বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত বিতর্কঃ কিছু কথা

শঙ্খশুভ্র দেববর্মণ

বিগত কয়েক মাস ধরে চরম রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় ভুগছে বাংলাদেশ। এরই মধ্যে সে দেশের জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে ফেনিয়ে উঠেছে বিতর্ক। দেশজুড়ে তৈরি হয়েছে ক্ষোভের আবহ। এই বিতর্কের মূলে রয়েছে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক নেতা আমির গোলাম আজমের ছেলে আব্দুল্লাহিল আমান আজমির মন্তব্য। আজমি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতকে স্বাধীনতার চেতনার সাথে "বেমানান" বলে পরিবর্তন দাবি করেছিলেন। তারপরেই শুরু হয় বিতর্ক। দেশের সংবিধানের বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। আজমির এমন দাবির বিরোধিতা করে তৎক্ষণাৎ বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ পথে নেমে পড়ে। সবাই মিলে গাইতে থাকে 'আমার সোনার বাংলা'। জাতীয় সংগীতকে নিয়ে শুরু হয় সে দেশের সর্বত্র ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনা।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি ভারতের জাতীয় সঙ্গীত 'জন গণ মন'এরও স্রষ্টা, এই গানটি লিখেছিলেন ১৯০৫’এ, যখন তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড কার্জনের অধীনে শাসক ব্রিটিশরা বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিকে দুটি ভাগে বিভক্ত করেছিল। “আমার সোনার বাংলা” গানটি এই ভাগের বিরুদ্ধে আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছিল। প্রবল আন্দোলনের চাপে ১৯১১’এ বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য হয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। এদিকে গানটির তাৎপর্য এবং প্রাসঙ্গিকতা হ্রাস পায় চার দশক পরে যখন বিভাজিত হয় এক সময়ের অবিভক্ত বাংলা। সেই সময়ে বিভেদের দেওয়াল উঠে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ আর পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত বাংলার মধ্যে !

ফের ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। ৩ জানুয়ারি, ১৯৭১’এ গানটি গাওয়া হয় ঢাকার পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগের জনসভায় । ৭ই মার্চ, ১৯৭১’এ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের পূর্বে গাওয়া হয়েছিল গানটি । ২৩ মার্চ, ১৯৭১’এ গানটি গাওয়া হয় বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের স্বাধীনতা প্যারেডের সময়। এর আগে ১৯৭০’এ স্বাধীনতা আন্দোলনের ওপর জহির রায়হান নির্মিত ‘জীবন থেকে নেওয়া’চলচ্চিত্রে সর্ব প্রথম ব্যবহৃত হয়েছিল এই গান । বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে এই গানকে স্বীকৃতি দেয় মুজিবনগর সরকার (গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকার বা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার)। গানটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন পরিবেশিত হতো মুক্তিযুদ্ধের সময়। অজিত রায় ছিলেন তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সুরকার । গানটির বর্তমানে প্রচলিত যন্ত্রসুর করেন তিনি।

অবশেষে এক রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মাধ্যমে ১৯৭১’এ বাংলাদেশ স্বাধীন হলে 'আমার সোনার বাংলা'কে দেওয়া হয় জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় প্রাথমিকভাবে গৃহীত গানটি ১৩ জানুয়ারি, ১৯৭২’এ স্বাধীন দেশের সরকার কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত হয়। ভারতের জাতীয় সংগীত 'জনগণমন'র মতোই, সম্পূর্ণ 'আমার সোনার বাংলা' - মূল গানের প্রথম ১০ লাইন নিয়েই গৃহীত বাংলাদেশের এই জাতীয় সঙ্গীত।

প্রসঙ্গক্রমেই উল্লেখ করতে হয় যে , আমাদের দেশেও জাতীয় সংগীত নিয়ে মাঝে মধ্যে উথলে উঠে বিতর্ক । ১১ ডিসেম্বর, ১৯১১’এ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন ‘জনগণমন’ ’ । ওই বছরেরই ২৮ ডিসেম্বর’এ কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে প্রথমবার এই গান গাওয়া হয়েছিল। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বিভিন্ন মন্ত্রীদের সামনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইঝি সরলা দেবী চৌধুরানী এই গানটি প্রথমে সুর করেছিলেন। পরবর্তীতে আবিদ আলী এটিকে উর্দু ভাষায় রূপান্তরিত করেন। পরের বছর অর্থাৎ ১৯১২’এ এই গানটি ব্রহ্মসংগীত আখ্যায় আদি ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার মাঘ ১৩১৮ সংখ্যা অর্থাৎ জানুয়ারি ১৯১২ সংখ্যায় প্রচারিত হয়েছিল ‘ভারত বিধাতা’ শিরোনামে । সেই বছর মাঘোৎসবেও গীত হয় এই গান।

