প্রদ্যোত কিশোর দেববর্মন : তিপ্রা মথার রাজনীতি, আবেগ ও বাস্তবতার সঙ্কট

জয়ন্ত দেবনাথ

September 11, 2025

ত্রিপুরার রাজনীতির মানচিত্রে প্রদ্যোত কিশোর দেববর্মন নিছক কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নন, বরং একদিকে রাজপরিবারের উত্তরাধিকার, অন্যদিকে উপজাতি আবেগের প্রতীক হিসেবেও পরিচিত। রাজপ্রাসাদের উত্তরসূরি হওয়ার কারণে তার নামের সঙ্গে একধরনের প্রথাগত মর্যাদা যুক্ত। আর ২০২১ সালে তিপ্রা মথা গঠন করে উপজাতি রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি করায় তিনি একসময় ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার রাজনৈতিক অবস্থান ও বক্তব্য নিয়ে আজ প্রশ্ন উঠছে সর্বত্র।

গত ৯ সেপ্টেম্বর দিল্লির যন্তর মন্তরে বক্তৃতা দিতে গিয়ে প্রদ্যোত মন্তব্য করেন যে, আগরতলা, তেলিয়ামুড়া ও কান্চনপুরের মালিক আমি। এই বক্তব্য শুধু রাজনৈতিক বিরোধীদের মধ্যেই নয়, সাধারণ মানুষের কাছেও ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। অনেকে মনে করছেন, এই ধরনের উক্তি রাজনীতিতে তাকে ধীরে ধীরে গুরুত্বহীন করে তুলছে এবং সামাজিক মাধ্যমে তিনি উপহাসের পাত্রে পরিণত হচ্ছেন।

তবে এটা ঠিক,

প্রদ্যোতের রাজনৈতিক দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু উপজাতি আবেগ। গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড দাবির মতো আবেগঘন স্লোগান ২০২১ সালের এডিসি-র নির্বাচনের আগে বিপুল সংখ্যক উপজাতি তরুণকে আকৃষ্ট করেছিল। সেই নির্বাচনে তিপ্রা মথা ২৮টির মধ্যে ১৮টি আসন জিতে প্রথমবারের মতো এডিসি-র শাসন ক্ষমতায় আসে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় আজ এটা স্পষ্ট যে, শুধুমাত্র আবেগ দিয়ে রাজনীতিতে টিকে থাকা সম্ভব হলেও উন্নয়নের পথ সুগম হয় না।

প্রদ্যোতের পরিবারিক প্রেক্ষাপটও বিতর্কের বাইরে নয়। সমালোচকদের অভিযোগ, তিনি তার বোন কৃতি সিং দেববর্মনকে বিজেপির টিকিটে পূর্ব ত্রিপুরার লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ বানিয়েছেন এবং নিজে নিরমহল সহ একাধিক সম্পত্তির দাবিদারী পেশ করেছেন আদালতে। এতে প্রশ্ন জাগছে, এসব কি সত্যিই উপজাতি স্বার্থরক্ষার প্রচেষ্টা, নাকি ব্যক্তিগত ও পারিবারিক লাভা লাভের কৌশল? কেননা, প্রদ্যোতের দাবী ত্রিপুরার কোন সরকারই এই রাজ্যের উপজাতিদের জন্য কিছুই করেনি। বর্তমান বিজেপির সরকারও কিছুই করছেনা। দিল্লির সরকারও কিছুই করছেনা। তিনি তার প্রতিটি জনসভাতে এই অভিযোগ করছেন। উপজাতি উন্নয়নের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের সাথে প্রদ্যোতের এসব বক্তব্যের কারণে রাজ্যের সর্বত্র একটা অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়ে আছে। অথচ জনসভায় প্রদত্ত তার বক্তব্যের সাথে বহু ক্ষেত্রেই বাস্তবের কোন মিল নেই।

