।। তিন মহাপণ্ডিতের গল্প ।।

অরিন্দম নাথ

প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলায় একটি গল্প পড়েছিলাম । সম্ভবতঃ ক্লাস থ্রিতে । 'বাক্যপুরের বিপদ' । গল্পের কাহিনী এখনো চোখে ভাসে । সংক্ষেপে বলছি । অনেক অনেক দিন আগের কথা । ছোট্ট একটি দেশ ছিল । নাম কর্মপুর । পাশাপাশি আরেকটি দেশ ছিল । ধরা যাক, রত্নপুর । দুটি দেশের মধ্যে মাঝে মাঝে বৈরিতা দেখা দিত । অন্যথায় শান্তি বিরাজ করত । লোকজন খুবই কর্মঠ ছিল । প্রত্যেকে প্রত্যেকের কাজ করতে ভালোবাসত । কুমোর মাটির সামগ্রী গড়ত । কামার লোহার সামগ্রী বানাত । চাষীরা ফসল ফলাত । মাস্টার মশাইরা স্কুলে পড়াতেন । সৈন্যরা দেশ রক্ষা করত । বেশ একটা সুস্থ পরিস্থিতি বিরাজ করত ।

সেই দেশে তিনজন মহাপণ্ডিত ছিলেন । ন্যায়রত্ন, তর্কচঞ্চু আর বাক্যবাগীশ । তাঁরা মহারাজার রাজসভা আলোকিত করে রাখতেন । দুরূহ বিষয় বলে তাঁদের কাছে কিছু ছিল না । ন্যায়পরায়ণতা, তার্কিক জ্ঞান এবং বাক-পটুতার মাধ্যমে মুহূর্তে সমাধান করে ফেলতেন । তাঁদের সহচর্য মহারাজা খুব খুব উপভোগ করতেন । নিজেকে গৌরবান্বিত বোধ করতেন । তাই তাঁদেরকে যথেষ্ট আদর-স্নেহ করতেন । একদিন তিন মহাপণ্ডিত মহারাজাকে বললেন, "ধর্মাবতার, আমাদের দেশের নাম কর্মপুর বেমানন । সমোয়পযোগী নয় । দেশের নাম বাক্যপুর হওয়া উচিত । পর্যাপ্ত বাক্যচর্চা হলে দেশ উন্নতির সোপানে পৌঁছাবে । বাক্য চর্চার উপর জোর দেওয়া উচিত ।"

এই পরামর্শ মহারাজার খুব পছন্দ হল । তিনি বিধান দিলেন দেশের নাম 'কর্মপুর' থেকে পাল্টে 'বাক্যপুর' রাখা হবে । দেশ এখন থেকে বাক্যচর্চায় মত্ত হবে । মহামন্ত্রীকে এই আদেশ জানিয়ে দিলেন । মহামন্ত্রীও সারা দেশে ঢোল পিটিয়ে এই পরিবর্তনের কথা সবার কানে পৌঁছে দিলেন । কর্মপুরের পরিবর্তিত নাম হল বাক্যপুর । সবাই নিজেদের আগের পেশা ভুলে বাক্যচর্চা করতে শুরু করল । অন্যথায় তাদের শাস্তি পেতে হত । গর্দান পর্যন্ত যাওয়ার চান্স ছিল ।

এইভাবে প্রায় বছর পাঁচেক বাক্যচর্চা চলল । ইতিমধ্যে একটি খবর এল । পাশের দেশ রত্নপুর বাক্যপুরকে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেছে । মহামন্ত্রী একটি পর্যালোচনা করলেন । দেখলেন সেই আক্রমণ প্রতিহত করার মত শক্তি তাঁদের সৈন্যদলের নেই । কোন মহড়া নেই । অস্ত্র-শস্ত্রে জং ধরেছে । কারখানায় নতুন অস্ত্রশস্ত্র গড়া হয় না । সবাই অপ্রস্তুত । গুপ্তচর মারফত প্রাপ্ত এই খবর মহামন্ত্রী মহারাজার গোচরে আনলেন । সামগ্রিক পরিস্থিতির কথা বললেন । মহারাজা শুনে আৎকে উঠলেন । মহামন্ত্রীকে বললেন, "এখন উপায় ?"

