চাকমাঘাটে ট্রাক চালকের মৃত্যু: একটি প্রতীকী ব্যর্থতা ও মানবিক সংকট
জয়ন্ত দেবনাথ
August 6, 2025
২০২৫ সালের ৫ আগস্ট খোয়াই জেলার তেলিয়ামুড়ার চাকমাঘাটে ঘটে যাওয়া ট্রাক দুর্ঘটনায় চালক মিহির লাল দেবনাথের মর্মান্তিক মৃত্যু কেবল একটি সড়ক দুর্ঘটনা নয়, এটি প্রশাসনিক ব্যর্থতা, প্রযুক্তিগত প্রস্তুতির অভাব এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির চরম সংকটের নগ্ন উদাহরণ। সাত ঘণ্টা ধরে জীবিত থাকা একটি মানুষকে বাঁচাতে প্রয়োজনীয় একটি লোহার কাটারও যেখানে পৌঁছাতে পারেনি, সেখানে প্রশ্ন উঠে আসে, এত বছরেও আমরা দুর্ঘটনা হ্রাস ও রোধে কতটা প্রস্তুত? কেননা, যেকোন আপদকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য তৈরি ত্রিপুরার ডিজেস্টার ম্যানেজমেন্ট দপ্তরের বয়স কম করেও কুড়ি বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। আর দুর্ঘটনার পর দ্রুত উদ্ধার কাজের লক্ষ্যে চালু ফায়ার ও ইমারজেন্সী সার্ভিস দপ্তরের বয়সও কম নয়। একই সাথে ত্রিপুরার সড়ক কর্তৃপক্ষ ও পরিবহণ দফতরের বয়সও তিন দশক হবে প্রায়। কিন্ত ত্রিপুরাতে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনা ক্রমবর্ধমান। আর এসব দুর্ঘটনা হ্রাস ও প্রতিরোধে ত্রিপুরার ইতিহাসে বারবার প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনার কারণে সাধারণ মানুষের জীবন হুমকির মুখে পড়েছে। গত এক দশকে ত্রিপুরাতে প্রতি বছর যে পরিমাণ মানুষের অপ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে এর আগে জঙ্গি উত্তেজনার সময়ও এত লোকের অপ মৃত্যু হয়নি।
চাকমাঘাটে ট্রাকচালক মিহির লাল দেবনাথ জীবিত অবস্থায় সাহায্য চেয়েছিলেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় সরাসরি সম্প্রচারিত ভিডিওতে তাঁকে দেখা যায় বাঁচার আকুতি জানাতে। অথচ সাত ঘণ্টা ধরে কোনো আধিকারিক, কোনো উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তগ্রহণকারী, এমনকি একটি সাধারণ লোহা কাটার ব্যবস্থা করতেও ব্যর্থ হয় প্রশাসন। এটি কেবল প্রযুক্তিগত ব্যর্থতা নয়, এটি মানবিকতার পরাজয়।
ত্রিপুরায় আর কোনো মিহির লাল দেবনাথ যেন এইভাবে মারা না যান, সে লক্ষ্যে নিচের বিষয়গুলো বিবেচনায় আনা একান্ত প্রয়োজন:
১। প্রতিটি জেলাতে স্থায়ী ‘ইমারজেন্সি রেসকিউ ইউনিট’ গঠন করা, যেখানে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, হাইড্রোলিক কাটার, জ্যাক, অক্সিজেন কিট, মোবাইল মেডিকেল ইউনিট থাকবে।
২। পুলিশ, দমকল ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংস্থার মধ্যে সমন্বিত কর্মপদ্ধতি তৈরি করা, যাতে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও দ্রুত কাজ করা যায়।
৩। জাতীয় সড়কগুলিতে (NH-8 সহ) প্রতি ৩০ কিমি অন্তর একটি মোবাইল রেসকিউ পোস্ট রাখা, যেখান থেকে যেকোনো দুর্ঘটনায় তাৎক্ষণিক যন্ত্রপাতি ও কর্মীরা পৌঁছাতে পারেন।
৪। রাত্রিকালীন দুর্ঘটনা মোকাবিলায় বিশেষ টিম গঠন করা, যারা ২৪x৭ সক্রিয় থাকবে।
৫। ২৪×৭ নিউজ আপডেট হয় এমন ডিজিটাল মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিং সেল চালু করা, যারা জরুরি পরিস্থিতিতে প্রশাসনকে সতর্ক করতে পারে।
৬। ডিজিটাল রেসকিউ ম্যাপ ও রেসকিউ অ্যাপ তৈরি করা, যাতে সাধারণ মানুষ দুর্ঘটনার স্থানে ছবি বা লোকেশন পাঠিয়ে সরাসরি সাহায্য চাইতে পারে।
৭। দায়িত্ব নির্ধারণ করে প্রশাসনিক টিম গঠন, যাতে কোনও সরকারী পদাধিকারী বা বিভাগ নির্ধারিত দায়িত্ব পালন না করলে তার বিরুদ্ধে কড়া প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
মিহির লাল দেবনাথের মৃত্যু আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, ত্রিপুরা এখনো একটি তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রে অগ্রনী রাজ্য হয়েও জরুরি উদ্ধার প্রক্রিয়ায় এই প্রযুক্তির সুবিধা নিতে কতটা পিছিয়ে। এটা শুধুমাত্র এক ব্যক্তির অপমৃত্যু নয়, এটি একটি ব্যর্থ প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি।
মানবিকতা এবং প্রশাসনিক দায়বদ্ধতা যদি একসাথে না চলে, তাহলে ভবিষ্যতে আরও অনেক মিহির এই ব্যবস্থার বলি হবেন। এখন সময় হয়েছে নীরবতা ভেঙে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের। কেবল নীতিপত্রে নয়, বাস্তব ও মাঠ পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে এই ধরণের পরিস্থিতিতে প্রযুক্তির ব্যবহারকে। পাশাপাশি, ত্রিপুরার মানুষকে ক্রমবর্ধমান সড়ক দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা করতে হলে, প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রশাসনিক নীতিমালার সংহত প্রয়োগ অপরিহার্য।
এই প্রতিবেদনটির মাধ্যমে সচেতন নাগরিকদের প্রতি আহ্বান, প্রশ্ন তুলুন, জবাব চান, যাতে কোনো প্রাণ আর এমনভাবে শেষ না হয়। (লেখক একজন দায়িত্বশীল সাংবাদিক ও ত্রিপুরা ইনফো-র সম্পাদক)
আরও পড়ুন...