মুখ্যমন্ত্রীর মডেল রাজ্যের স্লোগান ও ত্রিপুরার বাস্তব চিত্র

জয়ন্ত দেবনাথ

বিজেপি আই পি এফটি জোট সরকারের ২০ মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পথে। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ত্রিপুরাকে মডেল রাজ্য বানানোর আর মাত্র ষোল মাস বাকি। রাজ্যের বর্তমান রাজনিতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, এবং প্রশাসনিক কর্ম ব্যাবস্থার যা হাল হকিকৎ মুখ্যমন্ত্রী শ্রী দেব কি পারবেন তার প্রতিশ্রতি অনুযায়ী বাকি ১৬ মাসের মধ্যে ত্রিপুরাকে দেশ ব্যাপী মডেল রাজ্য হিসাবে তোলে ধরতে? আজ এই প্রশ্নটি সবার মুখে মুখে।ত্রিপুরাকে আগামী তিন বছরে মধ্যে মডেল রাজ্য হিসাবে গড়ে তুলতে মুখ্যমন্ত্রীর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনাতে কি কি রয়েছে এনিয়ে লিখেছেন সাংবাদিক জয়ন্ত দেবনাথ

ইতিমধ্যেই এক বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। বিজেপি-আইপিএফটি সরকারের দুই বছর পূর্ণ হবে আগামী ২০২০ সালের ৯ই মার্চ । মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব ভার গ্রহণের পরই (২০১৮ সালের ৯ মার্চ) বিপ্লব দেব ঘোষণা করেছিলেন তিন বছরের মধ্যেই তিনি ত্রিপুরাকে মডেল রাজ্য বানাবেন। ইতিমধ্যেই শ্রী দেব এর নেতৃত্বাধীন বিজেপি আই পি এফটি জোট সরকারের ২০ মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পথে। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ত্রিপুরাকে মডেল রাজ্য বানানোর আর মাত্র ষোল মাস বাকি। রাজ্যের বর্তমান রাজনিতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, এবং প্রশাসনিক কর্ম ব্যাবস্থার যা হাল হকিকৎ মুখ্যমন্ত্রী শ্রী দেব কি পারবেন তার প্রতিশ্রতি অনুযায়ী বাকি ১৬ মাসের মধ্যে ত্রিপুরাকে দেশ ব্যাপী মডেল রাজ্য হিসাবে তুলে ধরতে? আজ এই প্রশ্নটি সবার মুখে মুখে।

৯ মার্চ ২০১৮ শ্রী দেব যখন ত্রিপুরাকে মডেল রাজ্য হিসাবে উন্নীত করার কথা বলেছিলেন সেদিন তিনি লিখিত কোন রূপরেখার কথা প্রচার করেননি। এমন কোন প্রজেক্ট প্ল্যানও তিনি কাউকে দিয়ে তৈরী করাননি। তাই স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠে কী রয়েছে মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব-এর মডেল রাজ্যের ম্যানুতে?

গত ২০ মাসে মুখ্যমন্ত্রী শ্রী দেব তার ভাষণ বক্ততা কিংবা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দপ্তরের প্রশাসনিক সভা সমূহে এ রাজ্যের উন্নয়নে তার বিভিন্ন ইচ্ছা অনিচ্ছার কথা প্রকাশ করেছেন। এই অনুযায়ী বিভিন্ন দপ্তরগুলি গত ২০ মাস ধরে রাজ্যের উন্নয়নে বিভিন্ন রূপরেখা তৈরী করেছেন। এবং সেসব কর্মসূচী বাস্তবায়নের চেষ্টা শুরু হলেও খুব বেশি ফলপ্রসূ হয়নি। রাজ্যের তথা দেশের আর্থিক অবস্থা একেবারেই ভালো নয়। চতুর্দশ অর্থ কমিশনের শেষ বছর এটি। তাই আর্থিক ভারারে মা ভবানি অবস্থা। ঋণের টাকা শোধ করতে আর সরকারী কর্মচারীদের বেতন ভাতাদি দিতে গিয়েই হিমসিম খেতে হচ্ছে সরকারকে। অর্থ সংকটের কারনে গত ২০ মাসে রাজ্যে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নতুন করে খুব একটা হাতে নেওয়া যায়নি। বলা হচ্ছে পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের বরাদ্দ অর্থ পাওয়া গেলে রাজ্যের উন্নয়নে গতি আসবে। আগামী ২০২০ সালের এপ্রিল মাস থেকে পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের প্রস্তাবিত বাজেট বরাদ্দের অর্থ প্রদানের কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্ত এখন শোনা যাচ্ছে পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের রিপোর্ট পেশ হতে বিলম্ব হতে পারে আরও এক বছর। তাই মনে করা হচ্ছে পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের বরাদ্দের টাকা হাতে আসতে লেগে যেতে পারে আরও দুই বছর। অর্থাৎ ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময় থেকেই কাজ কর্ম কিছুটা শুরু করা যেতে পারে। মুখ্যমন্ত্রী অনুমান করে বলেছেন কম করেও দেড় লক্ষ কোটি টাকা রিলিজ করতে পারে পঞ্চদশ অৰ্থ কমিশন। তাই আগামী দিনে ততটা আর্থিক অসচ্ছলতা থাকবে না।

