।। কুড়িয়ে পাওয়া ধন ।।

অরিন্দম নাথ

অনেকদিন আগে পড়া একটি গল্প আজ মেঘনাদবাবুর মনে এল । গল্পটি আমেরিকান সাহিত্যিক মার্ক টোয়েনের লেখা । নিতান্তই চুটকি গল্প। মার্ক টোয়েন ও তাঁর বন্ধু খুব ঘুরতে ভালবাসতেন । তখন তাঁরা কিছুটা বাউন্ডুলে প্রকৃতির ছিলেন । কিন্তু তাঁদের একটি লক্ষ্মীযোগ ছিল। রাস্তায় টাকা কুড়িয়ে পেতেন । আর সেই টাকায় বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন । নতুন দেশ দেখতে যেতেন । একবার এমনি কুড়িয়ে পাওয়া ধনের উপর ভরসা করে গিয়েছেন নিউইয়র্কে । তখন শীতকাল । বড়দিনের প্রাক্কাল । হোটেল লজ সব ভর্তি । কোথাও জায়গা নেই মাথা গোঁজার । অনেক কষ্টে তাঁরা একটি হোটেল খুঁজে পেলেন । পঞ্চাশতলার উপর একটি রুম খালি আছে । কিন্তু হোটেলের লিফ্ট অচল । দুই বন্ধু তাই সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠা শুরু করলেন । একটি একটি করে তলা ওঠেন, আর এক বন্ধু একটি গল্প বলেন । অল্টারনেটিভলি । এতে তাঁদের কষ্ট কিছুটা লাঘব হয় । এমনি করে তাঁরা উনপঞ্চাশতলা অবধি পৌঁছালেন । তখন তাঁর বন্ধু বললেন যে গল্পের স্টক শেষ । মার্ক টোয়েন বললেন, "আমার কাছে একটি অবশিষ্ট আছে !"

- বলে ফেল ।

- রিসেপশন থেকে হোটেল রুমের চাবি আনতে ভুলে গেছি ।

অগত্যা দুই বন্ধু হোটেলের রুমের সামনে রাত কাটালেন । তাঁদের শরীরে এনার্জি ছিল না নীচে নেমে আবার চাবি নিয়ে আসা । মেঘনাদবাবুর বন্ধু রোহনবাবু প্রায়ই টাকা কুড়িয়ে পান । প্রতিদিন তাঁরা দুজন প্রাতর্ভ্রমণ করেন । সঙ্গে মেঘনাদবাবুর পোষা কুকুর থাকে । মাঝে মাঝে তাঁদের দুইজন প্রতিবেশী যোগ দেন । সৃজনবাবু আর সদাশিববাবু । দুজনেই অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক । সৃজনবাবু মেঘনাদবাবুর কলেজ সহপাঠী । রোহানবাবু একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করেন । মাঝারি পর্যায়ের কর্মচারী । গড়ে মাসে চার পাঁচবার রোহনবাবু টাকা পান । এক দুই টাকার কয়েন থেকে শুরু করে পাঁচ, দশ, কুড়ি, পঞ্চাশ, একশ টাকার নোট। মেঘনাদবাবু ও তাঁর সারমেয় এমনি প্রায় শতবার টাকা প্রাপ্তির সাক্ষী। প্রতিবারই উদ্ধারের পর সেই টাকা নিকটবর্তী হনুমান মন্দির কিংবা কালী মন্দিরের প্রণামী বাক্সে জমা হয় । শুধু একবার মসজিদে জমা হয়েছিল।

এর বাইরেও রোহনবাবু টাকা কুড়িয়ে পান । যখন মেঘনাদবাবু তাঁর সঙ্গে থাকেন না । মেঘনাথবাবুকে সেই গল্প বলেন । অনেকক্ষেত্রে টাকার অংক বেশি থাকে । তবে প্রতিবারই মালিক সনাক্ত করা গিয়েছিল । বলাবাহুল্য টাকা ফেরত পেয়ে টাকার মালিকরা রোহানবাবুর প্রতি কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করতে ভুলেন না । অনেকে তাঁকে পুরস্কার দিতে চান । তিনি নিতে অপারগ হন । শুধু একবার একজন ভদ্রলোক বিচিত্র আচরণ করেছিলেন। প্রতিদানে কোন সৌজন্য বিনিময় করেননি । এমনকি হাসিও দেননি । যেন রোহনবাবুর দায়িত্বই ছিল তাঁর টাকা পড়ে গেছে, বলে দেওয়া । অথচ টাকার অংক কম ছিল না । প্রায় সাড়ে সাত হাজার টাকা । প্রকাশ্য দিনের বেলায় রোহনবাবুর চোখের সামনে তাঁর পার্স পড়ে গিয়েছিল । ভদ্রলোকের খেয়ালও ছিল না । তিনি খুব আন-মাইন্ডফুল ছিলেন ।

