সাংস্কৃতিক মন, ইনফোর কুইজ ও নবতর সম্ভাবনা
সৌম্যদীপ দেব
নিজের স্বপ্নকে এতটা সময় দিন যাতে আপনাকে চোখে দেখাটাও মানুষের স্বপ্ন হয়ে যায়। আসলে আজকের প্রজন্ম এত দ্রুত সবকিছু পেয়ে যেতে চায়, তখন তারা ভুলে যায় ‘সবুরে মেওয়া ফলে’৷ বীজতলা তৈরি করতে হয়। নইলে জীবনের ফসল ভাল হয় না। রাতের বেলা ঘুমিয়ে যা মানুষ দেখে তা স্বপ্ন নয়, দিনের আলোতে খোলা চোখে যে স্বপ্ন মানুষ দেখে তা-ই হল বাস্তব। স্বপ্নকে পূরণ করার জন্য সময় দিতে হয়। নিজেকে গড়ে নিতে হয়। উপযুক্ত করে তুলতে হয়৷ ‘গন্তব্য নয়, গমনের পথ যেন সুন্দর হয়।’ — আজকের উচ্চ শিক্ষিত মা-বাবারা এই বোধটুকু ছেলেমেয়েদের মধ্যে দিচ্ছেন। কিন্তু প্রশ্ন হল ক'জন দিচ্ছেন? আজকে দেখা যায় বি.এড না হলে সরকারি শিক্ষক হিসাবে একজন প্রার্থী যোগ্য বিবেচিত হন না। আজকে থেকে ৩০ কিংবা ৪০ বছর আগে যাঁরা বিভিন্ন বিদ্যালয়ে পাঠ দিতেন তাঁদের কিন্তু ব্যাচেলার অফ অ্যাডুকেশন নামে কোনো ডিগ্রি ছিল না। অথচ তাদের হাত দিয়ে অগণিত শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী তৈরি হয়েছেন৷ এগুলো ভুলে গেলে চলবে না। ভারতীয় সমাজ, সাহিত্য, দর্শনের পাশাপাশি শিক্ষা ব্যবস্থার বিকাশের ইতিহাস আমাদের এই প্রজন্মকে জানাতে হবে। গুরুকুল থেকে আজকের আধুনিক স্মার্ট ক্লাস — এই-যে বিবর্তন তা কিছুটা হলেও প্রজন্মের মনে সঞ্চারিত করতে হবে। বুঝিয়ে দিতে হবে, আমরা কোথায় ছিলাম? কেনো ছিলাম? আর আজ আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছি? জীবনের থেকে বড় হোক স্বপ্ন তাতে সমস্যা নেই, কিন্তু স্বপ্ন যেন সৎ হয়। জীবনের স্বপনপুরীতে বেণুজল যেন ঢুকে না পড়ে। মানুষ সময় হারিয়ে সময় খোঁজে! বছর শেষে সম্বিৎ ফেরে! আর সবকিছুর বিনিময়ে আকাঙ্ক্ষার কাছে পৌঁছুতে চায়। আকাঙ্ক্ষার প্রতি মরিয়া হওয়া সে দোষের নয়, কিন্তু আকাঙ্ক্ষা পূরণ কোনোকিছুর বিনিময়ে যেন না হয়। কাজের দারা, শ্রমের দারা তা অর্জন করতে হবে। সহজে কিছু পেয়ে গেলে তার কদর থাকে না। নতুন প্রজন্মকে ধৈর্য্য ধরতে শেখাতে হবে৷ অপেক্ষা করতে গিয়ে অধৈর্য্য হলে চলবে না। প্রতিদিন একটু একটু করে ক্ষয়ে যাওয়া, ফুরিয়ে যাওয়া মানুষ দিনের শেষে দু’চোখ জুড়ে তার স্বপ্ন। স্বপ্ন দেখতে না জানলে জীবন উদ্দেশ্যহীন হয়ে যায়। বেঁচে থাকার মন্ত্র ভুলে যায়।
