ইতিহাসের আলোকে আরাকান ও রোহিঙ্গা
পান্নালাল রায়
January 10, 2025
অনুপ্রবেশ প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক কালে বারবার আসছে রোহিঙ্গাদের কথা।সীমান্তের ওপার থেকে ব্যাপক হারে এপারে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে নানা আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে বলেও ধারণা।আবার মায়ানমারে ক্ষমতাসীন জুন্টা সরকারের বাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির সংঘর্ষের প্রভাব পড়ছে সীমান্তের এপারেও।এই সংঘাতের ফলে বাংলাদেশে আরও রোহিঙ্গা শরণার্থী আগমনের আশঙ্কা যেমন রয়েছে,তেমনই এপারেও তার আঁচ পড়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না।কিন্তু কারা এই রোহিঙ্গা? কোথায় তাদের আদি নিবাস? এবার ইতিহাসের আলোকে দেখা যাক রোহিঙ্গা এবং আরাকানকে।
প্রায়ই ত্রিপুরার বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় ধরা পড়ছে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী।রাজধানী আগরতলার রেল স্টেশন, বিমানবন্দর সহ রাজ্যের অন্যান্য সীমান্ত অঞ্চলে রেল ও সড়ক পথে ওপারের অনুপ্রবেশকারী গ্রেপ্তারের খবরাখবর সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে।সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে এই অনুপ্রবেশকারীদের একটি অংশ আবার বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী।ধৃতদের মধ্যে নারী,পুরুষ সহ শিশুও থাকছে।জানা গেছে ত্রিপুরা হয়ে এই সব মানুষ দিল্লি,মুম্বই, কলকাতা,ব্যাঙ্গালুরুর মতো বড় শহরে ছড়িয়ে পড়ছে।ধারণা করা যায় এ ধরণের মানব পাচারে ত্রিপুরা এক করিডোর হয়ে উঠেছে।আর এপার-ওপারে গড়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক পাচার চক্র।ধৃত অনুপ্রবেশকারীরা পুলিশী জেরায় স্বীকারও করেছে যে, দালাল ধরেই তারা ভারতে প্রবেশ করেছে।বাংলাদেশের কক্সবাজার এলাকায় শিবিরে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অনেকে উন্নত জীবন জীবিকার আশায় ঢুকে পড়ছে ভারতীয় ভূখণ্ডে।তারপর তারা ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বড় বড় শহরে।এমনকি জম্মু-কাশ্মীরেও যাচ্ছে তারা।গৃহ পরিচারিকার কাজ,নির্মাণ শ্রমিক ইত্যাদি সহ নানা শ্রম নির্ভর কাজে যুক্ত হয়ে পড়ছে তারা।এ ভাবে রোহিঙ্গাদের অবস্থান আগামী দিনে দেশের নিরাপত্তার পক্ষেও সমস্যার সৃষ্টি হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।যদিও এপারে অনুপ্রবেশ রোধে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে।বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে সীমান্তে নজরদারি আরও কঠোর করা হয়েছে।কিন্তু তারপরও অনুপ্রবেশ বন্ধ হয়নি।প্রায়ই রোহিঙ্গা সহ বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী ধরা পড়ছে।তবে যারা ধরা পড়ছে তাদের বাইরেও যে আরও অনেক রোহিঙ্গা ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করে দেশের নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে সক্ষম হচ্ছে তা ধারণা করতে অসুবিধা হয় না।
এবার আসা যাক রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গে।তবে ইতিহাসের আলোকে রোহিঙ্গা নিয়ে আলোচনায় অনিবার্য ভাবেই আসবে আরাকানের কথা।বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ব্রহ্মদেশের নিম্নাঞ্চলে একদা আরাকান নামে এক শক্তিশালী স্বাধীন রাজ্য ছিল।মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে আরাকান উল্লিখিত হয়েছে রোসাঙ্গ নামে।আরাকানের অধিবাসীদের বেশিরভাগই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী থাকলেও সুপ্রাচীন কালেই আরাকানের সঙ্গে আরব দুনিয়ার বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল এবং সেখানে বহু আগে থেকেই গড়ে উঠেছিল মুসলমান বসতি।