বাস্তুশাস্ত্র বলে এমনি টাকা কুড়িয়ে পাওয়া ভালো । লক্ষ্মীপ্রাপ্তির সংকেত । রোহনবাবু বড়লোক হননি । স্ত্রী এবং স্কুলপড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে ছিমছাম সংসার । তাঁর রোজগারেই সংসার চলে । বাস্তুশাস্ত্রে এই টাকা দিয়ে কি করা উচিত সুনির্দিষ্ট কোন গাইডলাইন তিনি পাননি । মন্দিরের প্রণামী বাক্সে জমা দেওয়া প্রচলিত রীতি। দশের মঙ্গলের কাজে খরচ হওয়াই শ্রেয় । রোহনবাবুর পিতা এখন প্রয়াত । তিনি ছিলেন নামকরা জ্যোতিষী। মৃত্যুর আগে ছেলের এই বিচিত্র ক্ষমতা সম্পর্কে কোন আগাম আভাস দেননি । তবে তিনি এক বিচিত্র ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন । দুর্ঘটনায় রোহনবাবুর মৃত্যুযোগ নেই। অর্ধ শতাব্দীর কাছাকাছি জীবনে তিনি বারকয়েক বড় দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন । প্রতিবারই বেঁচে গেছেন । একবার কারেন্টের শক লেগে অচেতন হয়ে পড়েছিলেন । পাশের বাড়ির এক বৌদি দেখে ফেলায় প্রাণে রক্ষা পান । একদিন হাসপাতালে কাটাতে হয় । খুব সম্প্রতি তিনি এক পথ দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিলেন। আগরতলার মিলনচক্র এলাকায়। সেদিন দুপুরে তিনি হাঁপানিয়া টিএমসি হসপিটালে যাচ্ছিলেন । নিজের বাইকে করে । একই দিক থেকে হঠাৎ একটি অটোরিস্কা পেছন থেকে এসে বাইকসহ তাঁকে সজোরে টেনে নিয়ে চলে । বাইকের কোন একটি অংশ অটোর সঙ্গে ফেঁসে গিয়েছিল। সেই অবস্থায় বাইকের উপর তাঁর কোন কন্ট্রোল ছিল না। কাছেই ছিল একটি ইটের স্ট্যাক । তাতে বাইক সজোরে আঘাত করে । তিনি বাইকসহ ছিটকে পড়েন । তাঁর মাথার হেলমেট ভেঙ্গে চৌচির হয়ে যায় । বড়সড় আঘাত ছাড়াই তিনি প্রাণে বেঁচে যান । সপ্তাহখানেক বিছানায় শয্যাশায়ী ছিলেন। বাইকের আঘাতও ছিল মিনিমাম।

সে যাক, আজ সকালের কথায় আসি । মেঘনাদবাবুরা সবমিলিয়ে চারজন । সঙ্গে তাঁর কুকুর। মর্নিং ওয়াকের সময় রোহনবাবু রাস্তায় একটি পঞ্চাশ টাকার নোট কুড়িয়ে পেলেন । সেটা হনুমান মন্দিরের প্রণামী বাক্সে জমা হলো । এবার মেঘনাদবাবু বন্ধুদেরকে তাঁর মনের কথা ব্যক্ত করলেন । রোহনবাবুই কেন বারবার টাকা কুড়িয়ে পান ? এর কারণ কি ? এমন নয় যে অন্যরা রাস্তা দেখে চলেন না ! তবু রোহনবাবুর দৃষ্টিতেই পড়ে থাকা ধন প্রথমে নজরে আসে । অনেক সময় রাস্তার অপর পাশেও তিনি টাকা দেখতে পান । হতে পারে এইভাবে বারবার টাকা কুড়িয়ে পেতে তাঁর ভালো লাগে । এক ধরনের আত্মতৃপ্তি । চলার সময় মন থেকে তিনি সেটা ভুলতে পারেন না । মন সবসময় রাস্তায় টাকা খুঁজে বেড়ায় । চলার সময় তাঁর চোখ সবদিক স্ক্যান করে চলে । তাই পড়ে থাকা টাকা তাঁর নজরে প্রথম আসে । বিষয়টি কাকতালীয় নয় । সৃজনবাবু এবং সদাশিববাবু এর কোন সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারেন না।