১৯৩৭ সালের ৩ নভেম্বর ‘ম্যাড্রাস মেল’ পত্রিকার সম্পাদক সমীপেষু বিভাগে একটি দীর্ঘ চিঠি লিখেছিলেন রবীন্দ্র অনুরাগী আইরিশ নাট্যকার, শিক্ষাবিদ এবং সাংবাদিক জেমস কাজিনস। তিনি লিখেছিলেন, ‘‘একটা সম্পূর্ণ জাতির আশা আকাঙ্ক্ষা ও উচ্চতম কল্যাণের প্রতীক এই গান সমস্ত দেশে সুপরিচিত। এর সুর ও ছন্দ এমনই, নিশ্চিত উৎসাহের সঙ্গে সমবেত কন্ঠে এই গান গাওয়া চলে।...ভারতবর্ষে মানবজীবনের যে বৈচিত্র্য, তা এই জনগণ গানে যেমন ফুটেছে, তেমনি তার অন্তঃশায়ী সত্য ঐক্যের সন্ধান দিয়েছে। বহিরঙ্গের অসম্ভব মিলনের কথা বলেনি, উচ্চারণ করেছে তার সত্যিকারের আত্মিক মিলনের বাণী, যা ফুটে উঠেছে বৈশ্বিক জীবনের সঙ্গে মিলনের প্রতি তাঁর সার্বিক আকাঙ্ক্ষার মধ্যে দিয়ে, যে জীবনে আমাদের সকলেরই অংশ আছে...এই গানে যে প্রার্থনা ধ্বনিত হয়েছে, তাতে যে কোনও ধর্মে বিশ্বাসী মানুষ নির্দ্বিধায় যোগ দিতে পারেন।...’’ পাশ্চাত্য সঙ্গীত বিশেষজ্ঞা কাজিনস-পত্নী মার্গারেট গানটির স্বরলিপি রচনা করেন। এই স্বরলিপিটিই অনুসরণ করা হয় আজও । উল্লেখ্য, ১৯৩৭’এ সুভাষচন্দ্র বসু জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে প্রথম জনগণমন গানটির নাম প্রস্তাব করেন । ৫ জুলাই, ১৯৪৩’এ ঘোষণা করা হয় আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠনের কথা । জাতীয় সংগীত হিসেবে সেই দিনই প্রথম ‘জনগণমন’ গাওয়া হয়।

অমর্ত্য সেন তাঁর ইংরেজি অনুবাদে ‘জনগণমন’র অধিনায়ককে ‘‘সাধারণ মানুষের হৃদয়ে আসীন জননেতা’’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু এর বিপ্রতীপে অনেকের অভিমত, দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ব্রিটিশ শাসকের দরবার উপলক্ষ্যে রচিত হয়েছিল ‘জনগণমন’ । ওই দরবারেই পঞ্চম জর্জ’কে ভারতের সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল ! এই অভিযোগ নতুন নয়। মাঝে মধ্যেই এই বিতর্ক মাথা চাড়া দেয়। ২০১৫’এ রাজস্থানের গভর্নর কল্যাণ সিং এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি মার্কন্ডেয় কাটজু বিষয়টি আবারও উত্থাপন করেছিলেন।

