ক্লাউডবার্স্ট, বিপর্যয়ের মাত্রা বাড়ছে
পান্নালাল রায়
August 25, 2025
সাম্প্রতিক কালে দেশ বিদেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘন ঘন এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ছে।মেঘ ভাঙ্গা বৃষ্টি আর হড়পা বানে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে জনপদ, মৃত্যু ঘটছে শত শত মানুষের। সম্প্রতি জম্মু ও কাশ্মীরে মেঘ ভাঙ্গা বৃষ্টির কবলে পড়ে অর্ধ শতাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটেছে,আহত ও নিখোঁজ হয়েছে আরও বহুমানুষ।ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরের মতো সাম্প্রতিক কালে পাকিস্তানেও এমন ঘটেছে। মেঘ ভাঙা বৃষ্টির কবলে পড়ে দেশটিতে শত শত মানুষের মৃত্যু ঘটেছে।কিন্তু মেঘ ভাঙ্গা বৃষ্টির বিষয়টা কি? কেনই বা এমন বিধ্বংসী বর্ষণ ঘটছে?
প্রথমেই আসা যাক ভূস্বর্গে সাম্প্রতিক বিপর্যয় প্রসঙ্গে।একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে জম্মুর কিস্তয়ার জেলায় বহু পুণ্যার্থী মানুষ সমবেত হয়েছিলেন। পুণ্যার্থীদের জন্য অস্হায়ী ছাউনি করাও হয়েছিল। হঠাৎই শুরু হয়ে যায় মেঘ ভাঙা বৃষ্টি।বলা যায় বিধ্বংসী বর্ষণ।বর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে উঁচু জায়গা থেকে নেমে আসা হড়পা বান পুণ্যার্থীদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়।ভেসে যায় তাদের শিবিরের অস্হায়ী তাবুগুলোও।বিধ্বস্ত হয় পুণ্যার্থীদের লঙ্গরখানাও।শত শত পুণ্যার্থী নিখোঁজ হয়ে পড়েন।ঘটনার পর শুরু হয় উদ্ধার কার্য।অনেক পুণ্যার্থীকে উদ্ধার করা হয় যাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ছিলেন গুরুতর আহত।শুধু পুণ্যার্থীদের লঙ্গরখানা আর তাঁবুই নয়,এলাকার অনেক দোকানপাট, ঘরবাড়ি,অট্টালিকা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়।এ পর্যন্ত প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী মেঘ ভাঙ্গা বৃষ্টি ও হড়পা বানে ষাট জনের মৃত্যু ঘটেছে,আহত হয়েছে শতাধিক। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।তবে এই বিপর্যয়ের পর আশ্চর্যজনক ভাবেও কেউ কেউ রক্ষা পেয়েছে।এর মধ্যে কাদার ভেতর থেকে তুলে আনা ছয় বছরের এক কিশোরও রয়েছে।জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ বর্ষণ বিধ্বস্ত অঞ্চল পরিদর্শন করে দুর্গত পরিবারের জন্য সরকারি সহায়তার কথা ঘোষণা করেছেন। মেট্রোলজিক্যাল দপ্তর থেকে পূর্বাহ্ণে এই বিপর্যয়ের সতর্কবার্তা ও এ বিষয়ে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া সম্পর্কে তদন্ত হবে বলেও মুখ্যমন্ত্রী জানান।