অবিলম্বে প্রত্যেক দেশবাসীর হাতে নগদ ১০,০০০ টাকা করে দিতে হবে

পুরুষোত্তম রায় বর্মন

রাত্রি নটা নাগাদ ভূতনের ফোন। আমাদের পাড়ার ভূতন। পাড়ার বাইরে সবার কাছে কৃত্তিবাস চক্রবর্তী। কৃত্তিবাস ওরফে বিষ্ণুপদ। রাজ্যের অন্যতম শক্তিশালী কবি। গান্ধীগ্রামের রিকশা শ্রমিক গৌতম ওরফে খোকনের বিষয়ে আমার পোস্ট থেকে জেনে ফোন করে জানালো, আমি খোকনদের জন্য কিছু করতে চাই । কাল সকালের মধ্যেই ৫০০ কিলো চাল পাঠিয়ে দেব। আমি একটু সংশয়ে ৫০ না ৫০০ কিলো। আমার মনের সংশয় বোধ হয় কৃত্তিবাস আঁচ করতে পেরেছে। তাই নিজ থেকেই জোর দিয়ে বলল, ৫০০ কিলো। আজ সকালে কৃত্তিবাসের ৫০০ কিলো চাল পৌঁছে গেছে। কৃত্তিবাস আক্ষেপ করছিল, অবসরে চলে না গেলে শুধু চাল নয়, আলু, সোয়াবিন ইত্যাদিও দেওয়া যেত। আমরা সমস্বরে বললাম, তোমার সিংহ হৃদয় মানবিকতার রসে ভরপুর। আক্ষেপের কোন কারণ নেই।

সাফাই কর্মীরা এখন রাস্তায়। জীবিকার টানে এবং দায়িত্ব পালনে। আমরা মধ্যবিত্তরা যখন করোনার ভয়ে বাইরে গেটে তালা ঝুলিয়ে Stay Home কীর্তন করছি এবং মোদির দাওয়াই বিনা প্রশ্নে মেনে নিয়ে লকডাউন সেলিব্রেট করছি তখন আগরতলা পৌর নিগমের সাফাই কর্মীরা রাস্তায়। দৈনিক মজুরি মাত্র ২৩০ টাকা। ন্যূনতম মজুরির চাইতেও কম। ঘরে স্বামীরা তালাবন্দী। আগে দুজনের রোজগারে টেনেটুনে সংসার চলত। এখন একজনের রোজগার। সাফাই কর্মীদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের কর্তব্য । এই কর্তব্য পালনের উদ্দেশ্যে আজ সকালে আগরতলা শহরের একাংশে ৩০ জন সাফাই কর্মীর হাতে আমরা তুলে দিলাম ৫ কিলো করে চাল, ২ কিলো আলু, ১ কিলো সোয়াবিন। হাততালি দিয়ে এবং মোমবাতি জ্বালিয়ে সহমর্মিতা নয়। শুধু কথায় চিড়া ভিজে না। আগামী দিনগুলোতে আগরতলা শহরের বাকি সাফাই কর্মীদের পাশেও এইভাবে দাঁড়ানোর ইচ্ছা রয়েছে আমাদের।

ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত সাফাই কর্মীরা মাসিক ৪২০০ টাকা করে পান । তারা আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মী নন। বিশ্ববিদ্যালয় Tender ডেকে ঠিকাদারকে সাফাইয়ের ভার দিয়েছে। ঠিকাদার নিযুক্ত সাফাই কর্মীরা এখন বেকার। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। তাদের মাসিক ভাতা মিলবে কিনা তা অনিশ্চিত। কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় মাত্রই অফুরান টাকা। দুর্নীতির গুদামঘর। সাফাইকর্মীদের পাশে বিশ্ববিদ্যালয় নেই। কর্তৃপক্ষের কোনো দায়-দায়িত্ব নেই। তারা খেতে পেল কি না পেল এতে বিদ্যা চর্চার ব্যঘাত কেন হবে। যাই হোক আমরা সহ নাগরিকরা ওদের কথা ভুলতে পারিনা।

