নবজ্যোতি কিরণে, মা মহাগৌরী
রুকমিনি দত্ত
September 19, 2025
অবিভক্ত ভারতের ঢাকা বিক্রমপুর মুন্সীগঞ্জের ইদ্রাকপুর গ্রামের “পণ্ডিত বাড়ি” শব্দটার মধ্যে একটা অদ্ভুত পুঁথি-পত্র, জলগামছা, তিসির তেল, রুপোর গাছকৌট, স্বর্নের কাজললতা, কুশাগ্রের চাটাই, সংস্কৃত টোলের গন্ধ আছে। কিন্তু আজকের দিনে আমাদের, মানে 'দত্তবাড়ী'র ছেলে মেয়ে বউদের এই শব্দটা শুনলেই মনেপ্রাণে জেগে উঠে আরেকটা শব্দের অনুভূতি, “সুনিবিড়”, আমার পিতৃতুল্য শ্বশুরমহাশয় স্বর্গীয় ড: জ্যোতিষ চন্দ্র দত্ত এবং স্বর্গীয়া গৌরী দত্তের প্রতিষ্ঠিত আমাদের আগরতলা বাড়ি।
ফেলে আসা পণ্ডিতবাড়ীর ইতিহাস, পরম্পরা ও ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে যা আজও প্রাসঙ্গিক বলা চলে, যেখানে সেই শতাব্দীপ্রাচীন একচালার মৃণ্ময়ী মাতৃমূর্তি এখনও যেন তাঁর ই কৃপায় মহাগৌরী রূপে পূজিতা হয়ে আসছেনII
সারা বৎসরে এই সময়, এই আশ্বিনের শারদপ্রাতে, ঘরে ফেরার এ যেন এক অদৃশ্য অমোঘ টান আমাদের।আত্মীয় পরিজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী সকলকে নিয়ে বাড়ীর পূজা মণ্ডপে রাতভর হইচই, আড্ডায়, গানে-গল্পে, এলাকার সবাইকে নিয়ে আনন্দ উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে ওঠার পালা শুরু।এই সব মিলিয়ে ই সেই পণ্ডিতবাড়ি থেকে এখন আমাদের কুঞ্জবন শ্যামলিবাজার দত্তবাড়ীর শ্রী শ্রী শারদীয়া মা দুর্গাপূজার ধারাবাহিকতা, যা এবারে এক যুগ (১২ বৎসর) পূর্ণ করলোII
সমস্ত শাস্ত্রীয় নিয়ম-নির্ঘণ্ট-রীতি অনুযায়ী আমাদের বাড়ীর মা দুর্গা আদি পুজোর শুভমুহুর্ত শুরু হয় শারদ-নবরাত্রির প্রথম দিন (মহালয়ার পরদিন) মা শৈলপুত্রী রূপে দেবী দুর্গার মহাকলস (রাজঘট) স্থাপনা ও শ্রী শ্রী চণ্ডী ও পাঠের মাধ্যমে।