তবে ত্রিপুরাকে আগামী তিন বছরের মধ্যে মডেল রাজ্য বানাতে বাড়তি অতিরিক্ত বিশেষ বিশেষ কি কি কাজ করতে হবে তা এখনো সেভাবে স্পষ্ট নয়। তবে মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব-এর দাবি তাঁর স্বপ্নের ত্রিপুরা মডেল স্টেট (টি এম এস)-এ নেশার কোন স্থান নেই। নেশামুক্ত হবে মডেল ত্রিপুরা। গাজা, ইয়াবা টেবলেট থেকে শুরু করে ব্রাউন সুগার, হেরোইন ইত্যাদি নেশামুক্ত ত্রিপুরা গড়ার দৃঢ় অঙ্গীকারের কথা তিনি তার শপথ গ্রহণের প্রথম দিন থেকেই বলে আসছেন। এবং এলক্ষে তিনি বেশ কিছু দৃঢ় পদক্ষেপ ইতিমধ্যেই নিয়েছেন। কিন্তু এখনো সেভাবে নেশা মুক্ত করা যায়নি ত্রিপুরাকে। উল্টো রাজ্যের নিজস্ব রাজস্ব বৃদ্ধি ও পর্যটন প্রসারের স্বার্থে মদ ও বার-এর লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব- এর 'টি এম এস- স্কীম' -এ নেশার কোন স্থান নেই বলা হলেও পুরাপরি তা মানা যাচ্ছেনা।

পক্ষান্তরে, মুখ্যমন্ত্রীর মডেল রাজ্যের ম্যানুতে বেকারদের কর্ম সংস্থানের জন্যে সরকারি চাকুরীর খুব বেশি সুযোগ নেই। তবে তিনি বিভিন্ন স্বনির্ভর প্রকল্পে বেকারদের জন্যে কর্ম সংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির পক্ষে ব্যাপক ভাবে উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলেছেন।মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, সরকারি চাকুরী নির্ভরতার বদলে বেসরকারি পর্যায়ে তৈরী করা হবে বেকারদের কর্মসংস্থানের সুযোগ। আর বাদ বাকি যেসব উন্নয়ন কর্মসূচি যেখানে যেভাবে চলছে তা চলবে। তবে এক্ষেত্রে দ্রুত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষে পর্যটনকে গুরুত্ত্ব দেওয়া হয়েছে।

ত্রিপুরাকে আগামী তিন বছরে মধ্যে মডেল রাজ্য হিসাবে গড়ে তুলতে মুখ্যমন্ত্রীর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনাতে কি কি রয়েছে তাতে চোখ রাখলে আমরা দেখবো -

১। মুখ্যমন্ত্রী চাইছেন আগামী ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করতে। এজন্য এমএসপিতে রাজ্যে ধান কেনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এখন পর্যন্ত খাদ্য ও সরবরাহ বিভাগ সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ১৫ হাজার ৬৫৪ মেট্রিক টন ধান কিনেছে। ফলস্বরূপ, কৃষকরা প্রতি কেজিতে ৫ টাকা থেকে ৫.৫০ পয়সা মুনাফা পাচ্ছেন।

২। এখন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর কিষান সম্মান নিধি যোজনায় ত্রিপুরার ১,৮০,৬৪১ কৃষকের নাম নিবন্ধিত হয়েছে। এর মধ্যে ১,৫১,০৩৪ কৃষক দ্বিতীয় কিস্তির ২০০০ টাকা করে পেয়েছেন।

