।। ওয়াশিং মেশিন ।।
অরিন্দম নাথ
চার পাঁচ বছর আগের কথা। আমি তখনও পুলিশের চাকুরিতে। দিনের কাজের শেষে একদিন পুলিশ সদর থেকে ফিরছি। রাত্রি তখন আনুমানিক আটটা। তখন কিছু একটা নির্বাচন ছিল। কর্ণেল চৌমুহনী অতিক্রম করার সময় নজরে পড়ল একটি রাজনৈতিক দলের পথসভা চলছে। মাইক্রোফোনে কেউ একজন ভাষণ দিচ্ছেন। আমার এক দেহেরক্ষী ছিল । নাম অভিজিৎ । সে বলল, "স্যার, আমাদের সত্যজিৎবাবু ভাষণ দিচ্ছেন।"
এবার গলার স্বরে আমিও তাঁকে শনাক্ত করতে পারলাম। সত্যজিৎবাবুই বটে। তিনি ছিলেন পুলিশের ডিএসপি। চাকুরি থেকে অবসরের পর একটি রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়েছেন। এই খবর কানাঘুষো শুনেছিলাম। এবার কিছুটা চাক্ষুষ করলাম। সত্যজিৎবাবু অভিজিতের বিশেষ পরিচিত। তারা দুজনে একই ছাদের নিচে দীর্ঘদিন কাজ করেছে। আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় আগরতলাতে চাকুরি করতে এসে। প্রায় তিন দশক আগে। তিনি তখন পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর পদে কর্মরত ছিলেন। স্নাতক না হলেও ইংরেজিতে ভালো লিখতে পারতেন। খুবই পরিণত হাতের লেখা। হাতের লেখা দিয়ে একটি লোকের চরিত্র সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা করা যায়। আমি বরাবরই তা করে এসেছি। এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয় না। তিনি ধৈর্য্যশীল, পরিশ্রমী ও শান্ত স্বভাবের ছিলেন। লম্বা, ফর্সা, সদালাপী এই লোকটিকে আমার ভালোই লাগত। প্রথম থেকেই পছন্দ করতাম। তার ওপর তিনি কিছুদিন আগে তদন্তের উপর তিন মাসের সিডিটিএস ট্রেনিং করে এসেছিলেন। স্টাডি-ম্যাটেরিয়ালের পাশাপাশি তাঁর থেকে জ্ঞান আহরণ করার চেষ্টা করতাম। থানার পরিবেশে সব সময়ই একটি অসাধুতা বিরাজ করে। 'দুর্বলেরে রক্ষা করো, দুর্জনেরে হানো, নিজেরে দীন নিঃসহায় যেন কভু না জানো', অনেক সময় কষ্ট কল্পনা মনে হত। তখন 'তুমি অধম, তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন', এই মন্ত্র মনে মনে জপ করতাম।
এমনি পরিস্থিতিতে একদিন আমার এক আত্মীয়ের সাথে দেখা হয়। সেদিন সত্যজিৎবাবু আমার সঙ্গে ছিলেন। তিনি চলে গেলে আমার আত্মীয় একটি কাহিনী বলেন। তিনি তখন ব্লকের অধীনে ছোট্ট একটি অফিসের ইনচার্জ। মফস্বলে পোস্টেড । একদিন রাত্রিতে অফিস থেকে কিছু সিলিং ফ্যান চুরি যায়। তখন স্থানীয় থানায় সত্যজিৎবাবু পোষ্টেড ছিলেন। তিনি ঘটনার তদন্ত করতে আসেন। প্রকাশ পায় চুরির রাত্রিতে অফিসের নাইট গার্ড অনুপস্থিত ছিল। তিনি বলেন যে নিশ্চয়ই সঙ্গে নাইটগার্ডের চোরের সঙ্গে সাজিস ছিল । তাই সেদিন সে অনুপস্থিত ছিল। অথচ, বেচারার অনুপস্থিত থাকার জেনুইন কারণ ছিল। তিনি তাকে গ্রেপ্তার করেন। সে বেচারা প্রায় তিন মাস জেলে কাটায়। ইতিমধ্যে প্রকৃত চোর আটক হয়। কিছু চোরাই মাল উদ্ধার হয় উদ্ধার হয়। সেই সিলিং ফ্যানগুলি দপ্তরকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। ধৃত চোরও একদিন জামিনে আসে। নাইটগার্ড আগেই জামিনে এসেছিল। চোর কিন্তু বলে সে সবগুলি সিলিং ফ্যান দারোগাবাবুকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। এর প্রায় দেড় বছর পরের কথা। সত্যজিৎবাবু বদলি হয়েছেন। তিনি ঘরের মালপত্র কোয়ার্টার থেকে একটি ট্রাকে উঠাচ্ছিলেন। স্থানীয় লোকজন হঠাৎ নজর করল মালামালের মধ্যে দুটো চোরাই সিলিং ফ্যান উঁকি দিচ্ছে।
আমি এই গল্প কোনদিন সত্যজিৎবাবুকে বলিনি। কারণ, বললে নিশ্চয়ই তিনি আমার আত্মীয়ের গোষ্ঠী উদ্ধার করতেন। পাশাপাশি দাগি অপরাধী হয়ে যেতেন। অন্ধকার জগতের লোকদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন। জগতে ভালো এবং খারাপ দুই ধরনের লোক থাকে। একজন কলুষিত ব্যক্তি যখন খারাপ সংস্পর্শে আসে সে আরো খারাপ হয়। ভালো লোকের সংস্পর্শে এলে, ওয়াশিং মেশিনে শুদ্ধ হয়। মলিনতা দূর হয়। এক্ষেত্রে তাকে দেখেছি প্রাইভেটে বিএ পাস করতে।
আমি এখন গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি রাজনীতির ওয়াশিং মেশিন তাঁকে কোথায় নিয়ে যায় তা দেখার জন্য।