গভর্নর কল্যাণ সিংহ’র অভিযোগ ছিল, নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জনগণমন’ আসলে ব্রিটিশ শাসকদের প্রশংসাসূচক গান । এই গানে তিনি ‘অধিনায়ক’ শব্দের পরিবর্তে ‘মঙ্গলদায়ক’ শব্দের অন্তর্ভুক্তি দাবী করেন ! ‘অধিনায়ক’ শব্দে নাকি পঞ্চম জর্জ’কে সম্বোধিত করা হয়েছে। ভারতের জাতীয় সংগীত বদলের পক্ষে তিনি একা নন। মার্কন্ডেয় কাটজু’রও একই অভিমত। তিনি এক নিবন্ধে লিখেছিলেন, জনগণমন, যেটি ১৯৫০’এ জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠে, আসলে তা ভারত ভ্রমণের সময় ব্রিটিশ সম্রাট জর্জ পঞ্চমকে সম্বোধিত করে "রচিত এবং গাওয়া হয়েছিল" ! কাটজু তার বক্তব্যের সমর্থনে কিছু গোলমেলে তথ্যও তুলে ধরেন ! তাঁর বক্তব্য দেশের জাতীয় সংগীত ১৯১১’র ডিসেম্বরে ব্রিটিশ সম্রাটের জন্য " পরিদর্শনের সময়ে সুনির্দিষ্টভাবে রচিত হয়েছিল" এবং এই গান "মাতৃভূমির প্রতি কোনও ভালবাসারও দ্যোতক নয়।" গানটিতে উল্লিখিত "প্রভু বা শাসক" এবং ১৯১১’র "ভারত ভাগ্য বিধাতা’’ আদতে ছিল ব্রিটিশ শাসকই । সংস্কৃত বহুল বাংলায় রচিত ‘জনগণমন’ নিয়ে আবার অভিযোগকারীদের একাংশের বক্তব্য হল, এই গানে ভারতের বিভিন্ন জাতি এবং অঞ্চলগুলির মহত্ব সম্পূর্ণরূপে প্রতিফলিত হয় নি।

তবে এসব অভিযোগ কিন্তু মানতে নারাজ ইতিহাসবিদেরা। তাঁদের বরং অভিমত, ‘জনগণমন’ যে ব্রিটিশ শাসকদের সম্মানার্থে প্রশস্তি সংগীত নয় - অভিযোগকারীরা এসব জানার পরেও সব সময় কিছু বিকৃত তথ্য পরিবেশন করার চেষ্টা করে । সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী প্রথম এশীয় এবং দেশপ্রেমিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু বিদেশি শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ছিলেন না; পঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে ইন্দো-ব্রিটিশ ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী গণহত্যার প্রতিবাদে তিনি নাইট উপাধি পর্যন্ত ত্যাগ করেছিলেন। বঙ্গভঙ্গের সময় ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে পথে নেমে সোচ্চার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। ইতিহাসবিদরা তাই মনে করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘জনগণমন’ সম্পর্কে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণাগুলির অবসান করা দরকার।

আসলে বিকৃত তথ্য রটনার পেছনে কাজ করে কিছু মহলের দুরভিসন্ধিমূলক প্ররোচনা ! রটনাকারীরা ওই সময়ে প্রকাশিত ‘দ্য ইংলিশম্যান’ এবং ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় ‘জনগণমন’ সম্পর্কিত প্রকাশিত প্রতিবেদনটির কথা বারবার উল্লেখ করেন । ১৯১১’র ডিসেম্বরে ভারত ‘পরিদর্শন’এর সময় ব্রিটিশ সম্রাট পঞ্চম জর্জ’এর দিল্লি দরবার উপলক্ষ্যে ‘দ্য ইংলিশম্যান’ এবং ‘দ্য স্টেটসম্যান’ লিখেছিল, ‘কয়েক জন বাঙালি ছেলেমেয়ে সমবেত কন্ঠে হিন্দিতে পঞ্চম জর্জের প্রশস্তিতে জয়গান গেয়েছে।’ বিভ্রান্তি বেড়েছিল এমন প্রতিবেদনেই । সত্যি কথা বলতে কী, সেই প্রতিবেদন পড়ে তখন অনেকেই ভেবেওছিলেন, পঞ্চম জর্জ’কে সম্ভাষিত করার জন্যই ওই গান লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ! ঘটনা হল, রাজার সম্মানে সেদিন হিন্দিতে রামভূজ চৌধুরীর একটি গান গাওয়া হয়। কিন্তু সংবাদপত্রের বিভ্রান্তিমূলক প্রতিবেদনের কারণে রবীন্দ্রবিরোধীগণ মওকা পেয়ে যান । রামভুজ চৌধুরীর সেই গানকে তারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জনগণমন’এর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছিলেন। প্রকৃত ঘটনা যাচাই না করেই তেড়েফুঁড়ে তখন তারা প্রচার করতে থাকেন ‘জনগণমন’ আসলে ইংল্যান্ডের অধীশ্বরের জন্য রচিত বন্দনা সংগীতই !