প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্যপাল এবং মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে পরিস্হিতি সম্পর্কে অবহিত হন এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সার্বিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন। বিধ্বস্ত এলাকা সফরকালে মুখ্যমন্ত্রী আবার ক্ষতিগ্রস্ত ও স্বজন হারানো মানুষের ক্ষোভের মুখেও পড়েন। উদ্ধার কাজ ত্বরান্বিত করার জন্যও মুখ্যমন্ত্রীর কাছে দাবি জানান তারা।এদিকে কিস্তয়ার ঘটনার তিনদিন পর জম্মু ও কাশ্মীরের কাথুয়া জেলায় মেঘ ভাঙ্গা বৃষ্টি ও ধস নামার দুটি পৃথক ঘটনায় আবার সাত জনের মৃত্যু ঘটেছে।আহত হয়েছে পাঁচ জন। ঘরবাড়ি,রাস্তাঘাট বিধ্বস্ত হয়েছে।এদিকে মেঘভাঙ্গা বৃষ্টিতে পাকিস্তানেও প্রায় সাড়ে তিনশো লোকের মৃত্যু ঘটেছে।উত্তর পশ্চিম পাকিস্তানের বিস্তীর্ণ এলাকা মেঘভাঙ্গা বৃষ্টি ও হড়পা বান জনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত হয়েছে।খাইবার পাখতুনখোয়া অঞ্চল সহ পাক অধিকৃত কাশ্মীরের গ্রামের পর গ্রাম হড়পা বানে ভেসে যায়।উদ্ধারকারীরা উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।এখনও অনেক মানুষ নিখোঁজ রয়েছেন। মৃতের সংখ্যা আরও অনেক বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।বিপর্যস্ত এলাকার অনেকে বলছেন, হঠাৎ কোথা থেকে বানের জল এল তারা বুঝতেই পারছেন না।পাহাড়ের মেঘ ভাঙা বৃষ্টির ফলে হড়পা বানে ভেসে গেছে নিচের গ্রামের পর গ্রাম। এ বছর জুন মাস থেকে এখন পর্যন্ত পাকিস্তানে ক্লাউডবার্স্ট ও হড়পা বানে ৬৫৭ জনের মৃত্যু ঘটেছে।২০২২ সালেও এ ধরণের বিধ্বংসী বর্ষণে পাকিস্তানে প্রায় ১৭০০ লোকের মৃত্যু ঘটেছিল।
এবার আসা যাক ক্লাউডবার্স্ট বা মেঘ ভাঙ্গা বৃষ্টি ও হড়পা বানের কথায়।সাম্প্রতিক কালে ঘন ঘন এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কবলে পড়ছে পাহাড়ি অঞ্চল সহ সন্নিহিত এলাকা।খুব অল্প সময়ের মধ্যে কোনও এলাকায় প্রচুর পরিমাণে বর্ষণ হলে তা ক্লাউডবার্স্ট বলে চিহ্নিত হয়ে থাকে। এ ধরণের বর্ষণে দ্রুত জমা বিপুল জলরাশি ভয়াবহ বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে।যেমন ২৫ মি মি বর্ষণে প্রতি বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ২৫ হাজার মেট্রিক টন জলরাশি হয়,যা হড়পা বানের সৃষ্টি করে সব কিছু ভাসিয়ে নিতে পারে। আরও স্পষ্ট করে বললে,মেঘ ভাঙ্গাবৃষ্টি বা ক্লাউডবার্স্ট হচ্ছে খুব অল্প সময়ে সীমিত এলাকায় তীব্র বর্ষণ।এক ঘন্টারও কম সময়ে ১০ সে:মি:'র বেশি বর্ষণ হলে এমনটা হতে পারে।প্রায়শ স্হানীয় ভাবেই আকাশে জমা এই মেঘ ভাঙ্গা বৃষ্টিতে প্রবল বন্যা ও ভূমিধসজনিত বিপর্যয় ঘটে থাকে।
