পূর্বোত্তরে নানা ভাষায় রবীন্দ্রনাথ

পান্নালাল রায়

উত্তর পূর্বাঞ্চলে বিভিন্ন ভাষায় দীর্ঘদিন আগে থেকে রবীন্দ্র সাহিত্য অনূদিত হয়ে আসছে।যখন এই অঞ্চলের খাসি বা ককবরক ভাষায় রবীন্দ্র সংগীতের চর্চা হয়,কিংবা মণিপুরী ভাষায় অভিনীত হয় 'বিসর্জন- তখন যেন ভাষার গণ্ডী ছাড়িয়ে পূর্বোত্তরে রবীন্দ্রনাথ পৌঁছে যান সকল ভাষার অন্তরে!

প্রায় পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে মণিপুরী ভাষায় রবীন্দ্র সাহিত্য অনুবাদের কাজ চলছে।রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস, নাটক,প্রবন্ধ, কবিতা,সঙ্গীত মণিপুরী ভাষায় বহুল পরিমাণে অনূদিত হয়েছে।মণিপুরী ভাষায় রবীন্দ্র সঙ্গীত ও নাটক সকলের সপ্রশংস নজর কেড়েছে।কবির জন্মশতবার্ষিকী,১২৫ তম জন্ম বার্ষিকী এবং কবির জন্ম সার্ধশতবার্ষিকী উদযাপন করেছেন মণিপুরী ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ।'রবীন্দ্র নাচোম' নামে রবীন্দ্রনাথের নির্বাচিত গল্প, কবিতা,উপন্যাস,নাটক,প্রবন্ধ ও গানের মণিপুরী অনুবাদ দুই খন্ডে প্রকাশ করেছে সাহিত্য একাডেমী।'রবীন্দ্র নাচোম' প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৯৭১ সালে।এতে স্হান পেয়েছে পদ্য অংশ।১৯৭৮ সালে প্রকাশিত 'রবীন্দ্র নাচোম'-এর দ্বিতীয় খণ্ডে স্হান পেয়েছে নির্বাচিত গদ্য।এতে রয়েছে গল্প, উপন্যাস,প্রবন্ধ। পরবর্তী কালে 'গোরা' প্রকাশিত হয় মণিপুরী ভাষায়।'রবীন্দ্র নাচোমে' সংকলিত রবীন্দ্র সংগীত ছাড়াও আরও বেশ কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীত মণিপুরী ভাষায় অনূদিত ও তার চর্চা হয়েছে।উল্লেখ করা যায় যে 'রূপরাগ' সংস্হার শিল্পীরা মণিপুরে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে জনপ্রিয় করেছেন।তিনজন বিশিষ্ট মণিপুরী কবি পৃথক পৃথক ভাবে 'গীতাঞ্জলি' অনুবাদ করেছেন।নাটক অনুবাদের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি গল্প এবং কবিতারও নাট্যরূপ দেয়া হয়েছে মণিপুরীতে।চিত্রাঙ্গদা,বিসর্জন, রক্তকরবী,চণ্ডালিকা,মুক্তধারা,ক্ষুধিত পাষাণ প্রভৃতি নাট্যামোদীদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে মণিপুরে 'দ্য টেগোর সেন্টিনারী সেলিব্রেশন কমিটি' গঠন করে বর্ষ ব্যাপী কর্মসূচি নেয়া হয়েছিল। এই উপলক্ষ্যে রাজধানী ইম্ফল সহ রাজ্যের নানা অঞ্চলে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়।কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপনে মণিপুরে সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।শুধু মণিপুর নয়,ত্রিপুরায় বসবাসকারী মণিপুরী ভাষাভাষিরাও রবীন্দ্রসঙ্গীত, নৃত্যনাট্য মণিপুরীতে অনুবাদ করে পরিবেশন করেছেন।কবির জন্ম সার্ধশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষ্যে আগরতলায় আন্তর্জাতিক মণিপুরী সাংস্কৃতিক উৎসবও অনুষ্ঠিত হয়েছে।