সংস্কৃতি শব্দটি বৈশ্বিক প্রভাবান্বিত। বৃহত্তর অর্থ আছে। যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইদানীং নানাভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। একটি ঐতিহ্যবাহী পুরাতন শহরের পরিবর্তন হতে অনেকটা সময় লাগে৷ কিন্তু আজকের শহর আগরতলা কুড়ি বছর আগেও এমনটা ছিল না। একটি শহরের সংস্কৃতিক মন তৈরি হতে সুদীর্ঘ সময় গেলে যায়। আসলে পড়াশোনা করাতে মা-বাবা যতটা উৎসাহী, সাংস্কৃতিক কিংবা সহপাঠ্যক্রমিক কাজে তা একেবারেই নয়! কার মধ্যে কোন প্রতিভা? ট্যালেন্ট তা আগে থেকে সবসময় বোঝা যায় না। তাকে নানান বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করলে তখন তার সুপ্ত প্রতিভার স্ফূরণ ঘটে৷ সময়ের সঙ্গে চলতে গিয়ে নানান সমস্যা সঙ্কুল পথ আসবে, ভেঙে পড়ার নাম জীবন নয়। চ্যালেঞ্জকে একসেপ্ট করতে হবে। আমার দারা হবে না-র থেকে করে দেখাব এই মানসিকতাটি বেশি প্রাণশক্তি দেয়। নিজেকে সময় দিতে হবে। তৈরি করতে হবে। যে ভাবে পারব না, আসলে তার দারাই হবে। সংস্কার, এতিহ্য, পরম্পরা সবকিছুকে নিজের মধ্যে কালচার করতে হয়। রাজ্যের পর্যটন ক্ষেত্রগুলো দেখার জন্য প্রতিবছর বহিঃরাজ্যের কত পর্যটক আসে৷ এতে পর্যটন শিল্পের ক্রমশ উন্নতি হচ্ছে, যদিও বেশ ধীর গতিতেই বলা চলে। ডিজিটাল ত্রিপুরা যখন আমরা বলছি, তখন ভুলে গেলে চলবে না ডিজিটালি একটা রিপ্রেজেন্টেশনের প্রশ্নও কিন্তু সংগতভাবেই আসে। প্রযুক্তি নির্ভর মেধার ট্যালেন্ট। পৃথিব্যাপীতে যখন AI জোরকদমে এগিয়ে চলছে। একশো জনের কাজ একজন করে নিতে পারে। এমনও কথা শোনা যায় এই AI না-কি মানবিক চেতনা সম্পন্ন। Z-জেনারেশন কী চায় তা বুঝে ভাবতে হবে। সময়ের দাবিকে উপেক্ষা করার কোনো অবকাশ নেই। নিজে যেখানে দাঁড়ানো তার থেকে এক কদম আগের কথা ভেবে ব্যবস্থাপনা করতে হয়।
‘উৎসব’ কথাটির নানা মাত্রিক ব্যাখ্যা আছে। এবার কোন উৎসবের গ্রহনযোগ্যতা কতটা, নির্দিষ্ট উৎসবটি জনমনে কতটা সাড়া ফেলে তার উপর নির্ভর করে উৎসবের উৎকর্ষ। বিজ্ঞান বিষয়ক প্রদর্শনী ক্রমান্বয়ে হয়ে উঠেছে বিজ্ঞান মেলায়। বইমেলা তার কলেবর বাড়িয়ে হয়ে উঠেছে উৎসব। আসলে শুধু দুর্গা পূজা, দীপাবলি, নববর্ষ-ই বাঙালির হাতেগোনা পার্বণ নয়। আন্তরিক আয়োজন এভাবেই উৎসবের মুখ হয়ে দাঁড়ায়। বারোমাসের সীমানায় বহু অগুনতি পার্বণ এসে জুড়ে গেছে ত্রিপুরাবাসীর জীবনেও। প্রতিবছর নভেম্বরমাসে ত্রিপুরার শিক্ষিত জনমানস যার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে ত্রিপুরা ইনফো আয়োজিত মেগা কুইজ। রাজ্যের বুকে এমন মেধাবী জ্ঞান চর্চার আয়োজন সম্ভবত ত্রিপুরা ইনফো-ই এখন অবদি ধারাবাহিক ভাবে করে চলেছে। শুধু ত্রিপুরা নয় সমগ্র উত্তরপূর্ব ভারতে ত্রিপুরা ইনফো-ই ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রথম অনলাইন নিউজ পোর্টাল। ২৭ বছরে একেবারে পূর্ণ যুবক৷ শুধু যুবক নয়, পূর্ণ মনস্ক মেধাবী তরুণের সঙ্গে তুলনা করা যায়। ত্রিপুরা ইনফো নানান বিষয়ে প্রচুর কাজ করেছে, তা আজ আর বলার অপেক্ষা নেই। বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষামূলক ভিডিও, নানান তথ্য সম্বলিত প্রকাশনা, পোর্টালে বহু আর্টিকেল এমনসব নানান কাজের মধ্য দিয়ে সাধারণ থেকে আজ বহু মানুষের আশ্রয়। রীতিমতো বৃহত্তর প্রতিষ্ঠান৷ ইনফোকে বরাবর দেখেছি একটি ডিসকোর্স হিসাবে। এতটা শৃঙ্খলা পরায়নতা খুব কমই দেখা যায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। এছাড়াও নানান ফিল্ডে কাজ করেছে রাজ্যের গর্বের আন্তর্জালিক সংবাদ মাধ্যম ত্রিপুরা ইনফো। আর এর পেছনে যিনি শুরুর দিন থেকে জুড়ে আছেন ইনফোর চরিত্রটি কেমন হবে, কী হওয়া উচিত তা নিজের হাতে গড়ে দিয়েছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক এই প্রতিষ্ঠানের প্রাণপুরুষ জয়ন্ত দেবনাথ। তাঁর আন্তরিক মনোভাব, গ্রহণ করার মানসিকতা, চিন্তার পারদ, আরো আরো নিজেকে গড়ে তোলার ইচ্ছাই আজকের ইনফোকে আরো বেশি সর্বজন প্রিয় করে তুলেছে। ২০০৬ সালটি ত্রিপুরার জন্য যথেষ্টই গুরুত্বপূর্ণ। কেনোনা আজকের জনপ্রিয় ‘ত্রিপুরা ইনফো মেগা কুইজ’ ১৯তম বর্ষে। এর সূচনা সেই ২০০৬ সালে৷ দেখতে দেখতে মেগা কুইজ রজত জয়ন্তীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আর এই উনিশ বছরে জল, আলো, মাটি, প্রাণের উত্তাপ দিতে এর সঙ্গে এসে স্বইচ্ছায় জুড়ে গেছেন আরো অগণিত মানুষজন। ত্রিপুরায় সরকারি বা বেসরকারি সরফে ইনফো আয়োজিত এই মেগা কুইজই এযাবৎ সর্ববৃহৎ কুইজ ইভেন্ট। কারণ এভাবে পূর্বে আর কেউ ভাবেনি, করেনি৷ ইনফো করে দেখিয়েছে। সময়ের প্রবাহে তা হয়ে উঠেছে ঐতিহাসিক। জ্ঞান-মেধা ও মননের উৎসব৷ প্রতিবছর এক দিবসীয় এই আয়োজনে কী আছে না বলে সংগতভাবে বলা যায় কী নেই। ব্যক্তিগত একটা উদ্যোগ যে এতটা প্রশাখা ছড়াতে পারে তা এই মেগা কুইজ না দেখলে বোধের গায়ে বিশ্বাস না জন্মানোরই কথা। বিভিন্ন বনেদী বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য