দেশ বিদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মেঘ ভাঙ্গা বর্ষণ ও হড়পা বানজনিত বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটছে।সাম্প্রতিক কালে তার মাত্রা যেন বেড়েই চলেছে।২০১৩ সালে উত্তরাখণ্ডের মেঘ ভাঙ্গা বর্ষণজনিত ভয়াবহ বিপর্যয়ের কথা আমাদের কাছে দুঃসহ স্মৃতি হয়ে আছে।সেবার উত্তরাখণ্ড,হিমাচল প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ এবং নেপালের কিছু অংশে এই বিপর্যয়ে ছয় সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল প্রায় সাড়ে চার হাজার গ্রাম। এর মধ্যে মৃত্যু সহ সামগ্ৰিক ক্ষয়ক্ষতির নব্বই ভাগ হয়েছিল উত্তরাখণ্ডেই।লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থী পর্যটক আটকে পড়েছিলেন।ভারতে মেঘ ভাঙ্গা বৃষ্টি জনিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে রয়েছে ২০০৫ সালের মুম্বইয়ের ঘটনা।৮-১০ ঘন্টার মধ্যে ৯৫০ মিমি বৃষ্টির ফলে ব্যাপক বন্যা এবং প্রায় সহস্র মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল। ২০০৭ সালে হিমাচল প্রদেশে ক্লাউডবার্স্টে ৫২ জন,২০০৯ সালে উত্তরাখণ্ডে ৩৮ জন,২০১০ সালে লেহ(লাদাখে) ১০০০, ২০২১ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের হুনজারে ৪৪জন এবং ২০২২ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের অমরনাথে ১৬ জনের মৃত্যু ঘটে ক্লাউডবার্স্টের ফলে।নিখোঁজ ও আহত হয় বিস্তর। আর সাম্প্রতিক ঘটনা হচ্ছে উত্তরাখণ্ডের উত্তর কাশী,যেখানে চার জন নিহত ও বহু মানুষ নিখোঁজ হয়েছেন মেঘ ভাঙ্গা বৃষ্টিতে।বিধ্বস্ত হয়েছে অনেক বাড়িঘর,দোকানপাট, হোটেল। সর্বশেষ ঘটনা জম্মু ও কাশ্মীরের।সেখানে মৃতের সংখ্যা যেমন বাড়ছে,তেমনই নতুন ভাবে একাধিক স্হানে মেঘ ভাঙ্গা বৃষ্টি আর হড়পা বানজনিত বিপর্যয়ের খবরও পাওয়া যাচ্ছে।
মেঘ ভাঙ্গা বর্ষণজনিত বিপর্যয়ের আধিক্য শুধু যে পাহাড়ি অঞ্চলেই ঘটছে এমনটা কিন্তু নয়।অল্প সময়ে সীমিত এলাকায় অধিক বর্ষণ যে কোনও অঞ্চলেই বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।যেমন গত বছর ত্রিপুরায় এমনটা ঘটেছিল। অল্প সময়ে অস্বাভাবিক বর্ষণ ত্রিপুরায় প্রবল বন্যার সৃষ্টি করেছিল।ত্রিপুরাতে সারা বছরে গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ প্রায় ২২০০ মি.মি.।এর মধ্যে বেশিরভাগই হয় বর্ষা মরশুমে।গোটা আগষ্ট মাস জুড়ে ত্রিপুরায় যে পরিমাণ বৃষ্টিপাতের কথা তা যদি মাত্র দুদিনেই হয়ে যায় তবে অবস্থাটা কেমন হতে পারে?গত বছর আগষ্ট মাসের শেষ দিকে রাজ্যে এমনটাই ঘটেছিল। ডেকে এনেছিল ভয়াবহ প্লাবন।সেবার রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে ধসও নেমেছিল। ধস ও বন্যায় বহু মানুষের মৃত্যু সহ রাজ্যের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল, যেমনটা দীর্ঘকালের মধ্যে ত্রিপুরায় দেখা যায়নি।সমতল অঞ্চলে ঘটলেও মেঘ ভাঙ্গা বর্ষণজনিত বিপর্যয়ের তীব্রতা কিন্তু পাহাড়ি এলাকায় অনেক বেশি অনুভূত হয়।মেঘভাঙ্গা বৃষ্টি হড়পা বানের সৃষ্টি করে।উঁচু এলাকা থেকে নিচের দিকে ধেয়ে আসে প্রবল জলরাশি।ভাসিয়ে নিয়ে যায় ঘরবাড়ি,জনপদ।ঘটে বিপুল সম্পদ ও জীবন হানি।মেঘ ভাঙ্গা বর্ষণ আর হড়পা বানে ধস নামে পাহাড়ি এলাকায়।মাটির নিচে চাপা পড়ে যায় ঘরবাড়ি সহ মানুষ।