মেঘালয়ে খাসি ভাষায় রবীন্দ্রনাথের 'গীতাঞ্জলি' তিনবার অনূদিত হয়েছে।যতদূর জানা যায়,১৯৮৪ সালে ই ওয়েস্টেন ডিখার প্রাচীন খাসি ভাষায় 'গীতাঞ্জলি' অনুবাদ করেন।১৯৮৮ সালে পাসকাল মালগ্নিয়াং 'গীতাঞ্জলি'র অনুবাদ করে নাম দেন 'কা গীতাঞ্জলি'।১৯৯২ সালে 'গীতাঞ্জলি'র অনুবাদ করেন এস.নোরিনডেল রয়।এই তিনজন অনুবাদকই মেঘালয়ের বিশিষ্ট সাহিত্যিক। শুধু 'গীতাঞ্জলি' নয়,কবির আরও কিছু সৃষ্টি খাসি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।এসব থেকে ধারণা করা যায় যে,খাসি ভাষায় রবীন্দ্র সাহিত্য অনুবাদের উদ্যোগ খাসি জনগোষ্ঠীর মধ্যে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।কয়েক দশক আগেই রবীন্দ্রনাথের 'পোষ্টমাস্টার'-এর মতো গল্প খাসি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল। রবীন্দ্রসঙ্গীতের খাসি অনুবাদ হয়েছে।মেঘালয়ের ক'জন বিশিষ্ট শিল্পী যেমন বাংলাতে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছেন,তেমনই খাসি ভাষায় অনূদিত রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েও তারা শ্রোতাদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

ত্রিপুরার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনজাতি গোষ্ঠীর ভাষা ককবরকে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস, নাটক,ছোটগল্প, কবিতা,গান অনূদিত হয়ে আসছে।জনজাতি অধ্যুষিত এলাকায় ককবরক ভাষায় রবীন্দ্র নাটক বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।উল্লেখ করা যায় যে,ত্রিপুরার রাজপরিবারের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নিবিড় সম্পর্ক ছিল।কবি বারবার ত্রিপুরায় ছুটে এসেছেন। এখানের ইতিহাস, সম্পদ- সম্ভাবনা কবিকে নাড়া দিয়েছে।এমন কি ত্রিপুরা সফরে আসার আগেই রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যে স্হান পেয়ে গেছে ত্রিপুরা।সৃষ্টি হয়েছে মুকুট,রাজর্ষি ও বিসর্জন। এই পরিপ্রেক্ষিতে ত্রিপুরার জনজাতি ভাষায় যে রবীন্দ্র সাহিত্য অনূদিত হবে তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু কাজটি দীর্ঘদিন তেমন গতি পায়নি।কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষ্যে পরিকল্পিত ভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীত, কবিতা ইত্যাদি অনুবাদের কাজ শুরু হয়েছিল। কবির জন্ম সার্ধশতবার্ষিকীতে এই কাজ আরও গতি পায়।রাজ্য সরকারের তথ্য,সংস্কৃতি দপ্তরের পৃষ্ঠপোষকতায় শুরু হয়েছিল এই কাজ। শুধু ককবরক নয়,ত্রিপুরার অন্যান্য জনজাতি ভাষাতেও রবীন্দ্রনাথের গল্প-কবিতা ইত্যাদি অনুবাদের কাজ চলছে।ককবরকে রবীন্দ্রসঙ্গীত ইতিমধ্যে রাজ্যে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।বিভিন্ন সরকারি বা বেসরকারি অনুষ্ঠানে বাংলার পাশাপাশি ককবরকেও রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশিত হয়ে থাকে।বাংলা এবং ককবরক উভয় ভাষাগোষ্ঠীর শিল্পীরা সাবলীল ভাবেই উভয় ভাষাতেই রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করে থাকেন।বাংলাতে যেমন গাওয়া হয় -

"রূপসাগরে ডুব দিয়েছি অরূপরতন আশা করি,

ঘাটে ঘাটে ঘুরব না আর ভাসিয়ে আমার জীর্ণ তরী..."

তেমনই ককবরকে পরিবেশিত হয়-

"রুপ-তৌয়াংগ দুব রৌজাখা অরুপ-রতন খাঅ চুউই;

গতিরগ' গুরিলিয়া কৌবাই আনি রৌঙ কচগরৌই..."