এরপর পঞ্চমী দিন শুভসন্ধ্যায় তিল-তেল, ধান-দুর্বা, হলুদ, সিঁদুর, পান-সুপারি দিয়ে মা গঙ্গা আহ্বানের পর, ঢাক-ঢোল, বাজি-পটকা, শঙ্খধ্বনি-উলুধ্বনির মধ্য দিয়ে, আগরতলা রাজবাড়ীর শ্রীশ্রী লক্ষ্মীনারায়ণবাড়ির প্রভুবাড়ি থেকে মৃণ্ময়ী একচালার প্রতিমারূপে মায়ের আগমন ও বোধন হয় বাড়ীর পূজা মণ্ডপে।
মহাষষ্ঠী তে দেবী কাত্যায়নী রূপে হয় মায়ের আমন্ত্রণ-অধিবাস, বিল্বষষ্ঠী পূজা, সন্ধ্যা-আরতি ও শৃঙ্গার (লাল ব্রোকেড বেনারসী শাড়ি, লাল উড়না, রূপটান, স্বর্ণালঙ্কার, অস্ত্র-শস্ত্র আদি সাজসজ্জা)I
এরপর মহাসপ্তমীর সূর্য্যদয়ের সাথে সাথে মন্ত্রচ্চারণের মধ্য দিয়ে ধারাবাহিকভাবে শুরু হয়ে যায় দেবী কালরাত্রী রূপে মায়ের মূল পুজো পর্ব।একে একে নবপত্রিকা (কলাবউ) স্নান-স্থাপনা, অন্যান্য সকল দেবদেবীর মঙ্গলঘট প্রতিষ্ঠা, মহাসপ্তমাদি কল্পারম্ভ, মায়ের পূর্ণাঙ্গ প্রাণপ্রতিষ্ঠা, দিব্যচক্ষুদান পর্ব সম্পন্ন হয়। সাথে চলতে থাকে শ্রীশ্রী চণ্ডীপাঠ।এরপর অদৃশ্য এক জ্যোতির্বলয় সৃষ্টির মাধ্যমে মৃণ্ময়ী মা যেন এক অলৌকিক শিহরণ জাগানো চিন্ময়ী রূপে জেগে ওঠেন… সবার মাঝে আবির্ভূতা হন।
এরপর হয় মায়ের বিল্ব-পুষ্পাঞ্জলি।আমাদের এই এলাকার প্রায় সকলে ই ভক্তিভরে মাকে অঞ্জলী দিতে আসেন।এরপর হয় মায়ের ভোগ আরতি।
মহাসপ্তমীতে মায়ের অন্নভোগে, মা কে খিচুড়ি ভোগ নিবেদনের করার প্রথা আমাদের।সাথে থাকে ১৪ রকম ভাজা, লাবড়া, চাটনি, বিন্নি চালের পরমান্ন, পাঁপড়, ক্ষীরদই, বিবিধপ্রকারের মন্ডামিঠাই ও ফলমুলাদি।
সন্ধ্যাকালীন পুজো তে প্রতিদিন মায়ের শীতলভোগে থাকে বাড়িতে তৈরি করা মালপোয়া, দুধপুলি, নারকোল পুরের বকফুল, ক্ষীরের পাটিসাপটা, এলোঝেলো, লুচি-পুরি-সুজি, কেশর-সেমাই পায়েস, তিল-নারকোল-চিড়া-খৈ এর নাড়ু ইত্যাদি।
এরপর জয় জয় মা দুর্গা ধ্বনিতে, ঢাক ঢোল কাসর ঘণ্টা শঙ্খ্যধ্বনিতে বিপুল আনন্দ উল্লাসের মধ্য দিয়ে প্রাণভরে সবাই মেতে ওঠে মায়ের সন্ধ্যা আরতি তে… জ্বলজ্বল করে জেগে ওঠে যেন মায়ের মায়াভরা মুখখানি!
