দ্য বেঙ্গল ফাইলসঃ শৈল্পিক সূক্ষতার বিপ্রতীপ
শঙ্খশুভ্র দেববর্মণ
September 8, 2025
‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস' এমনই একটি চলচ্চিত্র, যার প্রতিটি মন্তাজ দর্শককে প্রবল অস্বস্তিতে আছন্ন করে রাখে । রক্তক্ষয়ী সহিংসতার অবিকল চিত্রণ অশান্ত করে তুলে মন । ১৯৪৬ সালে মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্রের দাবিতে মহম্মদ আলী জিন্নাহ’র ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’র আহ্বান এবং তার ফলশ্রুতি স্বরূপ কলকাতায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ওপর নির্মিত চলচ্চিত্রটি বিবেক অগ্নিহোত্রীর 'ফাইলস' ট্রিলজির তৃতীয় নির্মাণ । উল্লেখ্য, কলকাতার সেই রক্তাত্ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিষয়টি আজও বহুল চর্চিত এবং বিতর্কিত,; অগ্নিহোত্রী তাঁর এই চলচ্চিত্রে বিষয়টিকে রাখঢাক না করে সরাসরি উত্থাপন করেছেন । ফলাফল একটি ঐতিহাসিক ডক্যুড্রামা ! চলচ্চিত্রটিকে এই সময়ে কিছু মানুষের কাছে প্রচারধর্মী মনে হলেও , এ কথা অনস্বীকার্য যে, ভারতীয় ইতিহাসের একটি অধ্যায়কে এর আগে ইচ্ছাকৃতভাবে জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে অনুল্লেখিত করে রাখা হয়েছিল। এবার সেই ঘটনাবলী তুলে ধরা হল সেল্যুলয়ডে ! সমসাময়িককালে পশ্চিমবঙ্গে এক মহিলা সাংবাদিকের অন্তর্ধানের রহস্যকে কেন্দ্র করে এগোয় এই চলচ্চিত্রের কাহিনী। প্রসঙ্গক্রমেই বর্ণিত হতে থাকে অতীতের ভয়াবহ ঘটনাপ্রবাহের পদাবলী । প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টার দৈর্ঘ্য সত্ত্বেও, চলচ্চিত্রটি বিস্তৃত ভাবে দর্শকের সামনে উপস্থাপন করে দেশ ভাগের প্রাক্কালে সংঘটিত কিছু অস্বস্তিকর আখ্যান । আত্ম প্রতিবিম্বনের মতই দর্শকও যেন সেই সব বিষয়াদি মগ্ন বিমর্ষ অবস্থাতেই দেখতে বাধ্য হন ।
গল্পটি শুরু হয় সিবিআই অফিসার শিব পণ্ডিতের (দর্শন কুমার) মাধ্যমে, যিনি সাংবাদিক গীতা মণ্ডলের অন্তর্ধানের তদন্তে নিয়োজিত। সন্দেহের তীর নিবদ্ধ ছিল স্থানীয় বিধায়ক সর্দার হোসেনীর (শ্বাশত চট্টোপাধ্যায়) ওপর, কিন্তু শিব পন্ডিতের জোরালো প্রচেষ্টা সত্ত্বেও প্রমাণ অধরা থেকে যায়। মামলাটি যখন থমকে যায়, তখন অপ্রত্যাশিতভাবে আখ্যানে অবতীর্ণ হন ভারতী বন্দ্যোপাধ্যায় (পল্লবী জোশী) নামে একজন বয়স্ক মহিলা যাঁর ক্ষীণ স্মৃতিই ক্রমে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে ওঠে। তাঁর স্মৃতিচারণার মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রে আখ্যায়িত হয় দেশভাগের আগের বছরগুলিতে, কলকাতায় ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে এবং নোয়াখালী হত্যাকাণ্ডের নৃশংস বিবরণ । এই দৃশ্যগুলো দর্শকের সামনে তুলে ধরে অবিভক্ত বাংলার সেই ক্ষতবিক্ষত দিনগুলির কথা । ফের মনে করিয়ে দেয় ভারতের তৎকালীন স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অন্ধকারাচ্ছন্ন অধ্যায়ের কিছু রক্তাত্ত কাহিনী !
