আনায়ুত্তু,হাতি ও আনারস

পান্নালাল রায়

ছোট একটি খবর,কিন্তু ঐতিহ্যের আলোয় উদ্ভাসিত। কেরালার আনায়ুত্তু উৎসবে ত্রিপুরার আনারস পাঠানো হয়েছিল। আর এই খবরের সূত্রেই যেন উৎসবটির আলোকে ঝিলিক দিয়ে উঠে ত্রিপুরার হাতি আর আনারসের কথাও। দেশ বিদেশে ত্রিপুরার রসালো ফল আনারসের সুখ্যাতি রয়েছে।এবার যেমন কেরালায় হাতিদের ভোজন উৎসবে ত্রিপুরার কুইন প্রজাতির আনারস পাঠানো হয়েছিল, তেমনই রাজ আমলেও রাজার কূটনৈতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে আনারস। আনায়ুত্তু'র মতো ত্রিপুরাতে কোনও উৎসবের আয়োজন না হলেও হাতি এখানেও ঐতিহ্যের সাথী।হাতির লোভে একদা ত্রিপুরায় মোগল আক্রমণ ঘটেছিল,আবার সিংহাসনে রাজা বদলও ঘটেছে হাতির জন্য।

আমাদের ভাষা-সংস্কৃতির বৈচিত্র্যের এই দেশে উৎসব অনুষ্ঠানেও বৈচিত্র্য কম নয়।দেশের নানা অঞ্চলে বছর ভর নানা ধরণের উৎসব অনুষ্ঠান লেগেই আছে।এর মধ্যে এমন কিছু আছে যা একান্তই প্রকৃতি নির্ভর,কিছু আবার বন্য পশুপাখি নির্ভরও।বন আর বন্য প্রাণীর সুরক্ষার উদ্দেশ্যেই যে একদিন এইসব উৎসবের সূচনা ঘটেছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।এমনকি প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যেও রয়েছে প্রকৃতি প্রেমের অনবদ্য বিবরণ।আনায়ুত্তু এমনই একটি উৎসব,যা উদযাপিত হয় হস্তী ভোজনের মাধ্যমে। কেরালার ত্রিশূর শহরে প্রতিবছর ভাদাক্কুন্নাথান মন্দির প্রাঙ্গনে এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।মালয়ালম ক্যালেন্ডার অনুসারে তা অনুষ্ঠিত হলেও সাধারণত ইংরেজি জুলাই মাসেই তা পড়ে থাকে।উৎসবের অঙ্গ হিসেবে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড় করানো হয় হাতিদের।মন্দির প্রাঙ্গণে সমবেত পুণ্যার্থী মানুষ প্রার্থনা করে এবং হাতিদের শুঁড়ের সামনে তুলে দেয় তাদের প্রিয় নানা সুস্বাদু খাবার। প্রচলিত বিশ্বাস হাতিদের এই ভোজনের মাধ্যমে ভগবান গণেশকে সন্তুষ্ট করা যায়।উৎসবের সময় হাতিদের সাধারণত চাল,গুড়,ঘি,নারকেল,আনারস ইত্যাদি ভোজন করানো হয়।ত্রিশূরের ভাদাক্কুন্নাথান মন্দিরটি দক্ষিণ ভারতের প্রাচীনতম শিব মন্দির। উল্লেখ করা যায় যে,কেরালার সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হচ্ছে হাতি এবং সেখানকার প্রায় সব উৎসবেই হাতির উপস্হিতি অপরিহার্য। শুধু কেরালা কেন,দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন মন্দিরেও হাতি রাখা হয়।বিভিন্ন মন্দিরে পর্যটক পুণ্যার্থীরা ভিড় জমান হাতির সামনে।উল্লেখ করা যায় যে,কয়েক বছর আগে কেরালায় একটি গর্ভবতী হস্তিনীর মৃত্যু ঘিরে সামাজিক মাধ্যমে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। দক্ষিণ ভারত সহ গোটা দেশ ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল সেদিন। বিচ্ছিন্ন ভাবে কখনও এদিক সেদিক এরকম কিছু ঘটনা ঘটলেও আমাদের দেশের মানুষ কিন্তু মূলত পশুপ্রেমী।অনভিপ্রেত কোনও ঘটনা ঘটে গেলে মানুষই এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়।আমাদের উৎসব অনুষ্ঠানেও রয়েছে পশুর উপস্হিতি।আরাধ্য দেবদেবীর বাহন হিসেবেও আছে পশু-পাখি।তাই কেরালার আনায়ুত্তু কোনও বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়,সামগ্রিক ভাবে ভারতীয় উৎসব-সংস্কৃতির পরম্পরার অঙ্গই তা।