বলতে গেলে, রাজাদের শাসনে ত্রিপুরার

উপজাতি অঞ্চলে তেমন কোন উন্নয়নমূলক কাজ হয়নি। রাজ্যের পাহাড়ী এলাকাতে উন্নয়নের মূল ধারা শুরু হয়েছিল ১৯৭৮ সালে, বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর। শিক্ষা, চাকরি, রাবার চাষ, স্বাস্থ্য, আবাসন প্রতিটি ক্ষেত্রে বিপুল উন্নয়নমূলক কাজ শুরু হয়। হাজার হাজার উপজাতি তরুণ সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করে। কিন্ত ৮০ এর দশকে একাধিক জাতিগত দাঙ্গা ও ৯০ এর দশক থেকে ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাসী কার্যকলাপের কারনে টানা বহু বছর ত্রিপুরার উন্নয়নমূলক কার্যক্রম একরকম বন্ধ ছিল।

১৯৮২ সালে ত্রিপুরা ট্রাইবাল এরিয়া অটোনোমাস ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল (TTAADC) গঠিত হয়, পরে ১৯৯৫ সালে এটি ষষ্ঠ তফসিলভুক্ত সাংবিধানিক মর্যাদা পায়। এই প্রতিষ্ঠান উপজাতি উন্নয়নের অন্যতম স্তম্ভে পরিণত হওয়ার কথা ছিল। যদিও এডিসি-র শাসন ক্ষমতা সর্বদাই কোন না কোন উপজাতি দরদি রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বের হাতেই ছিল কিন্ত তার পরেও সমতল এলাকার সমানতালে ত্রিপুরার পাহাড়ী উপজাতি এলাকার বাসিন্দাদের বিকাশ হয়নি। তবে এটাও ঠিক যে, কংগ্রেস সরকারের সময়েই এডিসি গঠিত হয়েছিল। কিন্ত ত্রিপুরার উপজাতি এলাকার উন্নয়নের এই ঐতিহাসিক পদক্ষেপ পরিচালনগত সমস্যার কারণে সফল হয়নি। তবে, বামফ্রন্ট আমলে রাস্তাঘাট, ত্রিপুরার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্য অবকাঠামোর প্রসার পাহাড়ের উন্নয়নকে কিছুটা সুদৃঢ় করে। প্রদ্যোতের বাবা কীরীট বিক্রম দেববর্মন ও মা বিভূ দেবীও কংগ্রেস রাজনীতির সুযোগ নিয়ে সাংসদ ও মন্ত্রী হয়ে ছিলেন। কিন্ত ত্রিপুরার উপজাতিদের সার্বিক উন্নয়নে তাদের অবদানের কথাও স্বর্নাক্ষরে লেখার মতন নয়। দ্বিমুখী রাজনীতি ও উপজাতিদের জন্য কিছু না করার সমালোচনার শিকার তারাও।

একই ধারাবাহিকতায়

সমালোচকরা মনে করেন, প্রদ্যোত কিশোর দেববর্মনও একই পথের পথিক। একদিকে উপজাতি আবেগকে ব্যবহার করে তিনি নিজেকে উপজাতিদের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে তুলে ধরতে চান, অন্যদিকে পারিবারিক ও ব্যক্তিগত স্বার্থ পূরণের ফন্দি খুঁজেন। এই দ্বিমুখী চরিত্র তার রাজনৈতিক ভাবমূর্তিকে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

ত্রিপুরায় এখন আগরতলা বিমানবন্দর প্রদ্যোতের দাদু বীরবিক্রম এর নামে (MBB Airport)। এই আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর সম্প্রসারিত হয়েছে ২০২১ সালে। ত্রিপুরার রেল সংযোগ পৌঁছে গেছে সাব্রুম পর্যন্ত, উপজাতি এলাকাতে বহু নতুন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। অথচ প্রদ্যোত দাবি করছেন উপজাতিদের উন্নয়নে ত্রিপুরাতে কিছুই হয়নি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভাষা, সংস্কৃতি, জমির অধিকার সব কিছু থেকেই নাকি উপজাতিরা বঞ্চিত।