মহাসপ্তমীর মধ্যরাত্রিতে হয় মায়ের অর্ধরাত্রিবিহিত কালী পূজা।১০৮ দীপদান, হোম-আহুতি, আরতি, অঞ্জলী, পূর্ণপাত্র-পঞ্চনৈবেদ্য নিবেদনের মাধ্যমে দেবী কালিকা রূপে মা পূজিতা হয়ে থাকেন।
মহাষ্টমীতে মা আমাদের মহাগৌরী।বাড়ীর প্রথা অনুসারে ১০৮টি নীলপদ্ম শ্রীশ্রী দেবী মায়ের পাদপদ্মে অর্পণ করা হয়।
এদিন মায়ের অন্নভোগে থাকে পুষ্পান্ন, লালশাক, কলমিশাক, বাড়ীর ৫-৭ রকম লতাপাতা দিয়ে তৈরি পাঁচমেশালি শাক, ১৪ রকম ভাজা, ছোলার ডাল, পনীর-পটল রসা, ছানার ডালনা, বিন্নি চালের পরিমান্ন, চাটনি, ক্ষীরদই, বিবিধ প্রকারের মিষ্টি ও ফলমূলাদি।
নির্ঘণ্ট অনুযায়ী মহাষ্টমী ও মহানবমীর সন্ধীক্ষণে ১০৮ টি ঘৃত-প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় মা সন্ধির পূজা। সন্ধ্যাবেলা যথারীতি হয়ে থাকে মায়ের শীতলভোগ ও সন্ধ্যা-আরতি।
মহানবমীতে মা আমাদের সিদ্ধিদাত্রী।মায়ের নবম্যাদি কল্পারম্ভ পূজা ও হোমাগ্নি সম্পন্ন হওয়ার পর, এদিন মায়ের অন্নভোগে থাকে বাসন্তী পোলাও, লালশাক, বাড়ীর ৫-৭ লতাপাতার শাক, ১৪ রকম ভাজা, সোনামুগের ডাল, পনির ভাপা, বড়ি-চালকুমড়া-গাঁদাফুলের পাতা দিয়ে শুক্ত, সয়াবিনের ডালনা, বিন্নি চালের পরমান্ন, চাটনি, ক্ষীরদই, বিবিধ প্রকারের মিষ্টি ও ফলমূলাদি।
পুজোর প্রতিদিনই প্রচুর লোকসমাগম ঘটে।সকলকে বসিয়ে মায়ের অন্নভোগ বিতরণ করার রীতি ও ব্যবস্থা থাকে আমাদের।
নবমীর রাত্রিতে মায়ের জন্য কচুশাক ও পান্তাভাত করে রাখা হয়, নিয়মমত পরদিন তা খেয়ে মা রওনা দেন কৈলাসের পথে।
এরপর থেকে ই “যেও না গো নবমী নিশি” র এক অদ্ভুত বিষাদের সুর যেন বেজে ওঠে! মায়ের বিদায়ের কল্পনায় সবার মন ভারি হয়ে ওঠে, চোখ ভরে যায় জলে। গুরুদেব শ্রী শ্রী রামঠাকুরকে সাথে নিয়ে তাই সবাই মিলে বসে মায়ের কাছে হরি নামসঙ্কীর্তনের আয়োজন করি আমরা এই নবমী নিশিতে।
পরদিন, দশমীর সকালে প্রথমে গৃহদেবতার স্থানে আবীর আলপনা পূর্বক মায়ের যাত্রা-ঘট স্থাপনা করা হয়, যেখানে আজও রাখা হয় পুরনো পারিবারিক ঐতিহ্যমন্ডিত রৌপ্যমুদ্রা ও রুপোর গাছকৌট, ময়ুরপঙ্খ্য চামর, শীতলপাটির পাখা, কুশাগ্রপাখা, জলগামছা, ধান-দুর্বা, তেল- সিঁদুর, দুধ-দধি-ঘৃত-মধু-দ্রাক্ষারস, একটি পরিপূর্ণ পানীয় জলের গ্লাস, এক জামবাটি পরিমাণ নাড়ু-মোয়া, গুড়-বাতাসা-চিড়া-খৈ প্রভৃতি, তিল-তিসি,পান-সুপারি, হরিদ্রাখণ্ড, শ্বেত ও রক্তচন্দন, স্থলশ্বেতপদ্ম ও লালপদ্ম, শ্বেত ও নীল অপরাজিতা, স্বর্ণচাঁপা ও এক ঝুড়ি শিউলি ফুল।