পঞ্চদশ শতকে আরাকান গৌড়ের করদ রাজ্যে পরিণত হবার পর সেখানে মুসলমানদের বসতির বিস্তার ঘটে।গৌড় থেকে বাংলা ভাষাভাষি মুসলমানগণ জীবিকার সূত্রে পাড়ি দেয় আরাকান।ভাগ্যের অণ্বেষণে আসেন অনেক তুর্কি ও পাঠান যোদ্ধা।আরাকান রাজসভার বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতার কথাও ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে।'পদ্মাবতী' কাব্যের জন্য মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে আছেন সৈয়দ আলাওল।আরাকানের বৌদ্ধ রাজদরবারের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি রচনা করেছিলেন 'পদ্মাবতী'।ড.দীনেশচন্দ্র সেন লিখেছেন, আরাকানের প্রচলিত ভাষা যাই থাক না কেন,সে দেশের লেখ্য ভাষা ছিল বাংলা।আরাকান একদা খুবই সমৃদ্ধ রাজ্য ছিল।কবি আলাওলের বর্ণনায় দেখা যায় ,মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ সহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তখন নানা প্রয়োজনে অনেক মানুষ এসে আরাকানে বসতি স্থাপন করেছিলেন। মোগল, পাঠান যোদ্ধা,রাজপুত সবাই আসতেন।এমনকি ত্রিপুরার কুকিদের কথাও আলাওলের বর্ণনায় পাওয়া যায়।আরাকান রাজার সৈন্যদলে দেশ বিদেশের লোক ছিল।মোগল যুগের শেষদিকে একদা সমৃদ্ধ আরাকানের পতনের সূচনা ঘটে।ঔরঙ্গজেবের ভয়ে সুজা পালিয়ে এসেছিলেন আরাকানে।শেষপর্যন্ত সেখানে নৃশংস ভাবে সপরিবারে নিহত হয়েছিলেন তিনি।সুজার হত্যাকাণ্ডের পর আরাকানে চরম বিপর্যয় নেমে এসেছিল। ঘটেছিল মোগল আক্রমণ।
ইতিহাসের নানা পর্বে দেশে দেশে মানচিত্রের যেমন পরিবর্তন ঘটেছে,তেমনই ব্যতিক্রম নয় আরাকানও।একদিন পতন ঘটে তার।আজ পৃথিবীর মানচিত্রে আরাকান নামে কোনও দেশের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না।১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে ব্রহ্মদেশের কনবাঙ রাজ বংশের অধীনে আসে আরাকান। তারপর ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ব্রহ্মদেশের অধীনে থাকে তা।১৮২৬ থেকে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসন।১৯৪৮ থেকে আরাকান হয়ে পড়ে স্বাধীন ব্রহ্মদেশের একটি অংশ। ১৯৪৮ সালে ব্রহ্মদেশের একটি বিভাগে পর্যবসিত হয় আরাকান। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে আরাকান রাখাইন জনগোষ্ঠীর বাসভূমি হিসেবে ব্রহ্মদেশের একটি অঙ্গরাজ্যে পরিণত হয়।কিন্তু পরবর্তীকালে আরাকানের অস্তিত্ব যেন বিলুপ্ত হয়।১৯৮৯ সালে ব্রহ্মদেশের নাম পরিবর্তিত হয়ে যেমন মায়ানমার হয়,তেমনই আরাকানের নাম হয়ে যায় রাখাইন।এখন আর আরাকান নেই, মায়ানমারের একটি রাজ্য হচ্ছে রাখাইন।এই রাখাইনে বসবাসকারী মুসলমানদেরই সাধারণ ভাবে 'রোহিঙ্গা' নামে অভিহিত করা হয়।তবে রাখাইন প্রদেশ ছাড়াও, তুলনায় কম হলেও মায়ানমারের অন্যত্রও রোহিঙ্গারা রয়েছে।বর্তমানে বাংলাদেশের কক্সবাজার এলাকায় শরণার্থী শিবিরে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে যারা মায়ানমার থেকে সেদেশে এসেছে।
রোহিঙ্গাদের কখনও রোহিঙ্গা মুসলিম, কখনও মুসলিম আরাকানীস,আবার কখনও বার্মিজ মুসলিম বলেও অভিহিত করা হয়েছে।কেউ কেউ বলেছেন ব্রিটিশ যুগে তাদের চিটাগানিয়ানস বলেও অভিহিত করা হতো।আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে,শত শত বছর আগে থেকেই দেশ-বিদেশের বহু মানুষ জীবিকার অন্বেষণে সমৃদ্ধ আরাকান রাজ্যে এসেছিলেন।গৌড়ের অধীনে থাকার সময় অধিক সংখ্যায় মুসলমানদের আগমন ঘটেছিল আরাকানে।চট্টগ্রাম লাগোয়া বলে সেখান থেকেই বেশি মানুষের আরাকানে আগমন স্বাভাবিক। শেষপর্যন্ত আরাকানেই স্হায়ী ভাবে বসবাস করতে থাকেন এদের অধিকাংশ।যাইহোক, স্বাধীনোত্তর সময়কালে ব্রহ্মদেশের আরাকানে একটি স্বশাসিত মুসলিম অঞ্চল গঠনের জন্য রোহিঙ্গাদের লড়াই শুরু হয়।তারপর ইতিহাসের রক্তাক্ত অধ্যায়।একদিকে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র তৎপরতা এবং অপরদিকে সেনাবাহিনীর দমনপীড়ন।গত শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে দশকের পর দশক ধরে চলছে এই রক্তক্ষয়ী ঘটনা প্রবাহ।২০১৬ থেকে এর তীব্রতা মারাত্মক বৃদ্ধি পায়।২০১৭ সালে ৭ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থী সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়।বাংলাদেশের কক্সবাজারে রয়েছে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ শরণার্থী শিবির।
