ত্রিপুরার কৃষি ও কৃষকের সমস্যা

অভিষেক ভৌমিক

June 29, 2025

ত্রিপুরা একটি কৃষিপ্রধান রাজ্য। এখানকার অধিকাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। তবুও কৃষি ও কৃষকের সমস্যার কারণে রাজ্যের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে।প্রচুর জমি অনাবাদী অবস্থায় পড়ে রয়েছে, আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির অভাব, সেচ ব্যবস্থার দুর্বলতা, এবং ফসলের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় কৃষকরা দিনদিন হতাশ হয়ে পড়ছেন। পাশাপাশি কৃষিঋণ পাওয়ায় জটিলতা এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কৃষকের সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। কৃষিপণ্যের পর্যাপ্ত সংরক্ষণ ও বিপণনের ব্যবস্থা না থাকায় উৎপাদিত ফসল অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায়। সরকারি সহায়তার যথাযথ বন্টন না হওয়া এবং কৃষিনীতির দুর্বল বাস্তবায়নের ফলে কৃষকরা বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাই ত্রিপুরায় কৃষির টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, কৃষকদের সচেতনতা বৃদ্ধি, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং একটি শক্তিশালী কৃষি নীতি।

আমাদের রাজ্য ত্রিপুরার মোট জমির প্রায় ২৭% কৃষির উপযোগী। প্রধান ফসলগুলির মধ্যে ধান, সরিষা, ডাল, আনারস, কমলা, আদা, কাঁচামরিচ, কফি ও রাবার অন্যতম। বর্তমানে রাজ্যের মোট চাষযোগ্য জমির ৮% জৈব চাষের আওতায় রয়েছে, যা ২০% পর্যন্ত বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। তবে ত্রিপুরায় চাষাবাদের বেশিরভাগই মৌসুমি বৃষ্টির উপর নির্ভরশীল, ফলে উৎপাদন প্রায়শই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। তবে তথ্যের আধারে বলতে পারি, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ত্রিপুরায় প্রায় ৮.৫ লক্ষ মেট্রিক টন ধান উৎপাদিত হয়েছে, যা রাজ্যের মোট খাদ্যশস্য উৎপাদনের প্রায় ৭৫%। সেচের পরিকাঠামো এখনও পর্যাপ্ত নয়, ফলে খরার সময় কৃষকরা চরম ক্ষতির সম্মুখীন হন। তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মৌসুমি বৃষ্টির অনিয়মিততা আরও প্রকট হয়েছে। গত ১০ বছরে ত্রিপুরায় গড় বৃষ্টিপাত প্রায় ১২% কমেছে, যা রবি ফসলের (শীতকালীন মৌসুমে বপন করা হয় এবং বসন্তকালে (মার্চ–এপ্রিল) কাটা হয়) উৎপাদনে সরাসরি প্রভাব ফেলছে।আধুনিক কৃষিযন্ত্রের অভাব ও কৃষি প্রশিক্ষণের সীমাবদ্ধতা উৎপাদনশীলতা হ্রাসে ভূমিকা রাখছে।

অন্যদিকে, বহু কৃষক এখনো প্রথাগত চাষ পদ্ধতিতে নির্ভরশীল, যার ফলে মাটি দ্রুত অবক্ষয় হচ্ছে এবং দীর্ঘমেয়াদে ফসলের গুণগত মানও কমে যাচ্ছে। বাজারে সঠিক দামে ফসল বিক্রির সুযোগ না থাকায় কৃষকরা ন্যায্য লাভ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রচুর কৃষক ঋণগ্রস্ত যার ফলে রাজ্য কৃষি দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪–২০২৪ সালের মধ্যে আনুমানিক ৮,২০০ জন কৃষক কৃষিকাজ ছেড়েছেন। যদিও আত্মহত্যার হার অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় কম, তবুও আর্থিক চাপ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ কৃষকের মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ফসলহানি বা বাজারমূল্যের পতনের কারণে কৃষকেরা সহজেই ঋণের ফাঁদে পড়ে যান। অনেক সময় তারা মহাজনের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হন।সরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জটিল ঋণপ্রদান প্রক্রিয়া, জামিন সংক্রান্ত কঠোরতা ও দালালচক্রের দৌরাত্ম্যে অনেক কৃষক সেই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। ফলে তারা বেসরকারি ঋণদাতার কাছ থেকে ঋণ নিয়ে দীর্ঘমেয়াদে আর্থিকভাবে জর্জরিত হয়ে পড়েন।

