নতুন ভারতীয় ন্যায় সংহিতার উল্লেখযোগ্য প্রধান বিষয় সমূহ

জয়ন্ত দেবনাথ

ভারতীয় ন্যায় সংহিতা-২০২৩, ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা-২০২৩, ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম-২০২৩ নামে তিনটি নতুন আইন প্রণীত হয়েছে যেগুলি ১ জুলাই, ২০২৪ থেকে সারা দেশে কার্যকরী হয়েছে। ভারতীয় ন্যায়সংহিতা (বিএনএস), ২০২৩ ভারতীয় দন্ডবিধি (আইপিসি), ১৮৬০-কে প্রতিস্থাপন করেছে । ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা (বিএনএসএস), ২০২৩ ফৌজদারি কার্যবিধি (সিআরপিসি), ১৯৭৩-কে প্রতিস্থাপন করেছে । ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম (বিএসএ), ২০২৩ ভারতীয় সাক্ষ্য আইন (ইন্ডিয়ান এভিডেন্স এক্ট), ১৮৭২ কে প্রতিস্থাপন করেছে । নারী, শিশু এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংগঠিত অপরাধ দূরীকরণকে অগ্রাধিকার দিয়ে পুরানো তিনটি ব্রিটিশ আমলের ফৌজদারি আইনকে সংস্কার সাধন করা হয়েছে। নতুন আইনের লক্ষ্য হচ্ছে দেশের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ, বিচার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা।

ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা, যা সিআরপিসি- কে প্রতিস্থাপন করেছে, এতে পূর্বে ৫৩৩টি ধারা ছিল, নয়া আইনে ১৬০টি ধারা পরিবর্তন করা হয়েছে, ৯টি নতুন ধারা যুক্ত করা হয়েছে এবং ৯টি ধারা বাতিল করা হয়েছে। ভারতীয় ন্যায় সংহিতা, যা আইপিসিকে প্রতিস্থাপন করেছে, এতে আগের ৫১১টি ধারার পরিবর্তে এখন ৩৫৬টি ধারা রয়েছে, ১৭৫টি ধারায় পরিবর্তন আনা হয়েছে, ৮টি নতুন ধারা যুক্ত করা হয়েছে এবং ২২টি ধারা বাতিল করা হয়েছে।

ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম, যা এভিডেন্স অ্যাক্টকে প্রতিস্থাপন করেছে, এতে আগের ১৬৭টির পরিবর্তে ১৭০টি ধারা রয়েছে, ২৩টি ধারা পরিবর্তন করা হয়েছে, ১টি নতুন ধারা যুক্ত করা হয়েছে এবং ৫টি ধারা বাতিল করা হয়েছে। এই আইনে ইলেকট্রনিক্স ও ডিজিটাল রেকর্ড, ই-মেইল, সার্ভার লগস, কম্পিউটার, স্মার্ট ফোন, ল্যাপটপ, এসএমএস, হোয়াটসএপ, ওয়েবসাইট, অবস্থানগত প্রমাণ, মেইল, ডিভাইসে প্রাপ্ত বার্তা অন্তর্ভুক্ত করার জন্য নথির সংজ্ঞা সম্প্রসারিত করা হয়েছে। এই আইনে এফআইআর থেকে কেস ডায়েরি, কেস ডায়েরি থেকে চার্জশিট এবং চার্জশিট থেকে রায় প্রদান পর্যন্ত সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটিকে ডিজিটালাইজ করার বিধান রয়েছে। তল্লাশি ও কোন কিছু বাজেয়াপ্ত করার সময় ভিডিওগ্রাফি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যা মামলার অংশ হবে এবং নিরপরাধ নাগরিকদের সমস্যায় ফেলতে পারবে না, এই ধরনের রেকর্ডিং ছাড়া পুলিশের কোনও চার্জশিট বৈধ বলে বিবেচিত হবে না।