এ কারণেই হিমালয় অঞ্চল উত্তরাখণ্ড,কাশ্মীর,হিমাচল প্রদেশ প্রভৃতিতে হড়পা বান,ধস ও মৃত্যু বেড়ে যায়।ধস প্রসঙ্গে বলা যায় উত্তর পূর্বাঞ্চলেও ভূমিধসের বিপদ বেড়ে চলেছে।প্রায় প্রতিবছরই এই অঞ্চলের বিভিন্ন রাজ্যে ভূমিধসে বেশ কিছু মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।গত বছর শুধু ত্রিপুরাতেই ভূমিধসে ১৯ জনের মৃত্যু ঘটেছিল। উল্লেখ করা যায় যে,সারা দেশের মধ্যে উত্তর পূর্বাঞ্চল খুবই ভূমিধস প্রবণ অঞ্চল। গোটা দেশের ভূমিধস প্রবণ অঞ্চলের ৪২ শতাংশই রয়েছে উত্তর পূর্বাঞ্চলে।এর মধ্যে মিজোরাম, মেঘালয়,নাগাল্যান্ড ও অসম সর্বাধিক ভূমিধস প্রবণ। বৎসরাধিক কাল আগে রেমালের প্রভাবে প্রবল বর্ষণে মিজোরামে ভূমিধসে মিজোরামে ৩০ জনের মৃত্যু ঘটে।সেবার নাগাল্যান্ড ও মেঘালয়েও এ জন্য জীবন ও সম্পদ হানি ঘটে।মিজোরামের ঘটনার পক্ষকাল পর ভূমি ধসে সিকিমেও ৯ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় ২০২২ সালে মণিপুরের টুপুলে ভয়াবহ ভূমিধসের কথাও।সেখানে রেলপথের নির্মাণ কাজের সুরক্ষায় নিয়োজিত সেনাদের একটি পুরো শিবিরই ভূমিধসে চাপা পড়ে গিয়েছিল। পাহাড় ভাঙ্গা ধসে মাটির তলায় চাপা পড়ে গিয়েছিল নির্মীয়মাণ রেল স্টেশন। রুদ্ধ হয়ে পড়েছিল নদীর প্রবাহ। টুপুলের এই ভয়াবহ ধসে অর্ধ শতাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল। ভূমিধসের জন্য কেরলের ওয়েনাদ যে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল উল্লেখ করা যায় সে কথাও। মেঘ ভাঙ্গা বর্ষণে ভূমিধসের এ রকম আশঙ্কা যে বহুগুণ বেড়ে যায় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
কিন্তু কেন ঘন ঘন ঘটছে এমন বিপর্যয়? এ থেকে পরিত্রাণের উপায়ই বা কি?এ জন্য পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা আজ অপরিকল্পিত উন্নয়নকেই দায়ি করছেন। পাহাড় কেটে রাস্তা হচ্ছে,জলাশয় ভরাট করে ঘরবাড়ি হচ্ছে,বনাঞ্চলে চলছে নিরবচ্ছিন্ন বৃক্ষমেধ।সব মিলিয়ে পরিবেশ ও ভূমির পরিবর্তন আমাদের বিপদ ডেকে আনছে।আগে ক্লাউডবার্স্ট বা মেঘ ভাঙ্গা বর্ষণের কথা তেমনটা শোনা যায়নি।এখন ঘন ঘন তা ঘটছে। জম্মু ও কাশ্মীরে তো এক মাসেই দু'বার ঘটে গেল!জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই এ ধরণের দুর্যোগ বেড়ে চলেছে বলে মনে করা হচ্ছে। তা হলে কি এ থেকে পরিত্রাণের কোনও উপায়ই নেই? ক্লাউডবার্স্ট সম্পর্কে আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিলে ধসজনিত ক্ষয়ক্ষতি হয়তো অনেকটাই এড়ানো সম্ভব বলে স্বাভাবিকভাবেই মনে আসে।এলাকা ভিত্তিক ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণের পূর্বাভাসও এক সতর্ক বার্তা মনে করা যেতে পারে।সর্বোপরি প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার বিষয়টি সর্বাধিক জরুরী। উন্নয়ন আর ভূমি প্রকৃতি সুরক্ষার মধ্যে চাই বিজ্ঞান ভিত্তিক সামঞ্জস্য!
আরও পড়ুন...