এই দুঃসময়ে বিপন্ন, নিরন্নদের পাশে না দাঁড়ালে আমাদেরকে ক্ষমা করবেনা ভাবীকাল
পুরুষোত্তম রায় বর্মন
অন্যদিন বাড়ির গেইট থেকে জোরে হাঁক দেয়, কাজ আছে কিনা জানতে । নর্দমা , বাথরুম , পায়খানা ইত্যাদি পরিষ্কারের কাজ। এ ধরনের কাজ করার লোক এমনিতে সহজে মিলে না । কিন্তু আজ চিৎকার নয়। বাড়িতে প্রবেশ করেই সিঁড়িতে বসে হাউমাউ করে কান্না। বাবুল মিয়া কাঁদছে। কি হয়েছে জানতে চাইলে জানালো , বাবু সাত দিন ধরে কাজ নেই । ঘরে বৌ, দুটি বাচ্চা । আমাকে নিয়ে চারটে পেট । বড়জলা কাঠের মিলের কাছে বাবুলের বাড়ি । কাজ নেই কেন ? বাবুদের বাড়িতে এখন বাইরের লোকের প্রবেশ নিষেধ । তাই বাবুলের কাজ নেই । এখন অব্দি কোন সরকারি সাহায্য মেলেনি । বাবুলের কান্না থামে না । কি করবে এখন। হাতে কয়েকটি দশ, বিশ টাকার নোট । সাকুল্যে একশও হবে না। বললাম এই টাকাটা তো আছে। বাবুল জানান, এই টাকা দিয়ে তিন কিলো চাল হবে । বাবুরা দিয়েছে তালা বন্ধ গেটের ভেতর থেকে সাহায্য হিসেবে । লকডাউনের সপ্তম দিনে বাবুলের কান্না থামে না। বাকি দিনগুলো কি করে কাটাবে। চার চারটি পেটের খোরাক জোগানো দায়িত্ব বাবুলের কাঁধে। লাকডাউনের আরোপিত নিস্তব্ধতা খানখান করে ভারতের আকাশে বাতাসে কোটি কোটি বাবুল মিয়ার কান্না প্রতিধ্বনি তোলে। অনাহারের প্রসাধন সারা মুখে নিয়ে বাবুল বসে আছে আমার সামনে । এখন অব্দি সরকারি কোনো সাহায্যের ছিটেফোঁটাও বাবুলদের ঘরে পৌঁছয়নি। এক বাবুল আমার সামনে, আমাদের সামনে । লক্ষ লক্ষ বাবুল পরিবার নিয়ে শত শত মাইল হাঁটছে তো হাঁটছে। বিরামহীন হাঁটায় ক্লান্তিতে, ক্ষুধায় ইতিমধ্যে ১৮ জন জাতীয় সড়কে প্রাণ হারিয়েছেন। দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন তিনজন । সবমিলিয়ে 21 জন । করোনায় সহকারী হিসেবে এখন অব্দি 29 জন ।
বাবুলকে আশ্বস্ত করলাম জোরে ধমক দিয়ে। বললাম, বাবুল তোমার পরিবার না খেয়ে মরবে না । আমরা আছি । আপাতত কিছুটা ব্যবস্থা হল । বাকীটা পরে হবে। জোর দিয়েই বললাম ।
কোটি-কোটি বাবুলরাই আমাদের শ্রমশক্তির ৮০ শতাংশ। ৩৮ কোটি শ্রমজীবীর ৮০ শতাংশ বাবুলরা। ৮০ শতাংশ শ্রমজীবীর ঘরে ঘরে এখন লকডাউন, চুলায় লকডাউন, পেটে লকডাউন। লকডাউনে ৮০ শতাংশ শ্রমজীবী কর্মহীন। অন্নহীন । ভাড়ার বাড়ন্ত । না , তাদের জন্য কৃষ্ণ উড়ে এসে রান্নাঘরে প্রবেশ করে এক বিন্দু খুদ থেকে এক ডেকচি সাদা ভাত বানিয়ে দেবে না। ডেকচির পর ডেকচি সাদা ভাত, গরম ভাত তৈরি করবে না । শ্রমজীবীদের দুহাতই ভরসা। এখন দুহাত তালাবন্দি।
সরকারের ভাঁড়ার উপচে পড়ছে। দেশজুড়ে খাদ্য নিগমের গুদায়গুলিকে 5 কোটি মেট্রিক টন চাল এবং তিন কোটি মেট্রিক টন গম মজুদ আছে । যা দিয়ে গোটা দেশকে এক বছরের বেশি অন্তত ভাত রুটি খাওয়ানো যায়। বন্টন ও বিতরণের জন্য রেশনশপগুলি আছে, সারা দেশে প্রায় পাঁচ লক্ষ অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র গুলি আছে। বিনা পয়সায় গরিবদের, এপিএল , বিপিএল নির্বিশেষে, সরকারি গুদাম সঞ্চিত চাল ও গম বিতরণ করা যায় । করা উচিত। না , এ কথাগুলো এখন বলা যাবেনা । রাজনীতি করা হবে। গরীবের অন্নের কথা বলা, অসহায়কে সাহায্যের কথা বলা যদি রাজনীতি হয় সেই রাজনীতি হাজার বার করতে হবে, মৃত্যুর তরবারির নীচে থেকেও হাজারো বার বলতে হবে।