মন্ত্রীমশাই বললেন, "উপায় একটা আছে হুজুর! আমাদের তিন মহাপণ্ডিত ন্যায়রত্ন, তর্কচঞ্চু ও বাক্যবাগীশ বিপক্ষের সেনাদলের জন্য ভারী হবেন । উনাদের যুদ্ধে পাঠিয়ে দিলে হবে । নিশ্চয়ই যুদ্ধ জয় করে আসবেন ।"

মহারাজা বললেন, "অতি উত্তম প্রস্তাব! তাঁদেরকে ডাকা হোক ।"

প্রথমে এলেন বাক্যবাগীশ ।তিনি খুব হাসি হাসি মুখে রাজসভায় ঢুকলেন । মহারাজের কাছ থেকে পার্শ্ববর্তী রাজ্যের আক্রমণ পরিকল্পনা শুনে তাঁর গলা শুকিয়ে গেল । তিনি এবাউট্ টার্ন করে চো চো দৌড় মারলেন । প্রথমে তাঁর মাথার টিকিটি দেখাযাচ্ছিল । একসময় সেটাও মিলিয়ে গেল । তাঁর পেছন পেছন এলেন তর্কচঞ্চু ও ন্যায়রত্ন । তাঁরাও বাক্যবাগীশের মত 'যপসজী' মন্ত্র অবলম্বন করলেন । য পলায়তি স জীবতি!

তাঁরা চলে গেলে, মহারাজা মন্ত্রীমশাইকে বললেন, "এখন কি উপায় ?"

মহামন্ত্রী বললেন, "আবার আমাদের দেশের নাম বাক্যপুর থেকে কর্মপুরে ফিরিয়ে নেওয়া উচিত । কর্মই আমাদেরকে রক্ষা করতে পারে । আর ইত্যবসরে আমরা রত্নপুরের সঙ্গে একটি মিত্রতা চুক্তি করে ফেলি ।"

মহারাজা বললেন, "তথাস্তু! আমি সম্মতি দিলাম ।"

আবার ঢোল পেটানো হল । বাক্যপুর সেই বিপদ কাটিয়ে উঠল । আবার দেশের নাম হল কর্মপুর । সবকিছু ধীরে ধীরে পুরনো ছন্দে ফিরতে শুরু করল ।

জীবনের সায়াহ্নে এসে এই গল্পটি বারবার মনে আসে । বিশেষকরে সকালে যখন স্থানীয় পত্রিকা পড়ি । গল্পটি এখনো প্রাসঙ্গিক মনে হয় । আমাদের দেশে বিভিন্ন সরকারী দপ্তর রয়েছে । শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্বরাষ্ট্র, বিদ্যুৎ, কারিগরি, সাধারণ প্রশাসন এমনি সব দপ্তর । প্রত্যেকটি দপ্তরেই মহাপণ্ডিতদের আখড়া । ন্যায়রত্ন, তর্কচঞ্চু ও বাক্যবাগীশের ছড়াছড়ি । অনেকে বছরের-পর বছর ধরে আছেন । বিরাট অংকের টাকা গুনছেন । কোন একাউন্টেবিলিটি নেই । তাঁদের পদ অপূর্ণ থাকে না । অথচ, নিম্নমহলে প্রচুর অপূর্ণ পদ । অর্থের অভাবে সেগুলি পূর্ণ হয় না । ওনাদের একজনের বেতনে হয়তো অন্তত বিশজন নিম্ন অধঃস্তন কর্মী কাজ করতে পারেন ।

ন্যায়রত্ন, তর্কচঞ্চু এবং বাক্যবাগীশদের মর্জির উপর দপ্তর চলে । তাঁরা নতুন নতুন তত্ত্ব নিয়ে আসেন । মিটিং করেন । গিনিপিগের মতো সাধারণ মানুষের উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে । অধঃস্তন কর্মীরা প্রয়োগ করতে গিয়ে আর কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মোবাইল, ওয়াটসঅ্যাপে ডাটা ভর্তি করতে করতে হাঁপিয়ে পড়েন । নিজেদের বেসিক কাজ ভুলে যান । অথচ ক্রাইসিসের সময় উনারা পালিয়ে যান ।

ছবিতে প্রায়ই তাঁদের টিকির পেছনটা দেখতে পাই । নির্মল আনন্দ উপভোগ করি ।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.