ফসলের ন্যায্য মূল্য না পাওয়া, বাজার ব্যবস্থার অস্থিরতা এবং ফসল সংরক্ষণের অভাবে কৃষকের আর্থিক স্থিতি দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে এই আর্থিক চাপে কৃষকদের চরম সিদ্ধান্ত নিতে দেখা যায়, যা সামাজিক ও মানবিক সংকটকেও ডেকে আনে। তবে বর্তমানে রাজ্য সরকার ত্রিপুরা রাজ্যের কৃষি ও কৃষক কল্যাণ বিভাগের ২০২৪-২৫ সালের বার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, কৃষি খাতে শ্রমশক্তির ধীরে ধীরে হ্রাসের কারণে রাজ্য সরকার কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়ানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে, কৃষি খাতে বিদ্যমান ১.৩২৮ কিলোওয়াট/হেক্টর ফার্ম পাওয়ার বাড়িয়ে ১.৪৪৫ কিলোওয়াট/হেক্টর করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়াও, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১৪,৪০৮টি বিভিন্ন কৃষি যন্ত্রপাতি ভর্তুকির মাধ্যমে বিতরণের পরিকল্পনা রয়েছে।

এই পদক্ষেপগুলি নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন, তবে শুধু যন্ত্রপাতি সরবরাহ করলেই সমস্যার সমাধান হবে না। কৃষকদের আধুনিক চাষের কৌশল, মাটি পরীক্ষার পদ্ধতি, জৈব সার ও পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণের টেকসই পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ প্রদান করা জরুরি। পাশাপাশি, ফসল বিমা স্কিমের যথাযথ বাস্তবায়ন, কৃষিপণ্যের ন্যায্য মূল্যের নিশ্চয়তা এবং সরাসরি বাজারের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন কৃষকের আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে। কৃষি সহায়ক সমবায় গঠনের মাধ্যমে মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব হ্রাস করা সম্ভব। এবং, ত্রিপুরার মতো পাহাড়ি ও সীমান্তবর্তী রাজ্যে পরিবহণ ও সংরক্ষণের উপযুক্ত অবকাঠামো গড়ে তোলা অত্যন্ত প্রয়োজন। স্থানীয় উৎপাদিত পণ্যের রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণ এবং কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপন করলে রাজ্যে কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।

সবচেয়ে বড় কথা, কৃষকদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে—তাঁদের কেবল "দাতা" হিসেবে না দেখে, তাঁদের উৎপাদনের যথাযথ মূল্য নিশ্চিত করতে হবে। কৃষি যেন কেবল বেঁচে থাকার মাধ্যম না হয়ে লাভজনক ও সম্মানজনক পেশায় পরিণত হয়, সেই লক্ষ্যেই এগোতে হবে সরকার ও সমাজকে একযোগে। এই লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদি ও সুসমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে ত্রিপুরার কৃষি খাতকে আরও শক্তিশালী ও টেকসই করে তোলা সম্ভব।

তেমনি যদি আমরা রাজ্যের কৃষি জমির তথ্য তুলে ধরি তাহলে বলা যায়, ত্রিপুরার মোট ভৌগোলিক এলাকা ১০.৪৯ লক্ষ হেক্টর, যার মধ্যে মাত্র ২.৭২ লক্ষ হেক্টর (প্রায় ২৬%) চাষযোগ্য জমি এবং রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ৭০% এরও বেশি মানুষ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। যার মধ্যে, ৪৩% নারী শ্রমশক্তি স্বয়ং সক্রিয়।

উপরিক্ত বিস্তারিত আলোচনায় আমরা জানতে পারি, রাজ্যের কৃষি খাতে উন্নয়নের জন্য কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। তা হল সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, কৃষকদের প্রশিক্ষণ, বাজার ব্যবস্থার উন্নয়ন, ঋণ প্রাপ্তির সহজীকরণ ইত্যাদি আরও।

অবশেষে বলা যায়, ত্রিপুরার কৃষিকে ঘিরে যেসব সম্ভাবনা রয়েছে, সেগুলোর যথাযথ ব্যবহার না হলে রাজ্যের আর্থ-সামাজিক কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়বে। তাই সরকারের পাশাপাশি সামাজিক সংগঠন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সচেতন নাগরিকদেরও এগিয়ে আসতে হবে, যাতে ত্রিপুরার কৃষি একটি শক্তিশালী, টেকসই এবং সম্মানজনক ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।

আরও পড়ুন...


Post Your Comments Below

নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।

বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।

Free Download Avro Keyboard

Fields with * are mandatory





Posted comments

Till now no approved comments is available.