শিক্ষার্থী, বহু চাকুরিজীবি, বহু গবেষক, নিবিষ্ট পাঠক, লেখক- সাহিত্যিক এমনকি সরকারি বিভিন্ন পদস্থ অফিসার নিজ আগ্রহে এই কুইজে অংশ নিয়ে থাকেন। রাজন্য গৌরব, ইতিহাস, দর্শন, চলচ্চিত্র, মহাকাশ গবেষণা, পরমাণু বিজ্ঞান, সংগীত, শিল্প-সাহিত্য নানান বিষয়ে বিভিন্ন মনন সম্বলিত উচ্চমানের প্রশ্ন নতুন প্রজন্মকে আকর্ষণ করছে আরো বেশি৷ একেবারে প্রফেশনার। রাজ্যের জনপ্রিয় কুইজ মাস্টারদের পাশাপাশি নন্দু পানিক্করের মতো ভারত বিখ্যাত কুইজ মাস্টারও নানান পর্বকে আরো বেশি রমণীয় করে তুলছেন৷ আসলে দেখলেই বোঝা যায় দীর্ঘদিনের শ্রম বিনা এমন যাক যমক আনা যায় না। রাজ্যবাসী আজ গর্ব করে এমন একটি ইভেন্টের জন্য। উত্তরপূর্বের অন্যান্য রাজ্যের পাশাপাশি ত্রিপুরার বিভিন্ন জেলাতেও এই কুইজের আসর যদি করা যায় — এমন দাবি বহুদিন ধরেই উঠে আসছে৷ করতে পারাটা নিশ্চয়ই ইতিবাচক হবে, কিন্তু জেলায় করতে গেলে কিছু সমস্যাও অবশ্য আছে। পরিকাঠামো, আর্থিক বিনিয়োগ, বিজ্ঞাপন এগুলোর যাবতীয় বন্দোবস্ত কোথা থেকে হবে — তা সমাধান না হলে এখনই জেলায় হওয়ার মতো সম্ভাবনা তৈরি হবে না। তবে ভবিষ্যতের কথা ভেবে ইচ্ছের গায়ে জল সিঞ্চন প্রয়োজন৷ নতুন জাতীয় শিক্ষা নীতিতে যেখানে শিক্ষার্থীদের সামাজিক সমন্বয়ে জোর দেওয়া হচ্ছে, কিংবা হ্যাপি ক্লাসরুম কনসেপ্টের কথাও কেউ কেউ বলছেন তখন এমন মেগা কুইজের মতো দিবসব্যাপী আয়োজন সকলের জন্যই অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক৷ বিভিন্ন মূল্যবান ও ব্যতিক্রমী পুরস্কার থাকে অংশগ্রহণকারী সকলের জন্যই৷ আরো একটি বিষয়ের কথা একটু বলতেই হয়, এই মেগা কুইজকে উপলক্ষ করে রেজিষ্ট্রেশন বাবদ যত টাকা জমা হয় সবটাই মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দান করার এই-যে অনন্য নজির তা কিন্তু একান্তই বিরল৷ এভাবেই নানা সূক্ষ্ম কাজের মাধ্যমে ত্রিপুরা ইনফো শিক্ষা, সাহিত্য, সমাজ ও অর্থনীতি ও জীবনবোধের নানান স্তরে নিরবে কাজ করে চলেছে। এর সুফলকে আমাদের স্বীকার করতেই হবে৷ ত্রিপুরা ইনফো যে ইতিহাস তৈরি করেছে তা আমাদের বহন করতে হবে৷ এই মেগা কুইজ এক অপার সম্ভাবনা তৈরি করেছে নতুন প্রজন্মের কাছে, জাগিয়ে তোলা ও জেগে রাখার কথা শোনায় এই মেগা কুইজ। রাজ্যের গৌরবে নতুন পালক ত্রিপুরা ইনফো আয়োজিত মেগা কুইজ। এই চলমান ইতিহাসকে নিজের অন্তরে বইতে হবে৷ কারণ স্মরণ যে সাধনারই নামান্তর।