৩। উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের কৃষকদের প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনার আওতায় আনা হয়েছে। আগামী রবি মৌসুমে ২১০০০ হেক্টর উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ জমির ফসল প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনার আওতায় আনা হয়েছে।

৪। কৃষকের সমস্যা সমাধানের জন্য ১৪ টি কৃষক-বন্ধু কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এ বছর খাদ্যশস্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছে ৯.৬২ মেট্রিক টন।

৫। ১ লক্ষ হেক্টর জমিতে এসআরআই পদ্ধতিতে ধান আবাদ করার লক্ষ্য মাত্রা গৃহীত হয়েছে।

৬। এ বছর মোট ৪৫০ মেট্রিক টন ক্যুইন আনারস এবং লেবু রপ্তানি করা হয়েছে। ভবিষ্যতে তা আরও বাড়বে।

৭। চলতি বছরের ১৪ ই আগস্ট অবধি, এম রেগা প্রকল্পের আওতায় খুব স্বল্প সময়ে ১২৯.৬৭ লক্ষ শ্রম দিবসের কাজ করা হয়েছে। পূর্ববর্তী ২০১৭-১৮ বছরে মোট ১৭৫.৯৬ লক্ষ শ্রম দিবসের কাজ করা হয়েছিল। এম রেগা প্রকল্পের কাজ রাজ্যে ভবিষ্যতেও চলবে।

৮। প্রধানমন্ত্রীর আবাস যোজনা (গ্রামীণ) মার্চ ২০১৮ অবধি লক্ষ্যমাত্রার ২.৯০% কাজ সম্পন্ন করা হয়েছিল। এখন এটি বেড়ে হয়েছে ৯৩% । এই প্রকল্পটির সফল বাস্তবায়নের কারণে সারা দেশে ত্রিপুরা ৫ম স্থান অর্জন করেছে এবং চলতি ২০১৯-২০ সালে রাজ্যে দশ হাজার পাঁচশত ঘর নির্মাণের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছে।গরিবদের ঘর প্রদানের এই কাজ ভবিষ্যতেও চলবে।

৯। ২০ মাস বয়সী সরকার উজ্জ্বলা যোজনার আওতায় ১,৯৬,০০০ মহিলাকে বিনামূল্যে গ্যাস সংযোগ দিয়েছে, যেখানে এর আগে দুই বছরে কেবল ৩৪ হাজার মহিলাকে গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়েছিল।

১০। ১৭ মাসে প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েত, গ্রাম সমিতি এবং পৌরসভার উন্মুক্ত অঞ্চলকে মলত্যাগ মুক্ত (ওডিএফ) এলাকা হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। এর আগে সাড়ে তিন বছরে মাত্র ১৯টি গ্রামকে ওডিএফ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল।

১১। মহিলাদের ক্ষমতায়নের জন্য পুলিশ বাহিনীর পাশাপাশি টিএসআরের নতুন ব্যাটালিয়নে নিয়োগে মহিলাদের জন্য ১০% আসন সংরক্ষণ করা হয়েছে। অপরাধ রোধে কঠোর আইন প্রয়োগ করা হয়েছে, ডাকাতির মামলায় কোনও জামিন মঞ্জুর করা হবে না এবং সাত বছরেরও বেশি কারাদণ্ডের ব্যবস্থা কার্যকর করা হয়েছে।

১২। মহিলাদের সুরক্ষার জন্য ৮ টি জেলায় মনিটরিং কমিটি এবং বিশেষ সেল গঠন করা হয়েছে। অভিযোগ দায়ের করার জন্য শীঘ্রই ১৮১ হেল্পলাইন সিস্টেম শুরু করা হবে।

১৩। পুলিশ পরিষেবা আরও জোরদার করতে ২৬১ টি মোটরবাইক বিট টহল দেওয়ার জন্য সরবরাহ করা হয়েছে।

১৪। কঠোর আইন কার্যকর হওয়ার কারণে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের হার ১০% হ্রাস পেয়েছে। ধর্ষণের শিকার মহিলাদের ক্ষতিপূরণ হিসাবে ৫০,০০০ থেকে বাড়িয়ে ৩ লক্ষ টাকা করা হয়েছে। শারীরিকভাবে নির্যাতিত নাবালিকাদের ক্ষতিপূরণ ২০,০০০ থেকে ন্যূনতম ২ লক্ষ টাকা করা হয়েছে। ত্রিপুরা রেপ ভিকটিম ক্ষতিপূরণ প্রকল্প অনুসারে ধর্ষণের শিকার মহিলাদের ও মানব পাচারকারিদের কারনে ক্ষতিগ্রস্থদের ক্ষতিপূরণ ২০ হাজার থেকে বাড়িয়ে এক লাখ টাকা করা হয়েছে। শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ, পরিত্যক্ত এবং যৌন নিপীড়িত নারী ও শিশুদের ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।