শুধু কেরালা কেন,ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলেও হাতি ঐতিহ্যের সাথী।এই অঞ্চলের সমাজ,সংস্কৃতি,ইতিহাস ও কিংবদন্তীতে রয়েছে হাতির গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান। হাতিকে এখানের অরণ্যের অলঙ্কার বলা যেতে পারে।অতীতে মোগল শাসকরা এই অঞ্চলের হাতির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। সেদিনের যুদ্ধক্ষেত্রে হাতি যেন ছিল জীবন্ত ট্যাঙ্ক। মোগলরা সে জন্য উত্তর পূর্বাঞ্চল থেকে হাতি সংগ্রহে সচেষ্ট ছিল।সম্রাট আকবরের মন্ত্রী আবুল ফজলের মতে সম্রাটের পিলখানার উৎকৃষ্ট হাতি ছিল ত্রিপুরার। আবুল ফজল তাঁর 'আইন-ই-আকবরী'তে সম্রাট আকবরের সমসাময়িক ত্রিপুরার রাজা বিজয় মাণিক্যের বাহিনীতে সহস্র হাতির কথা উল্লেখ করেছেন। এই হাতির জন্য সপ্তদশ শতকের শুরুতে মোগলদের হাতে প্রথম ত্রিপুরা আক্রান্ত হয়েছিল। অবশ্য মোগলদের আগেও হাতির লোভে বঙ্গের মুসলমান শাসকদের হাতে ত্রিপুরা আক্রান্ত হবার কথা বলেছেন ঐতিহাসিকগণ।এমনকি ত্রিপুরার সিংহাসনে রাজা বদলের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে হাতি।প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে ব্যবহৃত হয়েছে অরণ্যের আপাত নিরীহ এই প্রাণীটি। ত্রিপুরার রাজাদের মাণিক্য উপাধি ধারণের সঙ্গেও হাতির এক ক্ষীণ যোগসূত্র রয়েছে।অসমেও হাতি ঐতিহ্যের সাথী।মহাভারতের যুগ থেকেই বহমান তা।উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মধ্যে সর্বাধিক হাতি রয়েছে অসমে।অতীতের তুলনায় অবশ্য বর্তমানে এই সংখ্যা দারুণ ভাবে কমে এসেছে।একদা রাজাদের শক্তির অন্যতম মাপকাঠি ছিল হাতি। ইতিহাস, প্রাচীন কাব্য এবং চৈনিক পরিব্রাজকদের ভ্রমণ বিবরণীতে অসমের হাতির উল্লেখ রয়েছে।এমনকি মহাভারতেও অনুল্লেখ্য নয় অসমের হাতি।কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে পান্ডব সেনাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল প্রাগজ্যোতিষের নৃপতি ভগদত্তের হাতি সুপ্রতীক।সুদূর অতীতে কামরূপ নৃপতি কুমার ভাস্করবর্মণ কণৌজের বৌদ্ধ সম্মেলনে যোগদানের সময় পাঁচশ হাতির মিছিল নিয়ে গিয়েছিলেন। হিউয়েন সাঙ তাঁর ভ্রমণ বিবরণীতে অসমের সমৃদ্ধ হাতির উল্লেখ করেছেন। এই ভাবে উত্তর পূর্বাঞ্চলেও ইতিহাস, সমাজ-সংস্কৃতিতে হাতির অবস্থান।প্রসঙ্গত অস্কারে হাতি মানুষের সম্পর্কের জয়গাঁথার কথাও উল্লেখ করা যায়।গত বছর ভারতীয় তথ্যচিত্র 'দ্য এলিফ্যান্ট হুইসপারার্স' অস্কার লাভ করেছিল সেরা তথ্যচিত্র হিসেবে।এক অনাথ হস্তিশাবক ও মানুষের সম্পর্কের কাহিনী নিয়ে তৈরি হয়েছিল এই তথ্যচিত্রটি।তাই বলা যায় উৎসবের পাশাপাশি মানুষ ও পশুর চিরন্তন সম্পর্কও আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির অঙ্গ। মানুষের বাঁচার জন্যই চাই প্রকৃতির নিবিড় বন্ধন,চাই মানুষ ও পশুদের সহাবস্থান।