এরপর কেটে গিয়েছিল প্রায় পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর । ’জনগণমন’ নিয়ে বিতর্ক চলছিল তখনও । অত্যাবশ্যক হয়ে উঠেছিল এই অর্থহীন বিতর্কের আশু সমাধান। সেই উদ্দেশ্যেই বয়সে সাতচল্লিশ বছরের ছোট পুলিনবিহারী সেন কবির কাছে জানতে চেয়েছিলেন এই গানের সঠিক ঐতিহাসিক তথ্য এবং ব্যাখ্যা। রবীন্দ্রনাথ সেই প্রশ্নের প্রেক্ষিতেই তরুণ পুলিনবিহারী সেন’কে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘জনগণমনঅধিনায়ক গানটি কোনও উপলক্ষ্য-নিরপেক্ষ ভাবে আমি লিখেছি কিনা তুমি জিজ্ঞাসা করেছ। বুঝতে পারছি এই গানটি নিয়ে দেশের কোনও কোনও মহলে যে দুর্বাক্যের উদ্ভব হয়েছে তারই প্রসঙ্গে প্রশ্নটি তোমার মনে জেগে উঠল। …আমি জনগণমন অধিনায়ক গানে সেই ভারতভাগ্যবিধাতার জয় ঘোষণা করেছি, পতন অভ্যুদয় বন্ধুর পন্থায় যুগ যুগ ধাবিত যাত্রীদের যিনি চিরসারথি, যিনি জনগণের অন্তর্যামী পথপরিচায়ক, সেই যুগযুগান্তরের মানবভাগ্যরথচালক যে পঞ্চম বা ষষ্ঠ কোনো জর্জই কোনক্রমেই হতে পারেন না …।‘’

২৪ জানুয়ারি ১৯৫০’এ ভারতের সংবিধান সভা জনগণমন গানটিকে জাতীয় সংগীত বা ন্যাশনাল অ্যানথেম হিসাবে গ্রহণ করেন। সেদিন সভাপতি ডক্টর রাজেন্দ্র প্রসাদ বলেছিলেন, “জনগণমন নামে পরিচিত গানটি এখন থেকে কথা ও সুরসহ ভারতের জাতীয় সংগীতরূপে সরকারিভাবে গীত হবে।‘’ ভারতের জাতীয় সংগীতের বৈধতা কিম্বা গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কিত সঠিক তথ্য, সূত্র এবং ভাষ্যের অভাব নেই । এতদ সত্বেও এই গানের বিরুদ্ধে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল বারবার অপপ্রচারে লিপ্ত হয়।

একই অবস্থা আজ পরিলক্ষিত হচ্ছে বাংলাদেশেও। সে দেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’কে বাতিলের একটা রব উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্বেও বাংলাদেশের মুসলিম মৌলবাদীরা তাঁকে ‘হিন্দু’ বানিয়ে ছেড়েছে। তাদের মূল বক্তব্য হল, হিন্দু রবীন্দ্রনাথের রচিত ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি মুসলিম প্রধান বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য নয়। আবার ৩



আর একদলের অভিমত, ‘আমার সোনার বাংলা’ আসলে লালন ফকিরের ভক্ত তথা বাউল গায়ক গগন হরকরা’র ‘কোথায় পাবো তারে’ গানের নকল। এমন নকল সুর কোনও দেশের জাতীয় সংগীত হতে পারে না। এ প্রসঙ্গে কবিগুরুর ঘনিষ্ঠ শান্তিদেব ঘোষ লিখেছিলেন যে, ‘কোথায় পাবো তারে’ গানের সারল্য এবং মাধুর্যের সঙ্গে মিলিয়ে আমার সোনার বাংলা রচিত হলেও -দু’টি গানের ভাব এবং অনুষঙ্গ আলাদা। সুতরাং এই গানের মৌলিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা অবান্তর ।