আজ সকাল সাতটায় ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের সামনে ৭০ জন সাফাই কর্মীর প্রত্যেকের হাতে আমরা তুলে দিয়েছি ৫ কিলো চাল, ২ কিলো আলু, ১ কিলো সোয়াবিন। কৌশিক দাস গত কাল রাত্রিতে স্বেচ্ছাসেবকদের সাথে নিয়ে ৭০ টা প্যাকেট তৈরি করেছিল। আমরা ঠিক সাতটায় পৌঁছতেই বিতরণ পর্ব শুরু। বিশ্ববিদ্যালয় বিরাট ইমারতের সারি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উদারতা ও মানবিকতার পবিত্রস্থল আজ অমানবিকতা ও অনুদারতার ভাইরাসে সংক্রমিত। সংক্রমিত প্রস্তুর শিলা রাশির সামনে সহ নাগরিকদের সহমর্মিতার প্যারেডকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিকিউরিটি গার্ডরা এসে তারিফ করে এবং আমাদেরকে বিতরণের সাহায্য করে।

চা বাগান শ্রমিকদের অবস্থা তথৈবচ। সরকার বাহাদুরের কাছে চা শ্রমিকদের দুর্দশার কথা জানিয়ে গত কয়েকদিনে বারবার স্মারক লিপি জমা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রশাসন নির্বিকার। চা শ্রমিকদের অনেকের আবার রেশন কার্ড নেই। চা শ্রমিকদের পাশে আমরা থাকার চেষ্টা করছি। আজ কৈলাশহরের মনুভ্যালি চা বাগানের অনিলা ব্যারাক ও তাঁতীপাড়ায় রেশন কার্ড ও আধার কার্ড বিহীন ৮১টি পরিবারকে তিন কিলো চাল, ৫০০ গ্রাম মুসুর ডাল, সোয়াবিন, ১ কিলো আলু, সাবান ইত্যাদি তুলে দেওয়া হয়েছে। ত্রিপুরা চা শ্রমিক উন্নয়ন সমিতি এবং Citizens Collective Against COVID 19 এর যৌর উদ্যোগে। এই কাজ আমাদের সবার হয়ে সম্পাদন করেছেন জয়দীপ রায়, বাজুধন গড়, অঞ্জনা উড়িয়া, মিহির স্বর সহ অনেকে। এক আশ্চর্য যুবক জয়দীপ। বন্ধুদের নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে তালিকা তৈরি করেছে অসীম মমতায়।

সবার সহযোগিতায় ও সর্বান্তকরণ সমর্থনে Citizens Collective Against COVID 19 সাধ্যমতো চেষ্টা করছে বিপন্ন মানুষের পাশে থাকতে। মানুষ হিসেবে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে। পত্রিকা হকারদের আয় এখন অর্ধেক হয়ে গেছে। কারণ বাইরের পত্রিকা আসেনা, কমিশনও বন্ধ। হকারদের আয়েই তাদের পরিবারগুলো চলে। আজকে গৌতমের সাথে কথা হচ্ছিল। গৌতম একজন হকার। বাড়িতে ছেলে, স্ত্রী, মা। ছেলে ইংরেজি অনার্স নিয়ে পড়ছে। গৌতম জানাল, লকডাউনের কল্যাণে রোজগার কমে অর্ধেক হয়ে গেছে। এখন চার হাজার টাকাও আয় হয় না। গৌতম কে সাহস দিলাম। আপাতত কিছু ব্যবস্থা গৌতমের জন্য করা হয়েছে। আগরতলা শহরে এমন চারশ হকার আছেন। যারা প্রতিদিন সকালে রোদ্র, বৃষ্টি, কুয়াশা ইত্যাদি অস্বীকার করে আমাদের কাছে পৌঁছে দেয় সংবাদপত্র। তাদের পাশে এখন যদি একটু না দাঁড়ায় তবে তো অকৃতজ্ঞতার গ্লানি সারাজীবন আমাদের বয়ে বেড়াতে হবে। তাই আমরা ভাবছি হকারদের পাশে কি করে দাঁড়ানো যায়।

