করোনা মোকাবেলায় ত্রিপুরাইনফো-র একটি অতি প্রয়োজনীয় আবেদন
জয়ন্ত দেবনাথ
ইতালির অবস্থা খুব খারাপ। কবর দেওয়ার লোক পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। ইতালিতে এক একদিনে পাঁচশোর কাছাকাছি লোক মারা যাচ্ছেন। ইরানে গণকবর খোঁড়া হচ্ছে। যতদিন চীনে এরকম হচ্ছিল, খবর পাচ্ছিলাম উহান প্রদেশ উজাড হয়ে যাচ্ছে ততদিন ইউরোপে বসে ভারতের ত্রিপুরায় বসে আমরা সমবেদনা জানানো ছাড়া আর কিছুই করিনি। তাই আজ ইউরোপের এই অবস্থা। মাত্র একমাসের ব্যবধানে। এখন আমাদের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে মারণরোগ। জানতে না দিয়েই।
না আতঙ্ক ছড়ানোর জন্য লিখছি না। ইতালি যে ভুল করেছিল ভারত বা ত্রিপুরা সে ভুল যেন না করে। শুধু টিভি বা খবরের দর্শক হয়ে নয়, কিছু করার আবেদন এটা। হোয়াটস্যাপ বা ফেসবুকের ভুয়ো খবর নয়, বরং সচেতনতা ছড়ান। পরিসংখ্যান বলছে ভারতে মাত্র এক সপ্তাহ যদি আমরা ঘরবন্দি হয়ে থাকি তাহলে আমাদের অবস্থা ইতালি বা ফ্রান্সের মত হবে না। ইতালি ইরান ফ্রান্স অনেক দেরিতে করেছে, ত্রিপুরাবাসীর হাতে এখনো কিছুটা সময় আছে। ত্রিপুরাকে ২৪ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত ফুল লক-ডাউন করা হয়েছে। এক সপ্তাহ ঘোরা-বেড়ানো বা অ-দরকারি কাজ গুলোকে মুলতুবি রাখুন। এক সপ্তাহ ছুটি কাটান ঘরে বসে, অযথা দোকান বাজারে ছোটাছুটি করে নিজের বিপদ ডেকে আনবেন না। এই এক সপ্তাহ খুব গুরত্বপূর্ণ। এক সপ্তাহ পর হয়ত সেলফ কোয়ারেন্টাইনের আর কোনো প্রয়োজনীয়তাই থাকবে না। প্রকোপ একেবারে কমে যেতে পারে, নইলে হয়ত ঘরে বসেও আক্রান্ত হতে পারেন।
আসুন, আমরা আগামী এক -সপ্তাহ মাত্র তিনটে কাজ করি। বেশি না, তিনটে কাজ এক, বাইরে বেরোনো বন্ধ করে দিই। বন্ধ মানে বন্ধ। পাড়ার চায়ের দোকানটুকুও নয়। আত্মীয় বন্ধু প্রতিবেশী কারোর বাড়ি যাবেন না, তাদেরও নিজের বাড়িতে ডাকবেন না। যেখানে ভিড় বেশি, দশজনের বেশি লোক জমায়েত হয়েছে সে জায়গা এড়িয়ে চলুন, সে শপিং মল হোক কি ধর্মীয় স্থান। দুসপ্তাহ সেদ্ধ ভাত খেয়েই চালিয়ে নিন। চাল-ডাল-আলু-পেঁয়াজ মজুত আছে এতদিনে। বিরিয়ানি মশলা কিনতে না বেরোনোর প্রতিজ্ঞা করুন। দুই, সাধারণ হাইজিন মেনে চলি। খাবার আগে এবং ঘন্টায় অন্তত একবার করে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলুন। নাকে-মুখে হাত যথাসন্তভব কম দিন, হাত না ধুয়ে তো নয়ই।