কবিতা ও গানের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু ছোটগল্প,উপন্যাস, নাটক ককবরকে অনূদিত হয়েছে।নাটক ও নৃত্যনাট্য প্রসঙ্গে প্রথমেই আসে 'বিসর্জন'-এর কথা।ত্রিপুরার পটভূমিকায় লেখা 'বিসর্জন' স্বাভাবিক ভাবেই এই অঞ্চলের নাট্যামোদী মানুষের বিশেষ আকর্ষণ। অনেক আগেই 'বিসর্জন' ককবরকে অনূদিত হয়েছে এবং তার সফল মঞ্চায়ন ককবরক ভাষাভাষিদের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।'চিত্রাঙ্গদা' নৃত্যনাট্যও ককবরকে অনূদিত হয়েছে।রবীন্দ্র সাহিত্যের ককবরক অনুবাদ নিয়ে সংকলন গ্রন্হ প্রকাশিত হয়েছে।ত্রিপুরার জনজাতিদের বিরাট অংশের ভাষা ককবরক হলেও তা রাজ্যভাষার মর্যাদা পায় মাত্র ১৯৭৯ সালে।এই ভাষায় রবীন্দ্র সাহিত্য অনুবাদের কাজ অবশ্য সাফল্যজনক ভাবে এগিয়ে চলেছে।সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগেও এই অনুবাদের কাজ চলছে।রবীন্দ্রনাথের কবিতা,সঙ্গীত ককবরকে অনুবাদের ক্ষেত্রে শ্যামলাল দেববর্মা,নিতাই আচার্য,চন্দ্রকান্ত মুড়াসিং-এর নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। ককবরক ভাষায় রবীন্দ্রচর্চা আজ ত্রিপুরার প্রত্যন্ত অংশেও পরিলক্ষিত হচ্ছে।

উত্তর পূর্বাঞ্চলের সর্বাধিক জনগোষ্ঠীর ভাষা অসমীয়াতেও অনেক আগে থেকেই রবীন্দ্র সাহিত্য অনুবাদের কাজ হয়েছে।এটা রবীন্দ্রানুরাগীদের প্রায় সকলেই জানেন যে,অসমে যেমন রবীন্দ্র সাহিত্য অনুবাদের কাজ চলে আসছে,তেমনই রাজ্যে রবীন্দ্রচর্চাও চলছে।রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস, নাটক,গল্প,কবিতা বহুল পরিমাণে অনূদিত হয়েছে অসমীয়া ভাষায়।অসমীয়া ভাষাভাষি রবীন্দ্রানুরাগীদের অনেকে,যারা বাংলা জানেন,বাংলাতে যেমন তারা রবীন্দ্রনাথ পড়ে থাকেন,তেমনই রবীন্দ্র সাহিত্যের অসমীয়া সংস্করণও তাদের কাছে সমান প্রিয়।অসমে দুই ভাষাতেই রবীন্দ্রচর্চা হয়েছে।এখানে উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে,অসমের বাংলা ভাষাভাষি বরাক উপত্যকায় অবশ্য স্বাভাবিক ভাবে বাংলাতেই রবীন্দ্রচর্চা হয়ে থাকে।

উত্তর পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য ভাষাগোষ্ঠীর সাহিত্যানুরাগী মানুষও পিছিয়ে নেই রবীন্দ্রচর্চায়।চাকমা,মগ,বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সম্প্রদায়ের উৎসাহী রবীন্দ্রানুরাগীরা কিছু কিছু রবীন্দ্রসাহিত্য নিজ নিজ ভাষায় অনুবাদ করেছেন।এইসব ভাষায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা ছোটগল্প ইত্যাদি অনূদিত হয়েছে।চাকমা ভাষায় অনূদিত হয়েছে কবির 'গীতাঞ্জলি'।ডিমাসা ভাষাতেও অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রসঙ্গীত। এটা বলে নেয়া ভাল যে,এখানে যা উল্লেখ করা হল তা জলে ভাসমান শিলাখণ্ডের দৃশ্যমান অংশ মাত্র। পূর্বোত্তরে নানা ভাষায় রবীন্দ্রচর্চা হয়েছে।বহু ভাষাভাষি এই অঞ্চলে নানা ভাষায় রবীন্দ্রনাথ কি ভাবে বিরাজমান তার একটা খণ্ডচিত্র মাত্র এখানে তুলে ধরা হল।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.