আরে পূন্যভূমি ভারতে দূর্ভিক্ষ হয়েছে, হয়েছে মহামারী। প্ল্যাগ মহামারীতে ত্রান পরিচালনা করতে গিয়ে প্রচন্ড অর্থনৈতিক সংকটে দিশেহারা স্বামিজী বেলুড়মঠ বিক্রি করে দেয়ার ভাবনা চিন্তা করছিলেন। কিন্তু সারদা মার আপত্তিতে শেষ পর্যন্ত আর তা করা হয় নি।
ছোট্ট দ্বীপভূমির দেশ সিঙ্গাপুর। ওখানে ও স্ংক্রমন হয়েছে। চলবে কিন্তু তারা যে ভাবে বিস্তার রোধে কর্মসূচি নিয়েছে তা প্রশংসার দাবি রাখে।
চীনের উহান প্রদেশে এই মহামারীর প্রাদুর্ভাব হয়েছে বলে আন্তর্জাতিক স্ংবাদ মাধ্যমের সংবাদ।প্রায় ৪ হাজারের বেশী প্রান ছিনিয়ে নিয়েছে এই করোনা ভাইরাস সংক্রমণ। গত ডিসেম্বরে এর সূত্রপাত হয়। কিন্তু চীন বিষয়টি যেভাবে জানানোর কথা সেভাবে জানায়নি। ফলে এটি দ্রুত বিস্তার লাভ করে এবং এখন করোনা বিশ্বকে কাঁপাচ্ছে। ফ্রান্স, ইতালী, স্পেন, ইংল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রে এখন করোনা এমন জাল বিস্তার করেছে, বহু প্রান কেড়ে নিয়েছে। তা অব্যাহত রয়েছে। তবে দীর্ঘদিন লকডাউনে থাকার পর আজ থেকে উয়াহনে জীবন যাত্রা স্বাভাবিক হয়েছে। চলতে শুরু করেছে রেল,বিমান। উহান যখন স্বাভাবিক তখন করোনা রুদ্ররূপ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র,বৃটেনসহ অন্যান্য রাষ্ট্রে। বিশ্ব জুড়ে করোনায় প্রানহানির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮২ হাজারের বেশি। আক্রান্ত প্রায় পনেরো লক্ষ,সুস্হ হয়েছে প্রায় তিন লক্ষ।প্রশ্ন হল করোনার দাপটে কিন্তু বিশ্ব প্রায় স্তব্দ। প্রান যেন অনিশ্চয়তায় দুলছে। এক অদ্ভুত অবস্থা। লকডাউনে সব ঘরে বন্দী। শোচনীয় অবস্থা যারা হাঁটি হাঁটি পা করছে,শৈশব যেন হারিয়ে যাচ্ছে। এমন অবস্থা কখনো কিন্তু কল্পনায় ছিল না। কিন্তু আজ বিশ্বে এটাই বাস্তব।
চীন তখন উহান স্বাভাবিক করে দিয়েছে সেখানে আজ চীন থেকে নুতন করে ৬২ জনের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবর এসেছে। এও উদ্বেগজনক।
এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আছ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিরুদ্ধে চীনের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনে আর্থিক অনুদান হ্রাস করার হুমকি দিয়েছেন।
বিশ্বের নাজুক পরিস্থিতিতে দেশের স্বাস্হ্য মন্ত্রক আজ বলেছে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ রোধ দেশের সামনে বিশাল চ্যালেন্জ। বড় কথা লকডাউনের মেয়াদ আবার বৃদ্ধি করা হবে কিনা? যদিও অধিকাংশ রাজ্য মেয়াদ বৃদ্ধির পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেছে। তবে আগামী দিনগুলি বিশ্ববাসীর কাছে বিশাল চ্যালেঞ্জের।