তিন, "আমি একা কি করব? সবাই তো মানছে না" -এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসুন। আপনার মাধ্যমে যদি একজনও ক্ষতিগ্রস্থ হয় সে হল আপনার প্রিয়জন। বাবা-মা- স্বামী-স্ত্রী-সন্তান। যার সঙ্গে আপনি দিনের বেশিরভাগ সময় কাটাচ্ছেন তাকে আপনিই মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছেন না তো? বয়স্ক মানুষ ছাড়াও যাদের হাইপ্রেসার, সুগার, হার্টের অসুখ, কিডনি, ক্যান্সার বা অন্য কোনো সাধারণ ক্রনিক রোগ আছে, করোনাভাইরাসের সংস্পর্শে এলে তাঁদেরও মৃত্যুর হার কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
তিনটে বিষয়, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল বাইরে না বেরোনো। কতদিন না বেরিয়ে সম্ভব ? ঠিক দু-সপ্তাহ। আপনি হয়ত স্ট্রং, সাধারণ ফ্লুয়ের উপসর্গও নেই। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও আপনি হয়তো ঠিক সুস্থ হয়েই যাবেন। কিন্তু চোদ্দ দিনের মধ্যে আপনি যদি কোন অন্য মানুষের সংস্পর্শে আসেন তাহলে তাঁর জীবন বিপন্ন হতে পারে। এটা ভেবে শিক্ষিত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে যদি এটুকু মেনে চলেন তাহলেই আমরা অনেকটা নিরাপদ থাকব।
একটা জরুরি তথ্য জানাই ২০২০ এর ফেব্রুয়ারি মাসের ২৭ তারিখ - রোমে তখনও পাস্তা পিৎজার ক্যাফে গুলো ভর্তি। ফন্তানা দি ট্রেভিতে তখনও খিকথিকে ভিড়। চারাদিকে শোনা যাচ্ছে রোগ হচ্ছে কিছু মানুষের, টিভিতে দেখাচ্ছে নতুন কেস ধরা পড়েছে ইত্যাদি.কিন্ত তখনও সাধারণ মানুষ অফিস যাচ্ছে, কাজে যাচ্ছে - আজ ত্রিপুরা বা ভারতের মতই। তখনও মানুষ বাইরে বেরোচ্ছে, পানশালা যাচ্ছে, আড্ডা দিচ্ছে - আজ ত্রিপুরা বা ভারতের মতই। ভাবছে, বাড়ির আসে পাশেই থাকবো, কি আর হবে ? - আজ ত্রিপুরা বা ভারতের মতই । চাকরিতে ছুটি না পাওয়া মানুষ ভাবছে, না গেলে যদি চাকরি চলে যায়? - আজ ত্রিপুরা বা ভারতের মতই । ইতালিতে তখন দ্বিতীয় স্টেজ, তৃতীয় সপ্তাহ - আজ ত্রিপুরা বা ভারতের মতই। এই অব্দি সব মিল আছে, এরপরের ব্যাপারটা ভবিষ্যত। ইতালির ভবিষ্যত লেখা হয়ে গেছে। এক লাফে, তৃতীয় সপ্তাহে 1936 থেকে চতুর্থ সপ্তাহে 6362! ইরানে তৃতীয় সপ্তাহে ছিলো 245, ভারতের আপাতত তৃতীয় সপ্তাহে 276. ইরান তৃতীয় থেকে চতুর্থ সপ্তাহে 245 থেকে এক লাফে বেড়ে 4747 মিল আরেকটা হচ্ছে, ইতালি বা ইরানে তৃতীয় সপ্তাহেও সবাই এটাকে বিশেষ গুরুত্ব দেননি। অনেকেই ভেবেছেন যার হচ্ছে হোক, আমার হবেনা। ভারতেও আমরা অনেকটাই ক্যাজুয়ালি নিচ্ছি এভাবেই। সবই করে যাচ্ছি, বাইরেও যাচ্ছি অফিসেও যাচ্ছি কিন্তু বুকে ভয় নিয়ে !