১৫। ড্রাগ-মুক্ত অভিযান চালিয়ে ৯ ই মার্চ ২০১৮ থেকে ৩১ জুলাই ২০১৯ পর্যন্ত মোট ৫৯২ টি মাদক সংক্রান্ত মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং ১০২৬ জনকে এনডিপিএস আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ত্রিপুরাকে ড্রাগ-মুক্ত করার এই অভিযান জারি থাকবে।

১৬। রাজ্যে পিডিএস সিস্টেমকে জোরদার করতে ৬২,০০০ ভুয়া রেশন কার্ড বাতিল করা হয়েছে। সরকারি অফিসগুলিতে বায়োমেট্রিক সিস্টেম চালু করা হয়েছে এবং প্রশাসনিক কাজ কর্ম দুর্নীতি মুক্ত করতে ই-টেন্ডারিং, ই-চালান, ই-পিডিএস, ই-বাহান, ই-স্ট্যাম্পিং এবং ডিজিটালাইজেশন সিস্টেম কার্যকর করা হয়েছে।

১৭। ত্রিপুরা পুলিশ এবং টিএসআর কনস্টেবল / রাইফেলম্যান / প্রধান কনস্টেবল / হাওয়ালদার এর মত কর্মচারীদের বাচ্চাদের স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং এসব পরিবারের ছেলেমেয়েরা যারা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় শীর্ষ স্থান অর্জন করবে তাদের মুখ্যমন্ত্রী মেধা পুরুষকার প্রদান করা হবে।

১৮। সৌভাগ্য যোজনার আওতায় প্রায় ১.৯৯ লক্ষ বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছিল, এর মধ্যে ১ লাখ বাড়ি বিনামূল্যে বিদ্যুৎ সংযোগ পেয়েছে।

১৯। মুখ্যমন্ত্রী আরও ঘোষণা করেছেন যে শিগগিরই রাজ্য বিদ্যুৎ নিগম আইটিআই পাস হওয়া নতুনদের জন্য কাজের সুযোগ করে দেবেন।

২০। রাজ্য সরকার প্রথমবারের জন্য ৯৪০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে অটল জলধারা যোজনা শুরু করেছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে, ২০২২ সালের মধ্যে প্রতিটি ঘরে বিশুদ্ধ পানীয় জল প্রদান করা হবে।

২১। আগরতলাকে একটি আধুনিক ও বিশ্বমানের নগরীতে রূপান্তর করতে স্মার্ট সিটি প্রকল্পে ২২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ ক রা হবে এবং এলক্ষ্যে দ্রুত কাজ শুরু হয়েছে।

কিন্ত এসব কাজগুলি বাস্থবায়নের জন্যে অঢেল অর্থের প্রয়োজন। পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের কাছে রাজ্য আগামী পাঁচ বছরের জন্য এক লাখ সাত কোটি টাকা চেয়েছে। এর মধ্যে স্টেট স্পেসিফিক বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে চাওয়া হয়েছে ১৭৮৮৩.৬১ কোটি টাকা। ১২২ টি উন্নয়ন প্রকল্পে এই টাকা চাওয়া হয়েছে। পঞ্চদশ অর্থ কমিশন আগামী ২০২০ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত রাজ্যের সামগ্রিক উন্নয়নে ব্যয় বরাদ্দ নিরূপন করবে । কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন কম করেও দেড় লক্ষ কোটি টাকা রিলিজ করতে পারে পঞ্চদশ অৰ্থ কমিশন।