উল্লেখ্য, অনেক গবেষকের অভিমত ভারত এবং বাংলাদেশ ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই হলেন শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীত ‘ নম নম নম নম মাতা, সুন্দর শ্রী বরনী’র মূল রচয়িতা ও সুরকার। শ্রীলঙ্কা থেকে শান্তিনিকেতনে পড়তে এসেছিলেন আনন্দ সমরকুন। ছাত্র হিসেবে মেধাবী ছিলেন বলে ক্রমে তিনি রবীন্দ্রনাথের আস্থা লাভ করেন। ১৯৩৮’এর কথা। আনন্দ সমরকুন তাঁর দেশের জন্য একটি গান লিখে দেবার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অনুরোধ করেছিলেন। প্রিয় ছাত্রের অনুরোধে সাড়া দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘’নম নম শ্রীলঙ্কা মাতা’’ সুর সহ বাংলা গানখানি উপহার দিয়েছিলেন । ১৯৪০’এ শান্তি নিকেতনের শিক্ষা সমাপ্তির পর গুরুদেবের রচিত এবং সুরারোপিত গানটি নিয়ে দেশে ফিরেছিলেন আনন্দ সমরকুন। ১৯৪৬’এ শ্রীলঙ্কায় এই গানটির রেকর্ড বেরিয়েছিল সিংহলিভাষায় । ৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮’এ ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয় শ্রীলঙ্কা। ১৯৫০’এ স্যর এডউইন ওয়াসজারএটনির নেতৃত্বে স্বাধীন শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীত নির্ধারণের জন্য গঠিত হয় একটি কমিটি। ওই কমিটির কাছে তখন আনন্দ সমরকুন তাঁর অনূদিত ‘নম নম শ্রীলঙ্কা মাতা’ গানটি পেশ করেন। ২২ নভেম্বর, ১৯৫১’এ আনন্দ সমরকুনের অনূদিত গানটিকেই শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি দেয় কমিটি । প্রিয় ছাত্রকে লিখে দেওয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূল গানটির অনূদিত সংস্করণ স্বীকৃতি পেল শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে।

গত শতকের পঞ্চাশ দশকের শেষার্ধে এই গানটিকে নিয়ে শ্রীলঙ্কায় বিতর্ক দানা বেঁধেছিল। অনেকেই তখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন যে, গানটির ‘’ নম নম মাতা শ্রীলঙ্কা’’ লাইনটি অপয়া তথা দেশের সমস্ত অশান্তির কারণ। পরপর দেশের দুই প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুর পর এই বিশ্বাস জনমানসের একাংশে আরও পোক্ত হয়। ফেব্রুয়ারি, ১৯৬১’এ আনন্দ সমরকুনের তীব্র আপত্তি সত্বেও শ্রীলঙ্কার সরকার গানটির প্রথম লাইনে উল্লিখিত নম নম’র পরিবর্তে সংযোজন করে ‘’শ্রীলঙ্কা মাতা, আপা শ্রীলঙ্কা’’। এপ্রিল, ১৯৬২’এ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত এবং সুরারোপিত গানটির অন্তরাত্মাকে খুন করা হয়েছে এমন অভিযোগ তুলে বিমর্ষ আনন্দ সমরকুন আত্মহত্যা করেন !

আসলে উপমহাদেশের এটাই ট্র্যাজেডি যে, সৃজন শৈলীতে রবীন্দ্র ভাবনা বৈশ্বিক হলেও আজ সেই ব্যাপ্ত দর্শনকেই আক্রমণ করতে তৎপর হয়ে উঠেছে কিছু মৌলবাদী, স্বার্থান্বেষী চক্র। ভারতের প্রতি বিশ্ব বন্দিত কবির আনুগত্য নিয়ে আজও তাই প্রশ্ন উঠে । বাংলাদেশেও আজ একই রকম ভাবে প্রশ্ন তোলা হয় রবীন্দ্রনাথের ধর্ম এবং বাঙ্গালিত্ব প্রসঙ্গে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের ধর্ম বিষয়ক উপদেষ্টা ড. খালিদ হোসেন অবশ্য জানিয়েছেন , ”জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন নিয়ে ভাবা হচ্ছে না। বিতর্ক সৃষ্টি করে এমন কিছু অন্তর্বর্তী সরকার করবে না।” তবে কী এটাই ধরে নিতে হবে যে, শুধু বিতর্কের ভয়েই বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত আপাতত মুলতুবী রেখেছে ! দেখা যাক আগামী দিনে কী হয়।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.