আজ আমরা ভাবতেও পারছি না, ঠিক পরের সপ্তাহ আমাদের জন্য কি বিভীষিকা নিয়ে আসছে! আজকের 276 সংখ্যাটি পরের সপ্তাহে 20090/40090/809009/ কিংবা 19000... তা কিছুই হতে পারে। ভারতের মতো জনবহুল ও ভিড় দেশে এটা খুব স্বাভাবিক, যদি আমরা সতর্ক না হই। ভাবুন, আজ আপনি যে কারনে অফিস বাধ্য হয়ে যাবেন, সেই জব সিকিউরিটির কি হবে যদি আপনি বা আপনার পরিবারের কেউ আক্রান্ত হন, বা তার থেকেও ভয়ঙ্কর - মারা যান। কে করবে এই চাকরি তখন ? কার জন্য করবে ?
* যে বস আজ কাজে যেতে বলছে, সেই বস সেদিন আসবে না আপনার প্রিয়জনের বা আপনার জানাজা ধরতে ।আগে প্রানে বাচুন ভাই, তারপর চাকরির কথা ভাববেন ।
সমস্যা হচ্ছে, এই লেখাটা যখন আপনি পড়বেন, তখনও করোনা আপনার ধারে কাছে পৌঁছায়নি, বা পৌঁছেছে, আপনি জানেন না - সিম্পটম বেরিয়ে আসতে সময় তো লাগে। কিন্তু যখন জানবেন, দেখবেন চারপাশে কেউ বাকী নেই, সেদিন যতই মাথা দেওয়ালে ঠুকে বেড়ান, এই তৃতীয় স্পতাহ আর ফেরত পাবেন না। তখন আপনি ঢুকে পড়েছেন আপনার চারপাশে হাজার হাজার করোনা পজিটিভ রুগী নিয়ে।
* সেটার মানেই আপনি মরবেন এমন না। কিন্তু সরকারের সেইসময় আর কিছু করার থাকবেনা। তার কাছে আপনাদের রাখার জায়গা নেই, পরিকাঠামো নেই। এত সংখ্যক মানুষের চিকিৎসা করার উপায় নেই – সরকার তখন কি করবে? সরকার তখন সেটাই করবে যেটা আজ বাধ্য হয়ে ইতালি করছে.. পাঁচজন রুগি এলে এবং দুটো বেড থাকলে, ওই পাঁচজনের মধ্যে সবথেকে বেটার অবস্থার দুজনকে বেছে নিচ্ছে, বাকিদের মরার জন্য ছেড়ে দিচ্ছে! সরকার তখন এটাই করবে বাধ্য হয়ে!
* ইতালির মত উন্নত দেশ এর মোকাবিলা করতে ব্যার্থ সবরকম সুযোগ সুবিধে আমাদের থেকে অনেক ভালো থাকা সত্বেও। ভাবতে পারেন, ভারতের মতো জনবহুল দেশে এইরূপ হলে কি অবস্থা হবে!
ইতালি তবুও জানতে পারেনি, কি আসতে চলেছে তাদের একটা ইতালির উদাহরণ ছিলো না। পঞ্চম সপ্তাহে তারা হঠাৎ 25000 এর কাছাকাছি!
আমাদের সামনে ইতালি, চীন সহ বিভিন্ন দেশের উদাহরন স্পষ্ট। এরপরেও আমরা যদি সতর্ক না হই, যদি সংযত না হই এবং নিজেদের বাড়ির মধ্যে আটকে না রাখি, সেল্ফ আইসলেশনে না থাকি, তাহলে পরে কেঁদে কুল পাওয়া যাবে না।
বাড়িতে থাকুন। নিজের জন্য, নিজের পরিবারের জন্য এবং নিজের দেশের জন্য! করোনার একমাত্র ওষুধ এটাই আসুন দেখিয়ে দেই , প্রথম বিশ্বও যেটা পারেনি, আমাদের দেশ, গরীব ত্রিপুরা রাজ্য সেটা করে দেখিযেছে ।
ইতি
জয়ন্ত দেবনাথ
সম্পাদক ও পরিচালন প্রধান
ত্রিপুরাইনফো ডটকম