মুখ্যমন্ত্রীর দাবী অনুযায়ী পূর্বতন সরকার প্রায় ১৬০০ কোটি টাকা ঘাটতি রেখে গেছে। আর বকেয়া ঋণের পরিমান প্রায় ১৩০০০ কোটি টাকা। নয়া সরকার পঞ্চদশ অর্থ কমিশনে যে লিখিত মেমোরেন্ডাম দিয়েছে সেই অনুযায়ী সব প্রক্লপ যদি পঞ্চদশ অর্থ কমিশন মঞ্জুর করে রাজ্য সরকার কোন কোন বিশেষ প্রকল্প খাতে কত টাকা পাবেন তার একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা প্রদান করা হয়েছে যা থেকে পাঠক বর্গ সহজেই বুঝে যাবেন আগামী আগামী তিন বছরের মধ্যে ত্রিপুরাকে মডেল রাজ্য বানানো কতটা সম্ভব হবে বা আগামী পাঁচ বছরে এ রাজ্যে উন্নয়নমূলক কাজকর্ম কোথায় কতটা হবেঃ-

১) কৃষি সেচ ব্যবস্থার মান উন্নয়নে পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের কাছে ২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।

২) নয়া কৃষি ভবনের জন্য পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের কাছে ৬১.৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। নেহেরু কমপ্লেক্স হবে নয়া কৃষি ভবন।

৩) কৃষি ক্ষেত্রে গবেষণার লক্ষ্যে দশটি নয়া প্রযুক্তি নির্ভর রিসার্চ কাম ট্রেনিং সেন্টারের জন্য পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের কাছে চাওয়া হয়েছে ১৪.৮৯ কোটি টাকা।

৪) বৃহত্তর সুরক্ষার প্রশ্নে এক হাজারটি জে বি ও এস বি স্কুলের মেরামতের লক্ষ্যে পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের কাছে ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। স্কুলগুলির টয়লেট মেরামতির জন্য ১৩.১৩ কোটি, বিদ্যুৎ খাতে ৭৩.৮৪ কোটি এবং নয়টি বিদ্যালয় পরিদর্শক অফিস নির্মানের জন্য চাওয়া হয়েছে ২১.৯৬ কোটি।

৫) ধলাই-এ এবং পশ্চিম জেলায় একটি করে সৈনিক স্কুল স্থাপনের জন্য ৬৮ কোটি, ৩৫ টি বর্তমানে চালু স্কুলের নির্মাণ কাজের জন্য অতিরিক্ত ১৩৯.৩৮ কোটি, নতুন করে আরও ৫০ টি স্কুলের পুনঃ নির্মাণে চাওয়া হয়েছে ৩০০ কোটি।

৬) এমবিবি বিশ্ব বিদ্যালয়ের সম্প্রসারণের জন্য ৬৯ কোটি, ছয়টি নয়া ডিগ্রী কলেজ নির্মাণের জন্যে ৮৪ কোটি, পুরানো ডিগ্রী কলেজগুলির মান উন্নয়নের জন্য ৫০ কোটি, আইন কলেজের উন্নয়নে ৩০ কোটি, টিআইটি-র জন্য ২০ কোটি, পলিটেকনিকগুলির জন্য ১৮.৪৫ কোটি চাওয়া হয়েছে পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের কাছে।

৭) স্বাস্থ্য ভবন নির্মানের জন্য ৪০.৪২ কোটি, শান্তিরবাজারে একটি নয়া এ এন এম স্কুল নির্মাণে ১৮.৭০ কোটি, এইমস-এর আদলে একটি হাসপাতাল নির্মাণে ২১৫০ কোটি , ফার্মাসি কলেজের মান উন্নয়নে ২২.৬৬ কোটি, দুর্জয়নগরস্থিত এ এন এম স্কুলের উন্নয়নে ১২.৭০ কোটি, জি বি ও এজি এম সি-র ফেজ টু প্রকল্পে ১২১.২৫ কোটি, জি বি হাসপাতালে মাল্টি লেভেল কার পার্কিং প্রকল্পে ২০ কোটি, এডিসির কোথাও একটি মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের লক্ষ্যে ৩৫০ কোটি , একটি আয়ুষ হাসপাতাল নির্মাণে ১২৯ কোটি, আমবাসায় একটি ক্যান্সার কেয়ার সেন্টারের জন্য ৪৫ কোটি, হাসপাতালগুলিতে রান্নাঘর ও মর্গগুলির জন্য ২১.৮৩ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের কাছে।

৮) হাসপাতাল গুলির সুরক্ষায় বাউন্ডারী দেওয়াল নির্মাণে ৪৪.৮০ কোটি ও চুক্তিবদ্ধ অস্থায়ী কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধিতে ৬৯.৩৫ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের কাছে।

