সারা রাজ্য থেকে মানুষের বিপন্নতার সংবাদ আসছে, ১৯৭৮-এর মতো অবস্থা হবেনা তো?
পুরুষোত্তম রায় বর্মন
গৌতম দেবনাথ । ডাকনাম খোকন । আমরা খোকন বলেই জানি । গান্ধীগ্রামে সান্ধ্যনীড়ের উল্টো দিকে বাড়ি। ১৫ বছর ধরে দেখছি । মনে মনে খোকনকে তারিফ করি । খোকন পেশায় রিক্সাচালক। প্রতিদিন সকাল দশটার মধ্যে বাড়ি থেকে রিকশা নিয়ে খোকন বেরিয়ে পড়ে আগরতলার উদ্দেশ্যে। আগরতলায় রাত্র আটটা অব্দি রিক্সা চালিয়ে বাড়ি ফেরে। খোকনের দুই মেয়ে, এক ছেলে, বৃদ্ধা মা ও স্ত্রী। বড় মেয়ে বিএ পাশ করার পর খোকন বিয়ে দিয়েছে। ছোট মেয়ে দ্বাদশ অব্দি পড়েছে । ছেলে একাদশ শ্রেণীতে পড়ে। সংসারটা দাঁড়িয়ে আছে খোকনের রোজগারের উপর। বৃদ্ধা মার সামান্য পেনশন। খোকন দায়িত্বশীল পিতা, স্বামী ও পুত্র। ৩০ বছর ধরে রিকশা চালিয়ে গতড় ভাঙ্গা পরিশ্রম উদয়াস্ত করে সংসারটাকে টানছে। আজ দুপুরে আমি ও কৌশিক সান্ধ্যনীড়ে যাই। এক ঢিলে দুই পাখি মারা। সান্ধ্যনীড়ের আবাসিকদের এবং খোকনের খোঁজখবর নেওয়া। ৩০ বছরের কর্মজীবনে খোকনের এরকম পরিপূর্ণ বিশ্রামের সুযোগ এই প্রথম। লকডাউন খোকনকে ছুটি দিয়েছে । কিন্তু এ ছুটিতো খোকনদের কাছে বিড়ম্বনা । নুন আনতে পান্তা ফুরানোর সংসারে সঞ্চয়ের কোন সুযোগ থাকে না। খোকনের কাছে জানতে চাইলাম, কি ভাবে চলছে । খোকনের মুখে হাসি এখনো লেগে আছে । হেসেই বলল, দাদা , চিন্তা করবেন না , চালিয়ে নেব। ধার কব্জা করছি। ৯ দিন ধরে কোন রোজগার নেই। তারপর আত্মবিশ্বাস দেখে একটু অবাকই হই । রেশন থেকে ৩০ কিলো চাল তুলেছে । কিন্তু মাসে প্রয়োজন ৯০ কিলো চাল। বাকি ৬০ কিলোর ব্যবস্থা কি করে হবে। খোকনদের পাড়ার বাসিন্দা একটি পরিবার এখন শহরে থাকে। ওই পরিবারের ভাইবোনরা এসে পাড়ার প্রত্যেককে দু কিলো করে চাল আর কিছু আনাজ দিয়ে গেছে। লকডাউনে খোকনের জন্য সরকারের বদান্যতা মাত্র ৩০ কিলো চাল । খোকনের দুই পা এখন তালাবন্দী। সরকার তালাবন্দী করে দিয়েছে। লকডাউনের পূর্বে দুই পা দিয়ে রিকশা চালিয়ে খোকন দৈনিক ৪০০ টাকা রোজগার করত। খোকনের রোজগার কেড়ে নিয়ে সরকার এখন খোকনদের পাশে নেই। ঘন্টা বাজিয়ে, মোমবাতি জ্বালিয়ে এবার মহাভারতের কাহিনী দেখে কি পেটের অন্ন জোগাড় হয়। আমি একজন খোকনের কথা লিখছি । এরকম খোকন তো হাজার হাজার । সরকারের উচিত ছিল খোকনদের নগদ সাহায্য করা । সমস্ত রিক্সা শ্রমিকদের অন্তত ১০ হাজার টাকা করে নগদে সাহায্য করা । শুধু রিক্সা শ্রমিক নয় অসংগঠিত ক্ষেত্রের সমস্ত শ্রমিকদের এবং গরীব মানুষদের সবাইকে ন্যূনতম ১০ হাজার টাকা করে নগদ প্রদান করা। না তা করবে না সরকার বাহাদুর। খালি পেটে থালি বাজাও । এতে ক্ষুধা দূর হবে। আর মোমবাতি জ্বালাও। করোনা পালাবে। পেটের তাড়নায় পুলিশের লাঠি পিঠে নিয়ে রিকশা শ্রমিকরা সকালে আগরতলায় বের হতে চেষ্টা করে রোজগারের আশায় । কালকে দেখলাম এক মন্ত্রী মশায় হুমকি দিয়েছেন, রিক্সা শ্রমিকদের, রাস্তায় বের হওয়া যাবে না। বের হলে কিন্তু পুলিশ কড়া দাওয়াই দেবে। মন্ত্রী মশাই রিক্সা শ্রমিকদের বলেছেন নুন ভাত খেয়ে বাড়িতে থাকতে হবে। নুন ভাত খেতে হলে খোকনের মাসে ৯০ কিলো চাল প্রয়োজন। ৩০ কিলো পাওয়া গেল রেশন থেকে। বাকি ৬০ কিলোর ব্যবস্থাটা সরকার করে দিক। খোকনরা পুলিশের লাঠি খেতে রাস্তায় বেরোবে না রিকশা নিয়ে।
