নিষ্ঠা নিকেতন: অমরপুরে ‘সততার মুদ্রায় চলা’ এক অনন্য গ্রামীণ বাজার, যা সারা রাজ্যের জন্য হতে পারে মডেল
জয়ন্ত দেবনাথ
August 10, 2025
ত্রিপুরা রাজ্যে বহু ই-গভর্নেন্স প্রকল্প যেমন ই- ফাইল, ই-ক্যাবিনেট, ই-বিধানসভা, টাস্ক মনিটরিং সিস্টেম ইত্যাদি নিঃসন্দেহে প্রশাসন পরিচালনায় সহায়ক ভূমিকা রাখছে। তবে এসব প্রকল্প কেন্দ্রীয় সরকারের স্কিমের আওতাধীন এবং দেশের অন্য বহু রাজ্যেও চালু রয়েছে। ত্রিপুরায় মহিলাদের স্বনির্ভরতার জন্য লাখপতি দিদি প্রকল্প, আঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র গুলির সামাজিক সেবা প্রশংসনীয় হলেও, মানুষের হৃদয়ে ছাপ ফেলার মতো ব্যতিক্রমী, মডেল সামাজিক উদ্যোগের সংখ্যা এ রাজ্যে খুবই কম।
ঠিক এই প্রেক্ষাপটেই অমরপুর আরডি ব্লক অফিসের পাশেই গড়ে উঠেছে এক অভিনব গ্রামীণ বাজার উদ্যোগ, ‘নিষ্ঠা নিকেতন’, যা রাজ্যের অন্য জেলা, মহকুমা, ব্লক এমনকি দেশের অন্য প্রদেশের জন্যও 'সততার মুদ্রায় চলা’ একটি গ্রামীণ বাজারের সামাজিক দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে পারে। এটি একটি সততার উপর ভিত্তি করে পরিচালিত গ্রামীণ বাজার, যেখানে নেই কোনো প্রথাগত সেলস ম্যান বা বিক্রেতা, দরদাম বা আধুনিক সপিং মলের মতন মাইকে ঘোষণা।
প্রতিদিন টেবিলের উপর সুশৃঙ্খল ভাবে সাজানো থাকে তাজা, সুগন্ধি ও সম্পূর্ণ রাসায়নিক মুক্ত শাকসবজি ফল, ফুল যেমন, বেগুন, লাল শাক, লাউ, ঝিঙে, মূলা, ঢেঁড়স, শসা, টমেটো ইত্যাদি। প্রতিটি পণ্যের সঙ্গে নির্দিষ্ট মূল্য ট্যাগ লাগানো থাকে।
সবজি আসে Agri CSP কৃষক ও বিভিন্ন পঞ্চায়েতের স্ব-সহায়ক গোষ্ঠীর (SHG) মহিলা চাষিদের কাছ থেকে। রঙ্গামাটি, বামপুর, পাহাড়পুর, দুলুমা ও সর্বং সহ অন্যান্য পঞ্চায়েতের কৃষক ও স্ব-সহায়ক দলের মহিলারা পর্যায়ক্রমে প্রতিদিন নিজেদের উৎপাদিত ফসল সরবরাহ করে এই বাজারে।
ক্রেতারা যা প্রয়োজন, তা নিয়ে নির্দিষ্ট অর্থ একটি সংগ্রহ বাক্সে জমা দেন, পুরো প্রক্রিয়ায় কাউকে নজরদারিতে রাখা হয় না, নেই কোন সিসি ক্যামেরা অথচ সবাই নিজের বিবেকের দায়িত্বে সঠিক দাম পরিশোধ করেন। দিনের শেষে ব্লক প্রশাসন সেই অর্থ সরাসরি মহিলা কৃষকদের হাতে তুলে দেয়, কোনো মধ্যস্বত্বভোগী ছাড়াই। এই উদ্যোগ কৃষকদের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করে, গ্রামীণ সমাজে বিশ্বাসের বন্ধন দৃঢ় করে, জৈব চাষকে উৎসাহিত করে এবং গ্রামীণ মহিলাদের ক্ষমতায়নে বড় ভূমিকা রাখছে।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যদি ত্রিপুরা সরকার রাজ্যের প্রতিটি ব্লক অফিসের পাশে এই ‘নিষ্ঠা নিকেতন’ মডেল গ্রামীণ বাজার চালু করে, তবে একদিন এটি জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারে তামিলনাড়ুর ‘আম্মা রেস্টুরেন্ট’–এর মতো, যেখানে দুপুরের খাবারের মূল্য মাত্র চার টাকা। প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতার আমলে শুরু হওয়া এই রেস্টুরেন্ট বর্তমানে ডিএমকে সরকারের অধীনে কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং প্রতিদিন কয়েক লক্ষ মানুষ সেখানে মাত্র চার টাকার বিনিময়ে খাবার গ্রহণ করছেন।