এবার আসা যাক ত্রিপুরার আনারসের কথায়।আনায়ুত্তু উৎসবে হস্তী ভোজনের জন্য কেরালায় পাঠানো হয়েছিল ত্রিপুরার কুইন ভ্যারাইটির আনারস, যা নাকি হাতিদের খুবই পছন্দের !কেন্দ্রীয় পর্যটন প্রতিমন্ত্রী এ জন্য ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদও জানিয়েছেন। ত্রিপুরার আনারস আজ দেশ বিদেশে সমাদৃত হচ্ছে।রাজ্যে উৎপাদিত কুইন আনারস ভারত সরকারের জি আই ট্যাগ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবার পর এর কদর আরও বাড়ছে।উল্লেখ করা যায়,দেশের মধ্যে আনারস উৎপাদনে ত্রিপুরা পঞ্চম স্হানে রয়েছে।সারা দেশের মোট আনারস উৎপাদনের ৯.৫ শতাংশ উৎপাদিত হয় ত্রিপুরায়।ত্রিপুরা ছাড়াও অসম,পশ্চিমবঙ্গ, কর্ণাটক, মেঘালয়,মণিপুর, অরুণাচল প্রদেশ ও কেরালাতেও ভালোই আনারস উৎপাদন হয়ে থাকে।ত্রিপুরায় বারো হাজার হেক্টরেরও বেশি এলাকায় আনারস উৎপাদিত হয়।বছরে উৎপাদনের পরিমাণ ১৭৮ হাজার মেট্রিক টনেরও বেশি।

অনেক আগে থেকেই বহির্রাজ্যের খাদ্য রসিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসছে ত্রিপুরার আনারস। ত্রিপুরার দূরদর্শী রাজা বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্য একদা তাঁর কূটনৈতিক তৎপরতায় আনারস ব্যবহার করেছিলেন।তিনি দেশীয় রাজ্য সমূহের রাজন্যবর্গের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক বজায় রাখার উদ্দেশ্যে দেশের নানা প্রান্তে তাদের কাছে প্রীতি উপহার হিসেবে পাঠাতেন এই রসালো ফলটি।এমনকি তদানীন্তন ইংরেজ কর্তৃপক্ষের কাছেও রাজা নিয়মিত আনারস পাঠাতেন। বীরবিক্রমের রাজত্বকালে কখনও গাড়োয়াল, কখনও পান্না রাজ্য,আবার কখনও বা বাংলার মুর্শিদাবাদে পার্সেল করে আনারস পাঠানো হতো।সবাই ত্রিপুরার এই ফলটির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।মুর্শিদাবাদের নবাব আবার প্রতি প্রীতি উপহার হিসেবে তাঁর রাজ্যের আমও পাঠিয়েছিলেন ত্রিপুরার রাজার কাছে।বীরবিক্রমের রাজত্বকালে রাজ প্রশাসনের কাছে আসা বহির্রাজ্য কর্তৃপক্ষের চিঠিপত্রে ধরা পড়ে রাজার আনারস কূটনীতির ছবিটি।উল্লেখ করা যায় যে,তদানীন্তন দেশীয় রাজ্য সমূহের রাজন্যবর্গের সঙ্গে বীরবিক্রমের সুসম্পর্ক ছিল। বলা যায় উত্তর পূর্বাঞ্চলে তিনি এক নেতৃস্হানীয় ভূমিকায় ছিলেন। অন্যান্য রাজ্যের রাজন্যবর্গের সঙ্গে সর্বদা সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করতেন ত্রিপুরার রাজা।প্রীতি উপহার হিসেবে তাদের কাছে পাঠাতেন ত্রিপুরার রসালো সুমিষ্ট ফলটি।১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১৩ জুন ভাবনগর রাজ্যের মহারাজা সাহেব আনারস প্রাপ্তির জন্য ত্রিপুরার রাজাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছেন। সে বছরের ২২ জুন পান্নার রাজার ব্যক্তিগত সচিব ত্রিপুরার রাজার নিজ তহবিল সচিবকে চিঠি লিখে আনারস পাঠানোর জন্য রাজাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন।অনুরূপ ভাবে ঢোলপুর,তেহরি গাড়োয়াল,গোয়ালিয়র রাজ্য সমূহের রাজাদের কাছ থেকেও আনারসের প্রাপ্তির স্বীকার করে ধন্যবাদ জানানো হয় ত্রিপুরার রাজাকে।১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের ১০ জুন মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুরের ব্যক্তিগত সচিব চিঠি লিখে ত্রিপুরার রাজাকে নবাবের ধন্যবাদ জানান। ত্রিপুরার রাজার জন্য নবাবের প্রীতি উপহার হিসেবে মুর্শিদাবাদ থেকে আমও পাঠানো হয়েছিল তখন। দেশীয় রাজ্যের রাজন্যবর্গের পাশাপাশি তদানীন্তন ইংরেজ কর্তৃপক্ষের কাছেও মহারাজ বীরবিক্রম আনারস পাঠিয়েছিলেন। বাংলা ও আসামের গভর্ণরের কাছেও গিয়েছিল ত্রিপুরার আনারস এবং তা প্রশংসিত হয়েছিল। এই ভাবেই বীরবিক্রমের কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যুক্ত হয়ে পড়েছিল আনারস। কেরালার ঐতিহ্যবাহী আনায়ুত্তু উৎসবে পাঠানোর মাধ্যমে ত্রিপুরার সেই আনারস যেন অতীত ঐতিহ্যের আলোয় আবার উদ্ভাসিত হলো।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.