পার্বতী দাস। অসুস্থ। সরকারি হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় জীবন এখন দুর্বিষহ । বন্ধাত্বকরণের অপারেশন করতে গিয়ে মলাশয় কেটে ফেলেছে আইজিএম হাসপাতালে চিকিৎসকরা । এখন পেটে ফুটো করে পলিথিনের ব্যাগ। ঐ ব্যাগে মল এসে জমা হয় । প্রতিমাসে ৪ থেকে ৬ টি ব্যাগ প্রয়োজন। দাম পড়ে কম করেও ১২০০ / ১৫০০ টাকা । স্বামী রিকশাচালক। অসুস্থ স্ত্রীর পাশে আছে ধৈর্য সহকারে, সব দায়িত্ব পালন করে । দশ দিন ধরে পার্বতীর স্বামী ঘরবন্দী। রোজগার নেই। পার্বতীর জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় ব্যাগ কি করে কিনবে । কি করে অন্য খরচ জোগাড় করবে । রেশনের চালটাও তোলার মতো পয়সা হাতে নেই । পার্বতীরা থাকে গোর্খাবস্তির এক কোণে । এক চিলতে খাস জমিতে । আগরতলাবাসী আমাদের অনেকেরই ধারণাই নেই , পার্বতীদের বাড়ি যেতে হলে কি রকম কসরৎ করতে হয়। পার্বতীদের পাশে সরকার নেই।
খোকন ও পার্বতীদের পাশে আমরা সহ নাগরিকরা আছি। ওদেরকে আমরা বলেছি, ব্যবস্থা একটা করবই সবাই মিলে। ওদের আপাতত কয়েক দিনের চলার ব্যবস্থা আমরা করেছি।
সাধারণ মানুষের পাশে সরকার নেই। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম অসাধু ব্যবসায়ীরা বাড়িয়ে দিয়েছে । ৬০ টাকা কিলো সোয়াবিন এখন বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা কিলো। চালের দাম প্রতি কেজিতে দুই থেকে চার টাকা বেড়ে গেছে । বাজারের উপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই । মানুষের রোজগার বন্ধ। সরকার পাশে নেই । নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের ঊর্ধ্ব মূল্য এবং অকাল।
সারা রাজ্য থেকে মানুষের বিপন্নতার সংবাদ আসছে। কৌশিক দাস ফোনে জানাল, ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিকা শ্রমিকরা অসুবিধায় আছেন। প্রায় ১০০ জন রিক্সা শ্রমিক । এদের পাশে দাঁড়াতে হবে। কৌশিককে জানালাম, কিছু একটা ব্যবস্থা ওদের জন্য আমাদের অবশ্যই করতে হবে।
Citizens Collective Against COVID-19। আপনাদের সবার সমর্থনে ও শুভেচ্ছায় রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে দুর্গত মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা আমরা করছি। যদিও আমাদের এই প্রচেষ্টা সিন্ধুতে বিন্দু। আমাদের মত অনেকেই বিভিন্নভাবে সাধ্যমত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন । তাদের সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
আজ সকালে প্রবীণ অধ্যাপকের ফোন। নির্দেশ দিলেন , কাউকে পাঠা আমার কাছে। ১ লক্ষ টাকা এসে নিয়ে যাবে। অশীতিপর অধ্যাপকের কণ্ঠস্বর একই রয়ে গেছে। ৭৮ সনে যেমন, ২০২০ সনেও একই রকম। আমি বুঝে গেলাম স্যার কি বলতে চাইছেন। ভয়ে ভয়ে জানালাম, Sir, এখন ৫০,০০০ টাকা এসে নিয়ে যাব আমরা। বাকিটা পরে নেবো । হাতে যা আছে সবটা খরচ হলে পর। স্যার বললেন, ঠিক আছে। কৌশিক ও মৃন্ময় অধ্যাপক মিহির দেবের কাছ থেকে ৫০হাজার টাকা নিয়ে এসেছে । কুঞ্জবনের এক দিদিমণি বলেছিল চাল দেবে । আমরা আনবো বলেছিলাম। কিন্তু আমাদের যেতে দেরি হওয়ায় দিদিমণি নিজেই লকডাউন ভেঙ্গে গাড়ি করে ৭৫ কিলো চাল দিয়ে যাবেন । অনেকেই এভাবে সাহায্য করছেন। এর জন্যই খোকন, পার্বতী ও অন্যদের সাহস করে বলেছি, চিন্তা করবে না । আমরা আছি। সহ নাগরিকরা আছে । মহামারী আমাদের মনকে গিলতে পারেনি । মহামারীর ভয়াবহ বিপদের মুখেও যারা ঘৃণা ছড়ায় ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করে তাদের পরাস্ত করে আমরা মনে ও শরীরে বাঁচব।