এখানে এটুকু উল্লেখ করতে ই হয় যে, মায়ের অসীম কৃপায় দেবীপক্ষের সূচনা থেকে ই বাড়ীর সকল ফুলেরগাছ তার নিজস্ব পুষ্পভারে যেনো নত হয়ে থাকে মায়ের শ্রীচরণে! এত সব সুন্দর বিভিন্নরকম বাড়ির ফুল, দুর্বা, বিল্বপত্র, আম্রপত্র, ধুতুরা, আদা-হলুদ, নিম-তুলসী তে সারবাড়ি পরিপূর্ণ হয়ে থাকে যে আমাদের বাইরে থেকে এইসব কোনও কিছু ই আনতে হয় না। এমনকি নবপত্রিকার প্রধান উপাদান কদলীবৃক্ষ ও জোড়াবেল এবং আরও ৫-৭ টি উপাদান আমরা বাড়ি থেকে ই সংগ্রহ করে থাকি। অপার এই বিশ্বসংসারে যে শুধু মায়ের ই মায়ার পরশ, এ যেন আমরা প্রতিপদে প্রতিক্ষণে প্রতিটা কাজে অনুভব করি।
এরপর দশমীবিহিত পূজা সমাপনান্তে দর্পণ বিসর্জনের পর মায়ের যেন এক অপার্থিব বিষাদভেজা জলজ চাঁদমুখ ভেসে ওঠে।দর্পণ কলসে গঙ্গাদর্শন ও শ্রীচরণস্পর্শ প্রণাম শেষে, সকলকে চোখের জলে ভাসিয়ে দিয়ে শুরু হয় মায়ের বরণ, সিদুরখেলা ও শুভ বিজয়াযাত্রা।
“আবার এসো মা” এই আকুতি প্রণাম ও মনস্কামনার সাথে দেবীপ্রতীমা নিরঞ্জনের পর বাড়ি ফিরে সকলে মায়ের রাজঘট ও দেবীরূপ অপরাজিতা গুল্মের প্রদক্ষিণ ও প্রণাম শেষে সবাই মিলে আশীর্বাদস্বরূপ শান্তিজল নতমস্তকে গ্রহণ করি।
এরপর গুরুজনদের প্রণাম জানিয়ে সকলে মিলে জিলিপি লালমোহন নিমকি বুন্দিয়া (বোদে) সহযোগে শুভবিজয়ার কুশল বিনিময় পর্ব সম্পন্ন হয়।পূজোপর্ব শেষে এই বিজয়াদশমীতে আমাদের আমিষ পদে থাকে জোড়া-ইলিশের সর্ষেপোস্ত ভাপা, ধনেপাতা-ছোটট্যাংরা র ঝাল ও পাকারুই এর দইকালিয়া। রীতি অনুযায়ী এরপর সরস্বতী পুজো পর্যন্ত আমাদের ইলিশমাছ নিষেধ থাকে।
“তুমি যে মা আমার মা সবার মা দুর্গা মা” ~ এই আবেশটুকুর রেশ মনের মধ্যে রেখে, মসৃণ এক মায়াজালের আলোয় আলোকিত হয়ে থাকে এই সময়ে চারিদিকটা পুজোর সাজে, ও আনন্দে উৎসবে। দুগ্গা মায়ের সাথে এই কয়েকটা দিন কিভাবে যে কেটে যায়, চলে ও যায়, সত্যি, সে যেন এক অদ্ভুত অপার্থিব অনিন্দ্যসুন্দর অনুভূতি।দুগ্গা দুগ্গা।
সব পুরনো বাড়ীর মতো ই আমাদের পারিবারিক পুজোর স্মৃতি নিয়ে ই আমরা, আজকের এই পণ্ডিতবাড়ীর উত্তরপুরুষরা সব নিয়ম মেনে নিষ্ঠা ভরে সময়ের সাথে সাথে এখনও এই পুজো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়াস করে যাচ্ছি মায়ের ই কৃপায়। মা যেন স্বমহিমায়, তার দিব্য আলোকবর্তিকায় আমাদের আজীবন আবদ্ধ করে রাখে… মায়ের কাছে শুধু এই বর টুকু ই প্রার্থনা করি।
জয় মা দুর্গা
(লেখক ডা. রুকমিনি দত্ত। তিনি ডা. কিশলয় দত্তের স্ত্রী, যিনি দিল্লির ম্যাক্স হাসপাতালে ইমার্জেন্সি মেডিসিন বিভাগের প্রধান। কিশলয় দত্ত এবং রুকমিনি ত্রিপুরার বাসিন্দা। বর্তমানে তারা দিল্লিতে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন)
আরও পড়ুন...