নতুন ভারতীয় ন্যায় সংহিতার উল্লেখযোগ্য প্রধান বিষয় সমূহ এক নজরে ১। নতুন আইনের ১৭৩ ধারা মূলে একজন নাগরিক নির্ধারিত থানা এলাকার বাইরেও যে কোন স্থান থেকে FIR দায়ের করতে পারবেন, যা ‘Zero FIR' নামে এই আইনে আখ্যায়িত । ২। নতুন এই আইনে নাগরিকদের e-FIR করার সংস্থান রয়েছে । ৩। ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা-(BNSS) এর ৫৩০ ধারা অনুসারে সমস্ত ট্রায়াল, অনুসন্ধান এবং কার্যধারা ইলেকট্রনিক মোডে করার অনুমোদন রয়েছে। ৪। নতুন আইনে দূরবর্তী সাক্ষ্য প্রমাণের ক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক উপস্থাপনাকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে । ৫। ইলেকট্রনিক রেকর্ড গুলি কাগজের রেকর্ডের মতই একই আইনি প্রভাব থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে । ৬। নতুন আইন পুলিশকে কোন বেআইনী ভাবে অর্জিত সম্পত্তিকে যুক্ত করার ক্ষমতা দিয়েছে । ৭। নতুন আইনে ছোট ছোট অপরাধের ক্ষেত্রে বিশেষ করে যারা শারীরিকভাবে অক্ষম বা প্রবীণ নাগরিকদের ক্ষেত্রে গ্রেপ্তার থেকে রক্ষা পাওয়ার সংস্থান রয়েছে। ৮। মামলা নথিভুক্ত হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে ক্ষতিগ্রস মামলাকারীকে জানাতে হবে । ৯। চার্জশিট দেওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে বিচার প্রক্রিয়া ট্রায়াল শুরু করা নিশ্চিত করার নতুন আইনে বিধান রয়েছে । ১০। বিচারের শুনানী শেষে ৪৫ দিনের মধ্যে রায় ঘোষণা করতে হবে । ১১। রায়ের অনুলিপি সাত দিনের মধ্যে অনলাইনে আপলোড করতে হবে। ১২। বিএনএস-এর ৬৫(২) ধারা মূলে ১২ বছরের কম বয়সী মেয়েদের ধর্ষণ অপরাধের দোষীদের মৃত্যুদন্ডের বিধান চালু করা হয়েছে। ১৩। নতুন আইনে যেসব অপরাধের কারণে তিন বছরের কম জেল হয়, সেইসব অপরাধের দোষীদের গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট অফ পুলিশ পদমর্যাদা সম্পন্ন অফিসারের অনুমতি প্রয়োজন। ১৪। নতুন ফৌজদারি আইনে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সাক্ষী সুরক্ষার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয়েছে এবং নির্দিষ্ট বিধান রাখা হয়েছে। ১৫। বৈদ্যুতিন পদ্ধতি সমস্ত বিচার প্রক্রিয়া তদন্তে প্রযোজ্য হবে (বি. এন. এস. এস.-এর ১৭৩ ও ৫৩০ নং ধারা)।

