উপজাতিয় জনপদে বেঁচে থাকার সংগ্রাম
প্রদীপ চক্রবর্তী
এই শহর আগরতলায় প্রায় প্রতিদিনই ছুটে আসতেন উপজাতিয় মহিলারা অনেকটাই দলবেঁধে। ১০/১৫ জনের দল। এরা আসতেন অম্পি, তৈদু, নগ্রাই, বৈশ্যমনি, রাংখলপাড়া, বড়মুড়া, তুইসিনদ্রাই, সিমনা, হেজামারা, অভিচরন মান্দাই, পাড়াকলক সহ অন্যান্য উপজাতিয় জনপদ থেকে। এরা নিয়ে আসতেন হরেক রকম সবজী, ফলমূল, নানাধরনের শাক সবজি। আর সেই সাথে ফুল। এরা গাড়ী রিজার্ভ করে রাজধানীতে এসে নানা স্হানে বসতেন। বিক্রি ভালই হত। ক্রেতারা অপেক্ষায় থাকতেন এদের জন্য। এরা প্রায় জোরজবরদস্তি করে তরতাজা শাকসবজি নিজের ঝুলিতে উঠিয়ে নিতেন এবং গলাকাটা দামে বিক্রি করতেন।
এই যে উপজাতিয় মহিলারা নানা পসড়া নিয়ে আসতেন, এরা বসতেন আস্তাবল ব্রীজ থেকে বাঁধ ধরে নীচে যাওয়ার রাস্তার পাশে। লেইক চৌমুহনী বাজার, বাঁধ, বিজয়কুমার চৌমুহনী, মঠচৌমুহনী, চন্দ্রপুর অঞ্চলে ।
এদের বিক্রি নেহাত কম হত না। এরা সকালে লেইক চৌমুহনী, বিকালে বিজয়কুমার। পরদিন মঠ চৌমুহনীতে বিক্রি করে বাড়ীর পথে গাড়ীতে উঠতেন। গাড়ী এদের রিজার্ভ থাকত। এদের সবজী ভালোই থাকত এবং বড়কথা নানা রোগের কাজ করে এমন সব সবজি, বনজ শাক সবজি নিয়ে আসত সেগুলো নানা রোগের কাজ দিয়ে থাকে। মুখরোচক গুদকের নানা কিছু তো ওদের কাছ থেকেই নিতে হত।
এই সময়ে নগ্রাই অঞ্চল থেকে প্রচুর পরিমাণে আলু আসত আগরতলার বাজারে। প্রাক্তন কৃষিমন্ত্রী নগেন্দ্র জমাতিয়া এদের অর্থকরী আলু চাষে নানাভাবে উৎসাহিত করেছিলেন। উনি নেই কিন্তু উনার দেখানো পথে ওই অঞ্চলের উপজাতিয়রা ভালোই রয়েছেন।
কিন্তু লকডাউনে ওরা এখন আস্তে পারেনা। ওদের আয়ে যেমন টান ধরেছে তেমনি শাকসবজি খেতেই পচে যাচ্ছে।
খোয়াই এর উপজাতিয় অঞ্চল বাচাইবাড়ী, আশারামবাড়ী, বাইজালবাড়ী,অমরপুরের তৈদু সহ আরো বেশকিছু অঞ্চলে এবার তরমুজের দারুন ফলন হয়েছে। ফলন দেখে চাষীদের মুখে হাসি ফুটেছিল। কিন্তু পোড়া কপাল ওদের। লকডাউনে সব তছনছ হয়ে গেছে। যানবাহন নেই,তরমুজ আসবে কি করে? ফল যা হবার তাই হচ্ছে। রাজধানীতে জলের দরে তরমুজ বিকোচ্ছে অন্যদিকে খেতেই পচে যাচ্ছে তরমুজ। ওদের পরিশ্রম গেল, অর্থ গেল,গেল আশাভরসা,এখন জুটেছে হতাশা আর সুদখোর মহাজনদের নিত্যদিনের তাগাদা। সব কিছুর মূলে সেই ভয়ঙ্কর মারনব্যাধি করোনা ভাইরাস সংক্রমণ ও নানা প্রান্তে মৃত্যুর মিছিল।
ইতিহাস ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বলে মহামারীতে গাছের ফল গাছেই থাকে, সবজী থাকে মাঠে, গোলায় ধান, পুকুরে মাছ, গোয়ালে গবাদি পশু। কিন্তু মহামারীর আতংকে যে যেদিকে পাড়ে ছুটতে থাকে। ছুটতে গিয়েও মরন আসে। যেখানে মহামারী সেখানে জীবন ফুৎকারে উড়ে যায়। জীবন সেখানে নিশ্চল হয়ে পড়ে।
রাজ্যের অর্থ নীতিতে বড় ভূমিকা রয়েছে উপজাতিদের উৎপাদিত ফসলের। জুমের ধান, জুমের কুমড়া, তরমুজ, উচ্ছে, করলা, বাঙ্গি, জুম খেতে কড়া লাউ থেকে প্রচুর পরিমাণে অর্থ উপার্জন হয়ে থাকে ওদের।
কিন্তু লকডাউনে সব তছনছ। ঝড়ের মত দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে মানব সভ্যতাকে।
আর কতদিন চলবে এই ভয়ংকর মারনব্যাধি করোনা ভাইরাস সংক্রমণ?
জীবনের জয়গান তো প্রায় থেমেই যাচ্ছে, অর্থ নীতি বিপর্যস্ত, পাইকারি হারে ছাঁটাই, কল কারখানা সব প্রায় বন্ধ। তবু চলছে এই জীবন, মানুষ জীবনের জয়গান গাইছে অল্পবিস্তর, উপজাতিয় জনপদে বেঁচে থাকার সংগ্রাম নিরন্তর। এই তো জীবন --মানুষ মানুষের জন্য,জীবন জীবনের জন্য।