বিমল ঘোষ , পেশায় রিকশাচালক । বয়স 60 এর উপর। বাড়ি যোগেন্দ্রনগর । লকডাউনকে গুগলি মেরে রোজ রিক্সা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন যোগেন্দ্রনগরের বাড়ি থেকে । ঘরে স্ত্রী আছে। তিন ছেলে । দুজন বিবাহিত। এক ছেলে অটো চালায় । একজন ফেরি করে মাছ বিক্রি করে। অবিবাহিত ছেলে ব্যাঙ্গালুরুতে। বিমল ঘোষের চোখে আত্মপ্রত্যয়ের গদ্য। পুলিশের সাথে কানামাছি খেলছেন ভালই চার পাঁচ দিন। আজকে গান্ধী স্কুলের কাছে পুলিশ থামিয়েছিল। পুলিশকে পাল্টা ধমক দিয়ে বলেছেন , না বেরোলে খাব কি ? হাঁড়িতে চাল যে নেই। প্রবীণ রিক্সা শ্রমিককে ধমকে পুলিশও থমকে যায় । বলে, এ তো ঠিকই । পুলিশ বলে, এখন কিছুটা দাঁড়িয়ে থাকো । আমরা চলে গেলে বেরিয়ে পরো। আমি শুনছিলাম বিমল ঘোষের পুলিশ বিজয়ের বৃত্তান্ত। বিমল ঘোষের ধমকে শুধুমাত্র পুলিশই নয় রাষ্ট্রশক্তি ল্যাজ গুটিয়ে পালিয়েছে। এক শ্রমজীবীর প্রশ্নের সামনে রাষ্ট্রের যাবতীয় শক্তি তাসের ঘরের মতো খানখান হয়ে সশব্দে ভেঙ্গে পড়ে চৈত্রের ভর দুপুরে । আমি প্রশ্ন করি, এত ঘুরে রোজগার কত হচ্ছে। বিমল বাবুর মুখের হাসি এবার মিলিয়ে যায়। মেরেকেটে ৬০/ ৭০ টাকা দিনপ্রতি। লকডাউনের পূর্বে দৈনিক গড় রোজগার ছিল ৪০০ টাকা । বিমলবাবু এবার নুইয়ে পড়ে অন্ন চিন্তায়। ৬০ /৭০ টাকায় কি হয় দুজনের , বিবাহিত ছেলেরা আলাদা , তারাও এখন বেকার। বাবা হয়ে তাদের পাশে থাকতে পারছি না। নাতনি গুলোর মুখ শুকনো থাকে। চৈত্রের রোদে বিমল বাবুর মুখ যেন প্রস্তর যুগের আগ্নেয় শিলা। বিমল বাবুকে জানালাম, আমাদের সম্মিলিত নাগরিক উদ্যোগের কথা।
বিমল বাবুর জীবন সংগ্রামকে কুর্নিশ করে তীব্র অপরাধবোধ লাগবে নাগরিক সাহায্য তুলে দিলাম বিমল বাবুকে জোর করে। হাজার হাজার বিমল বাবুরা যদি সুখী মধ্যবিত্তদের ফেসবুক প্রোফাইল গুলি দেখতে পেত। যেখানে বড় বড় করে লেখা আছে Stay Home, Stay Safe। তাহলে বিমল বাবুরা বলতো, ওদের জীবনটার আঠারো আনাই জলে গেল। ওরা নিজেদের দেশটাকে জানেনা। প্রতিবেশীকে জানেনা। বিমল বাবুরা সুখী পরজীবী মধ্যবিত্তদের প্রতি ঘৃণায় ও বিরক্তিতে উচ্চারণ করত, যতসব আহম্মক ও স্বার্থবাজ আগাছাদের দঙ্গল। একজন কি দুজন ফেসবুকে কমেন্ট করেছেন, আপনারা কি করছেন । প্রশ্ন করার অধিকার আছে। এ দেশের নাগরিকরা সরকারকে প্রশ্ন করতে পারে না। প্রশ্ন করলেই হামলা । যাইহোক। আজ কৈলাসহরের রাংরু ও কাশীশাসন চা বাগানে ত্রিপুরা চা শ্রমিক উন্নয়ন সমিতি ও Citizens Collective Against COVID 19 এর উদ্যোগে আধার ও রেশন কার্ড বিহীন ৪০ জন চা শ্রমিককে মাথাপিছু ৪ কিলো চাউল, আলু, সোয়াবিন, মুসুরির ডাল বিতরণ করা হয়েছে। জয়দীপ রায়, বাজুধন গড়ঁ, বীর সিং ভূমিজ আমাদের হয়ে এই মহতী কাজ সম্পন্ন করেছেন।
আগামী দিনগুলিতে বাকি চা বাগান গুলিতে ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার প্রচেষ্টা করা হবে। অনেকেই সাহায্যের হাত প্রসারিত করেছেন । এ ধরনের কাজে। তাদেরকে ধন্যবাদ ।
শ্রমজীবীরা হাঁটছে, নিরন্তন হাঁটছে। পরিকল্পনাহীন লকডাউন ভারতের জনজীবনে নিয়ে এসেছে ভয়ঙ্কর দুর্যোগ । আজকের দৈনিক সংবাদপত্রে ত্রিপুরাতে অনাহারে মৃত্যুর খবর । সরকারি সাহায্যের ঘোষণা অশ্বডিম্ব প্রসব করেছে । কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর প্যাকেজ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল । এই অবস্থায় বিপন্ন, নিরন্নদের পাশে না দাঁড়ালে আমাদেরকে ক্ষমা করবেনা ভাবীকাল।