৯) বস্তি উন্নয়নে ৩৫১ কোটি, আগরতলা শহরে বন্যা নিয়ন্ত্রনে ২১.৫০ কোটি, ১৯ টি পুরসভা ও নগর পঞ্চায়েত এবং আগরতলা শহরের নর্দমা সংস্কারে ২১ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের কাছে।

তাছাড়া ১৯ টি পুর এবং নগর পঞ্চায়েত এবং আগরতলা শহরের বন্যা নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে ৫৩ কোটি, নর্দমা তৈরী ও সংস্কারে ৭৫০ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে।

চানমারী ও শহরের কাশীপুর এলাকায় পানীয় জল সরবরাহ খাতে ৯৮ কোটি, কমলপুর শহরের পার্শ্ববর্তী এলাকায় নদী ভাঙ্গন রোধে ১০.৯২ কোটি, নদীর ভাঙ্গন রোধে কৈলাসহরের জন্য ৩২৩ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের কাছে।

১০) নগর উন্নয়ন দপ্তরের অফিস পরিকাঠামো নির্মাণে ৪২ কোটি টাকা চাওয়া হোয়েছে।

১১) বিদ্যুৎ ব্যবস্থার মান উন্নয়নে পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের কাছে ৩৭৪০ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে।

১২) পূর্ত দপ্তরের পানীয় জল শাখা (ডি ডবলু এস) পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের কাছে ৪৭০ কোটি, পূর্ত দপ্তরের সড়ক উন্নয়ন শাখার জন্য চাওয়া হয়েছে ১৩৭৫.৯৯ কোটি টাকা।

১৩) পরিবহণ দপ্তরের জন্য ৫০.৫০ কোটি, বন দপ্তরের জন্য চাওয়া হয়েছে ৮৭.০৭ কোটি টাকা।

১৪) উপজাতি কল্যাণ দপ্তর ১৯ টি হোস্টেল খাতে ৮১.৯৬ কোটি, টি টি এ ডি সি -র উন্নয়নের জন্য ১২২.৪২ কোটি, দিল্লী, ব্যাঙ্গালোর, হায়দ্রাবাদ, চেন্নাই, কোলকাতা, গুয়াহাটিতে একটি করে ট্রাইবেল গেস্ট হাউস নির্মাণে চাওয়া হয়েছে ৩০.৫০ কোটি টাকা।

১৫) পর্যটনের মান উন্নয়নে একটি হোটেল মেনেজম্যান্ট ইন্সটিটিউট নির্মাণে ১৩.৫২ কোটি, দুটি নয়া টুরিস্ট লজ নির্মাণে ১৯.৬০ কোটি, পর্যটন ক্ষেত্রের পরকাঠামোয় সার্বিক উন্নয়নে চাওয়া হয়েছে ১৫৩ কোটি টাকা।

১৬) আরক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন পরিকাঠামোর মান উন্নয়নে চাওয়া হয়েছে ৪৬৮.১৯ কোটি।

১৭) অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থার মান উন্নয়নে চাওয়া হয়েছে ৮০.২৮ কোটি টাকা।

১৮) আইনি পরিকাঠামোর মান উন্নয়নে চাওয়া হয়েছে ১৪৯.০৫ কোটি।

১৯) সিপার্ডে একটি সিভিল সার্ভিস অফিসার্স ট্রেনিং সেন্টার নির্মাণে চাওয়া হয়েছে ২৫ কোটি।

২০) সরকারী ছাপাখানার মান উন্নয়নে এবং একটি আধুনিক ছাপাখানা স্থাপনে চাওয়া হয়েছে ১৫.১৭ কোটি।

২১) ক্রীড়া পরিকাঠামোর মান উন্নয়নে ৯৫৪.৪৫ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের কাছে।

২২) বেকারদের জন্য সিপাহীজলা, খোয়াই এবং দক্ষিণ জেলায় তিনটি এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ স্থাপনে ১৩.৫০ কোটি, স্কিল ডেভেলপমেন্ট খাতে ৫৭.৫০ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে।

২৩) আগরতলাস্থিত সংখ্যালঘু আবাস মৌলানা আবুল কালাম আজাদ পন্থ নিবাস- এর নির্মাণে ১৪.১২ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে।

২৪) মৎস্য দপ্তরের একটি অফিস নির্মাণে ১১৩.৭৬ কোটি এবং একটি একুরিয়াম স্থাপনে ৩০ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে।