আমাদের সাহস জোগাচ্ছেন আপনারা। আজ দুপুর ১১ টায় আমরা সবাই মিলে ত্রাণসামগ্রী প্যাকেটজাত করছি। এমন সময় দুই তরুণ বন্ধু এসে উপস্থিত। মনিরাজ রায় ও সিদ্ধার্থ সাহা। তারা আরাধিতার কাছ থেকে আমাদের কাজ সম্পর্কে জানতে পেরে দুই বস্তা চাল, আলু , ডাল ইত্যাদি নিয়ে এসেছে। পল্লব ফোন করে বলল, বড় ভাই তুমি বাড়ি আছোতো। আমি বললাম আছি। পল্লব বলল, আমি আসছি। ৫ মিনিটের মধ্যেই পল্লব ঘোষাল হাজির। এসেই ৫০০০ টাকা দিয়ে বলল আপাতত এইটুকু। একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মী বাড়িতে এসেছিলেন অন্যকাজে। ত্রাণ তৎপরতা দেখে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ২০০০ টাকা তুলে দিলেন বিক্রমজিৎ এর হাতে। সেবিকা দে, আরাধিতা দেববর্মারা তরুণ আইনজীবী। আদালত বন্ধ। রোজগার নেই। তবু তারা দুজন দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য মোটা টাকা চাঁদা দিয়েছে।

তেলিয়ামুড়া মাই গঙ্গায় সুকান্ত দ্বাদশ শ্রেণী বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ৩০ টি পরিবারের হাতে আজ ৫ কিলো চাল, দু কিলো আলু, সোয়াবিন, ডাল তুলে দেওয়া হয়েছে। আমাদের সবার হয়ে অভিজিৎ নমঃ ও তার বন্ধুরা এই কাজ সম্পাদন করেছেন।

আজ উদয়পুরে কর্মহীন গৃহপরিচারিকা রিকশাচালক ও রিকশাচালক, গাড়িচালক, মিড ডে মিল কর্মী সহ ৫৮ পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছি আমরা। আজ প্রতিটি পরিবারকে ৫ কিলো চাউল, দু কিলো আলু, ৫০০ গ্রাম মসুর ডাল দেওয়া হয়েছে। Citizens Collective Against COVID 19 তরফ থেকে উদয়পুরের সুপরিচিত সমাজকর্মী পার্থ কর্মকার ও তার বন্ধুরা এই দায়িত্ব সম্পাদন করেছেন। পার্থ ও তার সতীর্থরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে প্রকৃত দুঃস্থদের তালিকা তৈরি করে ত্রাণ বিলি করেছে।

সবার আন্তরিক সহযোগিতায় রাজ্যজুড়ে ত্রাণ কর্মসূচি সম্প্রশারণ করেছি আমরা। কালকে খোয়াই, উদয়পুর এবং বিলোনিয়ায় ত্রাণ বন্টন করা হবে দুর্গত মানুষদের মধ্যে। সাধারণ মানুষ নিদারুণ সমস্যায় রয়েছেন রাজ্যজুড়ে। আমরা নাগরিকরা দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করছি। কিন্তু রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকার দারুনভাবে ব্যর্থ। মানুষের পাশে নেই সরকার। মোমবাতি এবং থালি বাজানোর নির্দেশ দেওয়া ছাড়া। তাই আমাদের সমবেত কণ্ঠে দাবি তুলতে হবে, লকডাউনবন্দী দেশবাসীর যাবতীয় দায়িত্ব সরকারকে বহন করতে হবে। অবিলম্বে প্রত্যেক দেশবাসীর হাতে নগদ ১০,০০০ টাকা করে দিতে হবে। জনগণের টাকা কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিতে সরকারের কোন কার্পণ্য নেই। কিন্তু সাধারন নাগরিকদের প্রয়োজনে খরচ করতে যত আপত্তি। আসুন, আমরা সবাই সরকারকে বাধ্য করি দায়িত্ব পালনে।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.