চলচ্চিত্রে অনিবার্য হিসেবে চিত্রায়িত হয় গোপাল মুখার্জির ভূমিকা। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি গোপাল চন্দ্র মুখার্জি ওরফে গোপাল পাঁঠা ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে-তে কলকাতাকে 'পাকিস্তানের অংশ' হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করেছিলেন। বিবৃতির প্রথম অংশটি সঠিক। হ্যাঁ, এই সাড়ে তিন ঘণ্টার চলচ্চিত্রে দেশভাগ ও স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ের বেশ কিছু ঘটনা পুনঃসৃষ্টি করা হয়েছে, যেখানে আমরা একদিকে গান্ধী এবং অন্যদিকে জিন্নাহ’র অবস্থান দেখি। দেখি ভারত থেকে ব্রিটিশদের অনিচ্ছাকৃত প্রস্থানের মধ্য দিয়ে জিন্নাহর মুসলিম পাকিস্তানের দাবি বাস্তবায়নের দৃশ্য ! তারপর গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস নামে কুখ্যাত সেই নারকীয় হত্যাকান্ড চলে তিন দিন ধরে! সেই সময় কলকাতার পুলিশ বাহিনীকে নির্বাক দর্শকের ভূমিকা পালন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। মুসলিম লীগের শাসনাধীন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর তত্ত্বাবধানে উন্মত্ত মুসলিম জনতা কলকাতায় হিন্দুদের লক্ষ্য করে হামলা চালায়। একাধিক ঐতিহাসিক সূত্র অনুযায়ী, সেই সময়ে গোপাল পাঁঠার সক্রিয় বিরোধিতা না থাকলে কলকাতার পতন ঘটত। কলকাতা হয়ে যেতো পূর্ব পাকিস্তানের অংশ । গোপাল পাঁঠার ভূমিকা তাই এখানে গুরুত্বপূর্ণ । তবে পাঁঠা এই চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্র নন। উল্লেখ্য যে, গোপাল পাঁঠা নাকি সেই দাঙ্গার সময় অনেক নিরাপরাধ মুসলিমের জীবনও বাঁচিয়েছিলেন !
অগ্নিহোত্রী তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে দৃঢ় এবং অবিচল। তিনি তাঁর এই চলচ্চিত্রে স্পষ্টভাবে দেশ ভাগের জন্য জিন্নাহর জেদকেই দায়ী করেন। পাশাপাশি মহাত্মা গান্ধীকে চিত্রিত করেন একজন দুর্বল নেতা হিসেবে , যার অহিংসার নীতি এবং আদর্শ নৃশংসতার সামনে হয়ে উঠে অপ্রাসঙ্গিক তথা বিপর্যয়কর ! এই ছবির একটি বিশেষভাবে অস্বস্তিকর মুহূর্তে দেখা যায়, ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’র সময় কলকাতায় হিন্দুদের রক্ষাকর্তা হিসেবে অভিহিত গোপাল পাঁঠা অনশনরত গান্ধীকে জিজ্ঞাসা করেন,হিন্দু নারীরা কীভাবে আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করবেন। গান্ধীজী তখন তাঁকে প্রতিরোধের বদলে উপবাস এবং এমনকি আত্মহননের পথ বেছে নেওয়ার পরামর্শ দেন।
সত্যিকারের ঘটনা হোক বা না হোক, এই ছবি অহিংসা নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত গান্ধীজীর বিভিন্ন পন্থা পদ্ধতিকে ব্যর্থ হিসাবেই চিত্রায়িত করে। শৈল্পিক সূক্ষ্মতা প্রদর্শনের বিপ্রতীপে অগ্নিহোত্রী বরং তাঁর 'দ্য বেঙ্গল ফাইলস'এ শক ভ্যালুর ওপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। শিউরে উঠার মতো একের পর এক রক্তাত্ত দৃশ্য পর্দায় ভেসে উঠে। নারীদের হত্যা করে তাদের দেহ কসাইখানার হুকে ঝুলিয়ে রাখা কিম্বা পুরুষদের দু'টুকরো করে ফেলার দৃশ্যগুলি ভয়ানক দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়! অবিভক্ত বাংলার আসল কসাই যুবক গোলাম সারওয়ার হুসাইনি, যিনি ১৯৪০-এর দশকের হিন্দু জনগোষ্ঠীকে গলা টিপে ধরার জন্য