মায়ানমারের ক্ষমতাসীন জুন্টা সরকারের বিরুদ্ধে বর্তমানে কয়েকটি সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী সংঘর্ষে লিপ্ত রয়েছে।ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকাতেও এর আঁচ লাগছে।এই সংঘর্ষের ফলে বছর খানেক আগে মায়ানমার থেকে বহু মানুষ এসে মিজোরামের চম্পাই জেলায় আশ্রয় নেয়।মায়ানমারের কিছু সেনাও পালিয়ে এসে মিজোরাম, মণিপুরে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদেরকে অবশ্য ফেরত পাঠানো হয়।তবে মায়ানমারের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকার পরিস্থিতি সবচেয়ে উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে।মায়ানমারের অন্যতম শক্তিশালী বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান আর্মি আরাকানের সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধারের জন্য মায়ানমারের জুন্টা সরকারের বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে।ইতিমধ্যে রাখাইন প্রদেশের বেশিরভাগ অংশ তারা নিজেদের কব্জায় নিয়ে গেছে।বিশেষত বাংলাদেশ-মায়ানমারের ২৭০ কিঃমিঃ সীমান্ত এলাকায় আরাকান আর্মি তাদের আধিপত্য কায়েম করে নিয়েছে।রাখাইনের রোহিঙ্গাদের উপর আরও নিপীড়ন চলছে।অনেকের মৃত্যু ঘটেছে।আরও হাজার হাজার রোহিঙ্গার বাংলাদেশে প্রবেশের আশঙ্কা করা হচ্ছে।গত কয়েক মাসে ৮০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে বলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মহম্মদ ইউনুস জানিয়েছেন। আরাকান আর্মি যেমন মায়ানমারের জুন্টা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে,তেমনই আরাকান রোহিঙ্গা আর্মি,আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি নামে একাধিক রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠনও রয়েছে।রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠন গুলো যদিও রোহিঙ্গাদের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছে,তবু সাম্প্রতিক কালে তারা বিদ্রোহী আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে জুন্টা বাহিনীকে সাহায্য করছে বলে আরাকান আর্মির অভিযোগ।তাদের আরও অভিযোগ, বাংলাদেশে অবস্থিত রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরেই জঙ্গিরা প্রাথমিক ভাবে তাদের চক্র গড়ে তুলে।
যাইহোক, সীমান্তবর্তী এলাকায় মায়ানমারের রক্তক্ষয়ী ঘটনাস্রোত এপারের জন্য রীতিমত উদ্বেগ বয়ে আনছে।বিশেষত বাংলাদেশের জন্য সৃষ্টি হচ্ছে নানা আশঙ্কা।আর তার ছোঁয়া লাগতে পারে ভারতেও।বাংলাদেশের মায়ানমার সীমান্ত আরাকান আর্মি কব্জা করে নেয়ায় রাখিনে থেকে আরও বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীর বাংলাদেশে প্রবেশের আশঙ্কা রয়েছে।রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কেউ কেউ বাংলাদেশ হয়ে আবার ভারতেও ঢুকে পড়ছে।ছড়িয়ে পড়ছে দেশের নানা জায়গায়।আর তাতেই তৈরি হচ্ছে আশঙ্কার ক্ষেত্র। বর্তমানে পৃথিবীর মানচিত্রে আরাকান নামে কোনও ভূখণ্ড না থাকলেও ইতিহাসের পৃষ্ঠায় যেমন তার উপস্থিতি রয়েছে,তেমনই তার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালের নানা রক্তাক্ত অধ্যায়, আশঙ্কা আর উদ্বেগ!চলছে আরাকানের সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধারের লড়াই।