২৫) পঞ্চায়েত দপ্তরের এবং তার ক্ষেত্র স্তরে নয়া অফিস পরিকাঠামোর বিস্তার ও মান উন্নয়নে ৭৬ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের কাছে।

২৬) হর্টি দপ্তর ২৯.৭১ কোটি, খাদ্য দপ্তর ১৭ কোটি, প্রানী সম্পদ বিকাশ দপ্তর ৬০ কোটি, রাজস্ব দপ্তর ২৪৮.২৫ কোটি, গ্রামোন্নয়ন দপ্তর ২৯.২০ কোটি এবং তথ্য সংস্কৃতি দপ্তর তাদের বিভিন্ন পরিকাঠামো নির্মাণ ও সম্প্রসারনে ১৩.৮৩ কোটি টাকা চেয়েছে পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের কাছে।

একথা ঠিক যে উপরি উল্লিখিত প্রকল্প বা কর্মসূচিগুলি বাস্তবায়নে ত্রিপুরা মডেল রাজ্যের পথে বেশ খানিকটাই এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে একথা নির্দ্ধিধায় বলা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে টাকা হাতে এলেও কি আগামী এক বছরের মধ্যেই এতগুলি কাজ সম্পন্ন করা যাবে কিনা? তাছাড়া এতগুলি বৃহৎ কর্ম প্রকল্প রূপায়ন করতে গেলে যে লোকবল প্রয়োজন সেটা এই মুহুর্তে রাজ্যের হাতে রয়েছে কিনা। গড়ে প্রতিবছর রাজ্য প্রশাসনের বিভিন্ন শাখা থেকে চার থেকে সাড়ে চার হাজার সরকারী কর্মচারী অবসরে যাচ্ছেন। সেই অনুযায়ী নতুন নিয়োগ নেই বললেই চলে।

তাছাড়া পুরানো কাসুন্ধি ঘেটে মন্ত্রী আমলাদের গ্রেপ্তার করে জেলে পুড়ে দিয়ে প্রশাসনের সর্বস্তরে যে ভয়ের পরিবেশ কায়েম করা হয়েছে তাতে তো কেউই আর সেভাবে দায়িত্ব নিয়ে কিছু করতে চান না। এই অবস্থায় টাকা হাতে এলেও মডেল রাজ্য বানাতে যে কর্মসংস্কৃতি ও কর্ম দক্ষ অফিসার আমলার প্রয়োজন সেটা না করে ভাষণ বক্তৃতায় ত্রিপুরাকে মডেল রাজ্য বানানোর স্বপ্ন শেষ পর্যন্ত স্বপ্নই না থেকে যায়। কেননা, প্রশাসন চালাতে গেলে যে, অভিজ্ঞতা ও সহিষ্ণুতা থাকা চাই এটা সেভাবে বিজেপি সরকারের তথাকথিত মন্ত্রী আমলাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে কই?

শুধু তাই নয়, যেভাবে কথায় কথায় কর্মচারীদের বরখাস্ত করা হচ্ছে বা একটু আধটুকু ভুলত্রুটির জন্যেও কর্মচারীদের উপর শাস্তির কোপ নেমে আসছে তাতে আর যাই হোক কর্মচারীদের মধ্যে স্বস্তির পরিবেশ কায়েমের পক্ষে যথেষ্ট নয়। তাই ত্রিপুরাকে মডেল রাজ্য বানাতে হলে সর্বাগ্রে যেটা প্রয়োজন সেই আইনের শাসন রাজ্যে আগে প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন বলেই সংশ্লিষ্ট তথ্যভিজ্ঞ মহলের অভিমত। (লেখক একজন সিনিয়র সাংবাদিক ও ত্রিপুরাইনফো ডটকম- এর পরিচালন অধিকর্তা। ২০ ডিসেম্বর, ২০১৯)


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
মন্তব্যের তারিখ (Posted On)মন্তব্যকারির নাম (Name)মন্তব্য (Comment)
30.12.2019সুচিত্রা দাসস্যার, ২০ মাস তো হল, দেখা যাক বাকি ১৬ মাসে আর কি কি হয় !!
28.12.2019প্রদীপ চক্রবর্তীঅনুসন্ধান মূলক প্রতিবেদন। ধন্যবাদ।এ ধরনের প্রতিবেদন সাহায্য করবে অনেককে।