অনেকেই মনে করছেন, প্রদ্যোতের এই দাবী বাস্তবতাকে অস্বীকার করার নামান্তর এবং মূলত মুখ্যমন্ত্রীর আসনে পৌঁছানোর রাজনৈতিক চাল মাত্র। আর এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই দলভাঙা-গড়ার রাজনীতি করে কংগ্রেস থেকে বিজেপির শীর্ষ নেতাদের সহযোগীতা নিয়ে তিপ্রা মথা দলের প্রতিষ্ঠা করেন। ২০২১ সালের ৫ মার্চ তৎকালীন আই এন পি টি (INPT), টি এস পি (TSP) সহ একাধিক দল তিপ্রা মথাতে মিশে যায়। তার পর ২০২১ এর এডিসি-র নির্বাচন ও ২০২৩ সালের রাজ্য বিধানসভার ভোটে দারুণ ফলাফল করে দুই জায়গাতেই এখন প্রদ্যোতের তিপ্রা মথা দলের হাতেই রাজ্যের শাসন ক্ষমতা। কিন্ত তার পরেও ত্রিপুরার উপজাতিদের সার্বিক উন্নয়নে কেউ কিছুই করছেনা দাবী তুলে ত্রিপুরা জুড়ে একটা কৃত্রিম অস্থিরতার সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। প্রতিনিয়ত

বাঙালি বনাম উপজাতি দ্বন্দ্ব উসকে দেওয়া হচ্ছে। কখনও

পৃথক রাজ্যের দাবি তুলা হচ্ছে। কখনও সমস্যার সাংবিধানিক সমাধানের কথা বলা হচ্ছে। বাঙ্গালীদের বাংলাদেশী আখ্যা দিয়ে কখনও বিদেশী বিতারনের আন্দোলনের কথা বলা হচ্ছে। মোট কথা রাজ্য জুড়ে অস্থিরতা সৃষ্টির সব চেষ্টা চলছে। অথচ পাহাড়ের সত্যিকারের বিভিন্ন সমস্যা, রাস্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কাজ, পানীয় জলের সঙ্কটের প্রকৃত সত্য গুলো চাপা পড়ে যাচ্ছে বিভিন্ন আকথা কুকথার আড়ালে। আর জাতি উপজাতি উভয় অংশের সাধারণ মানুষ এখন এসবের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে সরব হচ্ছেন। কেননা, সব সময়ই সবাইকে বিভ্রান্তির মধ্যে রাখা যায় না। যে মানুষ রক্ত-ঘাম দিয়ে সংগ্রাম করেছে, পাশে থেকেছে, প্রতারিত সেই লোকটি একদিন প্রতারণার মুখোশ ছিঁড়ে ফেলতে খড়্গহস্ত হবেই। শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশের পর যার সাম্প্রতিক সর্বশেষ উদাহরণ হল নেপাল। আজ বাঙালি হোক বা উপজাতি, হিন্দু হোক বা মুসলিম, খ্রিস্টান হোক বা বৌদ্ধ, এ রাজ্যের মানুষ অনেক বেশি সচেতন। সত্য-মিথ্যার পার্থক্য তারা বোঝে। হয়তো সময় লাগবে, কিন্তু মিথ্যার ওপর দাঁড়ানো রাজনীতি একদিন ভেঙে পড়বেই।

প্রদ্যোত কিশোর দেববর্মনের রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয়েছিল আশার আলো নিয়ে। কিন্তু ক্রমে তার কর্মকাণ্ড, দ্বিমুখী অবস্থান ও বিভাজনের কৌশল অনেকের মনে সন্দেহ জাগাচ্ছে। তিনি কি সত্যিই উপজাতি সমাজের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত, নাকি রাজপরিবারের উত্তরাধিকার ও ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষার রাজনীতি করছেন, এই প্রশ্ন আজ সর্বত্র।

ত্রিপুরার মানুষ ধীরে ধীরে এর উত্তর খুঁজছে। কারণ জনগণ জানে, মিথ্যার ছায়া যতই দীর্ঘ হোক না কেন, সূর্যের আলোয় তা একদিন মিলিয়ে যাবেই। ( লেখক জয়ন্ত দেবনাথ একজন সিনিয়র সাংবাদিক ও ত্রিপুরার ইনফো-র সম্পাদক)



আরও পড়ুন...


Post Your Comments Below

নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।

বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।

Free Download Avro Keyboard

Fields with * are mandatory





Posted comments

Till now no approved comments is available.