হিংসার পথ বেছে নিয়েছিলেন - তার চরিত্রে নমশি চক্রবর্তী যাবতীয় ক্রুরতা ফুটিয়ে তুলতে সমর্থ হয়েছেন। পরবর্তীকালে স্বাধীন ভারতে বয়স্ক গোলাম সারওয়ার হুসাইনি অবতীর্ণ হন চতুর রাজনীতিবিদ সর্দার হুসেনী নামে। তিনি তখন 'সীমান্তের ওপার থেকে অবৈধদের নির্বাসন, তাদের পরিচয়পত্র প্রদান, জনবিন্যাস পরিবর্তন এবং ভোট-ব্যাংক তৈরি করার' মতো অপকর্মে জড়িত। সর্দার হুসেনীর চরিত্রের কুটিলতা সক্ষমতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়।
দর্শন কুমার শিব পণ্ডিতের চরিত্রে বিশ্বাসযোগ্য, একজন মানুষ হিসেবে যিনি নৈতিক দ্বন্দ্বে জর্জরিত, দেশের রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক যন্ত্রে আটকে পড়েছেন। পল্লবী জোশী, বৃদ্ধা ভারতী ব্যানার্জির চরিত্রে, একটি কাল্পনিক ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। তাঁর মাধ্যমেই বর্ণিত হয় অতীতের দুঃখজনক ঘটনাবলী। অসাধারণ অভিনয় করেছেন তিনি। মিঠুন চক্রবর্তীর উপস্থিতি আসলে প্রতীকী, অন্যদিকে অনুপম খের মহাত্মা গান্ধীর চরিত্রে সঠিক অভিনয়ের ছাপ রেখেছেন। রাজেশ খেরা জিন্নাহকে জীবন্ত করে তোলেন, এবং একই রকম ভাবে সুহরাওয়ার্দীর চরিত্রকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলেন মোহন কাপুর । সিমরত কৌর, তরুণ ভারতীয় নারী হিসেবে, দর্শক মনে ছাপ রাখেন, কিন্তু সবাইকে ছাপিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠেন নবাগত একলব্য সুদ। তাঁর অমর, শিখ সৈনিকের চিত্রায়ন আত্মবিশ্বাস ও আবেগের মিশেল নিয়ে যথাযথভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। দর্শক সাধারণের নজর কেড়েছেন তিনি।
দেশ বিভাজনের বিভিন্ন কাহিনী প্রায়শই উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত—পাঞ্জাব, সিন্ধু এবং সেখানে বাস্তুচ্যুতির ভয়াবহতার উপর কেন্দ্রীভূত। স্থানীয় বাংলা সাহিত্য বা সিনেমায় মাঝেমধ্যে উল্লিখিত হলেও সর্ব ভারতীয় স্তরে সেই ভাবে উচ্চারিত হয় নি বাংলা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের ট্র্যাজেডির কথা । উপেক্ষিত রয়ে গিয়েছে বাংলা তথা উত্তরপূর্বাঞ্চলের কথা। হারিয়ে গিয়েছে অনেক কথাই । বিবেক অগ্নিহোত্রী এই অকথিত ট্র্যাজেডির বৃত্তান্ত তুলে ধরেছেন । যতই অস্বস্তিকর বা অপ্রিয় হোক না কেন দর্শকদের সামনে তুলে ধরেছেন কিছু রূঢ় বাস্তবতা। অবশ্যই দ্য বেঙ্গল ফাইলস’এ বিতর্ক সৃষ্টির সব উপাদান রয়েছে: বিতর্কিত এর ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি বা বিশ্লেষণ, নির্দিষ্ট নেতাদের উপর দোষারোপ, এবং সহিংসতার উপর গুরুত্ব আরোপ করা। তবুও, এমন সব বাহুল্যের মধ্যেও ,ছবিটি নিঃসন্দেহে দর্শকদের আবেগগত স্তরে সংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে, যা রাজনীতির সীমানা ছাড়িয়ে হয়ে উঠে মানুষের দুর্দশার আখ্যান ।
The Bengal Files movie cast: Mithun Chakraborty, Pallavi Joshi, Darshan Kumar, Namashi Chakraborty, Anupam Kher, Simrat Kaur, Saswata Chatterjee, Priyanshu Chatterjee, Dibyendu Bhattacharya, Sourav Das, Mohan Kapur, Rajesh Khera, Puneet Issar, Palomi Ghosh
The Bengal Files movie director: Vivek Ranjan Agnihotri
The Bengal Files movie rating: 1.5 stars
আরও পড়ুন...