১৬। নতুন আইন অনুসারে বৈদ্যুতিন পদ্ধতিতে মৌখিক সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে। লিখিত সরাসরি সাক্ষ্য দেওয়ার মত এই বৈদ্যুতিন সাক্ষ্যেরও সমগুরুত্ব থাকবে । এতে দূর থেকেও সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে পারবেন । ১৭। ছোট খাটো অপরাধের জন্য বিশেষ করে বিকলাঙ্গ বা শারীরিকভাবে অক্ষম ও সিনিয়র সিটিজেনদের গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড়ের সুযোগ রয়েছে। ১৮। কোনও অপরাধমূলক ঘটনার শিকার ব্যক্তিকে মামলা নথিভুক্ত করার ৯০ দিনের মধ্যে তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানাতে হবে। ১৯। চার্জশিট ফাইল হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। ২০। বিচার প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার ৪৫ দিনের মধ্যে বিচারের রায় জানাতে হবে (বি.এন.এস.এস. -এর ৩৯২ নং ধারা)। ২১। সাতদিনের মধ্যে বিচারের রায়-এর কপি আপলোড করতে হবে। ২২। ধর্ষণ/গণ-ধর্ষণ-এর ক্ষেত্রে পুনরাবৃত্তির জন্য মৃত্যুদন্ডের প্রবিধান রয়েছে (বিএন.এস. - এর ৭১ নং ধারা)। ২৩। যে সমস্ত অপরাধের জন্য ০৩ বছরের কম কারাদন্ড হয় সেক্ষেত্রে কমপক্ষে ডি.এস.পি. পদের আধিকারিকের অনুমোদন থাকলেই গ্রেপ্তার করা যাবে। ২৪। ভারতীয় ন্যায় সংহিতা -২০২৩-এর ১০৬(১)-এ বলা হয়েছে একজন নথিভুক্ত চিকিৎসকদের চিকিৎসায় গাফিলতির জন্য ০২ বছর পর্যন্ত কারাবাস এবং জরিমানা হতে পারে। ২৫। ভারতীয় ন্যায় সংহিতা -২০২৩-এর ৫১(৩) নং ধারায় বলা হয়েছে চিকিৎসককে অভিযুক্তের পরীক্ষার রিপোর্ট অনতিবিলম্বে আর ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির মেডিক্যাল রিপোর্ট সাত দিনের মধ্যে তদন্তকারী আধিকারিকের হাতে তুলে দিতে হবে। কোনও মেডিক্যাল রিপোর্টের মৌলিকতা বজায় রাখতে এবং সংগৃহীত নমুনার বৈধতা অক্ষুন্ন রাখতে ভারতীয় সংহিতা-এর ৫২ নংধারায় ‘অনতিবিলম্বে' কথাটির উপর জোর দেওয়া হয়েছে। ২৬। ভারতীয় ন্যায় সংহিতা- ২০২৩ -এ সংগঠিত অপরাধের মধ্যে মানব পাচার, যৌন ব্যবসা বা মুক্তিপণের জন্য মানব পাচার ইত্যাদি রাখা হয়েছে এবং এক্ষেত্রে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থাও রয়েছে। ২৭। কোনও শিশুকে যৌন ব্যবসার কাজে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ক্রয় করলে কম পক্ষে ০৭ বছরের শাস্তির মেয়াদ ১৪ বছর পর্যন্ত বাড়ানো যাবে। ২৮। বিদেশ থেকে পাচার হওয়া মানুষের ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য রাখা হয়নি। ছেলেদের ক্ষেত্রে ১৮ বছর বয়সের কম এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে ২১ বছরের কম হলে বাধ্যতা মূলক বা প্রলোভন দেখিয়ে যৌন কাজে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে আমদানি করলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে। মানবপাচারের ক্ষেত্রে “ভিক্ষা শব্দটিকে ‘শোষণ’-এর সাথে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। ২৯। কর্ম ক্ষেত্রে মহিলাদের যৌন হেনস্থার হাত থেকে সুরক্ষা নিশ্চিত করতে যৌন হেনস্থাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং তার জন্য আন্তর্জাতিক মানদন্ড মেনে চলা : লিঙ্গ বৈষম্য ও অন্যান্য বৈষম্য মূলক আচরণ দূর করার অঙ্গীকার করে যৌন হেনস্থা বলতে বোঝানো হয়েছে শারীরিক স্পর্শ, যৌন সংক্রান্ত আবেদন রাখা, কোনও মহিলাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে অশ্লীল ছবি, সাহিত্য, ভিডিও ইত্যাদি দেখানো এবং যৌন লালসা যুক্ত মন্তব্য করা ইত্যাদি। ৩০। কর্মক্ষেত্রে কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের যৌন হেনস্থার হাত থেকে বাঁচাতে কিংবা এ ধরনের ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথা যৌন হেনস্থার শিকার হলে মহিলারা আইনি পন্থা বেছে নিতে পারেন। ৩১। কোনও অপরাধমূলক ঘটনার শিকার ব্যক্তিকে মামলা নথিভুক্ত করার ৯০ দিনের মধ্যে তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানাতে হবে। ৩২। চার্জশিট ফাইল হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে আদালতকে। এবং বিচার প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার ৩০ থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে বিচারের রায় জানাতে হবে ( বি.এন.এস.এস. - ৩৯২ ।

তিনটি নতুন আইন কার্যকর করার জন্য ১ লা জুলাই ২০২৪ পর্যন্ত ত্রিপুরা সরকারের বিভিন্ন দপ্তর যেমন পুলিশ, স্বরাস্ট্র (কারা), আইন,স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ, প্রসিকিউশন দপ্তর, স্টেট ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটোরিসহ মোট ৩০১০ জনকে অনলাইন ও অফলাইনে দক্ষতা বৃদ্ধি ও প্রযুক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে । নতুন সংশোধিত CCTNS (Crime and Criminal Tracking Network & Systems) (সিসিটিএনএস) অ্যাপ্লিকেশন পরিচালনার জন্য ২৮২ জন পুলিশ কর্মীকেও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে । পরিকাঠামোগত উন্নয়ন, প্রযুক্তগত উন্নয়ন, নতুন নিয়োগ, Rules/SOP (Standard Operating Procedure) প্রনয়ণ/সংশোধন ইত্যাদি সরকারের বিদ্যমান নিদের্শিকা সমূহ প্রয়োজন অনুসারে রাজ্যে পর্যায়ক্রমে কার্যকর করা হবে । রাজ্যের নাগরিকদের মধ্যে নতুন আইন সম্পর্কে অবগত করার জন্য সমস্ত জেলা পুলিশ সুপারগণকে ব্যাপক সচেতনতামূলক প্রচার অব্যাহত রাখতে বলা হয়েছে রাজ্য সরকারের তরফে । উপরিল্লিখিত তিনটি নতুন ফৌজদারী আইন সম্পর্কিত অধিক তথ্যের জন্য Google Playstore থেকে “সংকলন মোবাইল অ্যাপ” ডাউনলোড করা যেতে পারে ।(লেখক একজন সাংবাদিক ও ত্রিপুয়াইনফো-র সম্পাদক)


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.