তামিলনাড়ু সরকার শুধু ‘আম্মা রেস্টুরেন্ট’ নয়, আরও বহু জনমুখী প্রকল্প সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছে যেমন, ফ্রি বাস সার্ভিস, বিনামূল্যে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা ও ওষুধ, রেশন শপে বিনামূল্যে ৪২ প্রকার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, সুলভ মূল্যে মাছ-মাংস, বিনামূল্যে স্কুল বই ও পোশাক, বিদ্যুৎ বিলে ভর্তুকি, সুলভ মূল্যে পোশাক বিক্রি ইত্যাদি।
দেশের অন্য রাজ্য গুলিতেও মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত সেসব রাজ্যের জনমুখী বিভিন্ন প্রকল্পের কথা শোনা যায় বা ইন্টারনেট ঘাটলে জানা যায়। যেমন- দিল্লিতে মহল্লা ক্লিনিক: পাড়া ভিত্তিক বিনামূল্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা। অন্ধ্রপ্রদেশে অন্নপূর্ণ ক্যান্টিন: মাত্র ৫ টাকায় শ্রমজীবীদের জন্য ভাত-ডাল-সবজি। রাজস্থানে ইন্দিরা রসই যোজনা: ৮ টাকায় পুষ্টিকর থালি। পশ্চিমবঙ্গে কন্যাশ্রী প্রকল্প: কন্যা শিশুর শিক্ষা ও বাল্যবিবাহ রোধে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। গুজরাটে জননী সুরক্ষা যোজনা: নিরাপদ প্রসব ও মাতৃমৃত্যু হ্রাসে সরকারী আর্থিক সুবিধা। হরিয়ানাতে লাডলি স্কিম: মেয়ে শিশুর শিক্ষা ও সঞ্চয়ে উৎসাহিত করতে আর্থিক সাহায্য। মহারাষ্ট্রে শিব ভোজন থালি: শহুরে শ্রমজীবীদের জন্য ১০ টাকায় খাবার। মধ্যপ্রদেশে লাডলি লক্ষ্মী যোজনা: জন্ম থেকে শিক্ষার প্রতিটি পর্যায়ে আর্থিক সহায়তা।
এই উদাহরণগুলো প্রমাণ করে যে, কোনো সামাজিক উদ্যোগ জনপ্রিয় ও সফল হতে হলে তার সঠিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রচারেরও প্রয়োজন। ত্রিপুরার বহু সামাজিক স্কিম থাকলেও প্রচারের অভাবে গ্রামীণ মানুষের কাছে তার পূর্ণ সুবিধা পৌঁছায় না। এখনো একটি সাধারণ ভাতার জন্য মানুষকে মন্ত্রীর দ্বারে যেতে হয়, যা প্রশাসনের কর্তাদের প্রতি মানুষের আস্থায় ঘাটতির জন্ম দেয়।
অতএব, ‘নিষ্ঠা নিকেতন’-এর মতো অমরপুর ব্লক চত্বরে সততার ভিত্তিতে গড়ে উঠা মালের মালিকহীন বাজারের সামাজিক উদ্যোগকে যদি সরকার রাজ্যজুড়ে প্রসারিত করে, পর্যাপ্ত প্রচার দেওয়া যায় এবং জনসাধারণকে এর সাথে ব্যপকভাবে যুক্ত করা হয়, তবে এটি শুধু ত্রিপুরার নয়, সমগ্র ভারতের এক মডেল সততার সামাজিক বাজার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। (লেখক একজন দায়িত্বশীল সাংবাদিক ও ত্রিপুরা ইনফো-র সম্পাদক)
আরও পড়ুন...