তবে সুজনবাবু তাঁর এক টাকা প্রাপ্তির গল্প বলেন । তিনি তখন স্কুলে পড়েন । সময়টা সত্তরের দশকের মাঝামাঝি । তাঁর বাবা ছিলেন একজন উকিলের সহযোগী । খুব বৈষয়িক ছিলেন । জীবনে প্রচুর সংগ্রাম করেছেন । পাশাপাশি প্রচুর সম্পত্তিও অর্জন করেছিলেন । একদিন সৃজন এক টাকার একটি নোট রাস্তায় কুড়িয়ে পেল । পরিত্যক্ত অবস্থায় । তখন এক টাকার অনেক দাম ছিল । বিশেষত একজন স্কুল ছাত্রের কাছে। প্রথমে সে ভাবল টাকাটি মন্দিরের প্রণামী বাক্সে দান করবে । পরক্ষণে সেই পথে গেল না। বাবার বারণ ছিল । এভাবে মুফতে পাওয়া কিছু নিয়ে ঘরে না ঢোকার জন্য। টাকাটি একটি দিয়াশলাই বাক্সের পুরে বাড়ির পাশের জঙ্গলে রেখে দিল । এবার সে তাঁর প্রিয় বন্ধু কাজলকে টাকা প্রাপ্তির খবর বলল । বন্ধু প্রস্তাব দিল যে চড়কের মেলায় সেই টাকা খরচ করা যাবে। চরকের মেলা অনুষ্ঠিত হতে তখনো মাস খানেক দেরি ছিল । সেই পরামর্শ সৃজনের মনঃপুত হল । তারপর কয়েকদিন চললো দুই বন্ধুর বাজেট প্রস্তাবনা । কিভাবে মেলায় এক টাকার বিনিয়োগ হবে । পাশাপাশি টাকাটি সহি-সালামৎ আছে কিনা সেটা দেখাও চললো। সৃজন প্রতিদিন স্নানের আগে একবার করে জঙ্গলে যেত । উঁকি দিয়ে ম্যাচ বাক্সটি দেখত । বিষয়টি তাঁর বাবার নজরে গেল । তিনি একদিন তাকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলেন । সুতরাং সৃজনকে বাবার কাছে বিষয়টি অকপটে খুলে বলতে হল । তিনি তার কাছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবকিছু জানলেন । বাজেট বিবরণীও দেখলেন । এবার তিনি আদেশ দিলেন যে টাকাটি পাশের মন্দিরে রেখে আসতে । সঙ্গে বাড়ি থেকে এক সের গরুর দুধ নিয়ে যাবে । চরকের মেলার বাজেট বরাদ্দের দায়িত্ব তিনি নিলেন । সৃজন সেই টাকা পরদিনই স্থানীয় মন্দিরে দিয়ে আসে। সঙ্গে নিজেদের গরুর দুধ।

সুজনবাবুর গল্পে মেঘনাদবাবুর এক স্মৃতি মনে আসে । তখন তিনি কলেজে পড়েন । আশির দশকের প্রথম দিকের কথা। একদিন তিনি এমনি একটি টাকা কুড়িয়ে পেলেন । তখন ত্রিপুরা রাজ্য লটারির সাপ্তাহিক খেলা খুব পপুলার । টিকিটের দাম এক টাকা । তিনি সেই টাকাটি দিয়ে একটি লটারি টিকিট কিনলেন । সপ্তাহ খানেক তিনি খুব দোলাচলে ভুগলেন । ঠিক করেছেন কি না । সাথে সাথে মনে আশা । নিশ্চয়ই ভালো পুরস্কার পাবেন । হয়তো প্রথম পুরস্কার । লটারির ফল বেরুনোর সময় এলে দেখা গেল, ফল আর প্রকাশ পায় না । তারপর পত্রিকায় জানতে পারলেন একটি ঘোটালা হয়েছে । তদন্ত হচ্ছে । তারপর সেই লটারি বন্ধই হয়ে গেল । তিনি মনে মনে ভাবলেন, "যা বাব্বা! আমার কুড়িয়ে পাওয়া ধন কি ভিমরুলের চাকে ঘা মেরেছিল !"

তিনি অর্থনীতি বুঝেন না । তথাপি অনেক কিছু ভাবেন। তাঁর ভাবনায় নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দোপাধ্যায়ের একটি উক্তি নাড়া দেয় । করোনার সময় কোথাও পড়েছিলেন। বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথার সারমর্ম ছিল যে দরিদ্র মানুষজনের হাতে অর্থ নেই। সে জন্য তাঁদের ক্রয়ক্ষমতা দুর্বল। সরকারের উচিত সাধারণ মানুষের হাতে অর্থ পৌঁছানো। তারাই অর্থনীতি চালায় । ধনীরা নয় ।

মেঘনাদবাবু একটি পরিস্থিতির কল্পনা করেন । সামনের দোকানের সবজি ওয়ালার কথাই ভাবা যাক । সে ব্যাংক থেকে দশ হাজার টাকার ঋণ নিয়েছে । সেই টাকা নিয়ে সে গোল বাজারে গিয়েছে । কারণ আড়তদারের দোকানে অনেক টাকা বাকি । পাইকারি বিক্রেতা মাল দেয় না । দশ হাজার টাকা পেয়ে সে খুশি হয় । আবার মাল দেওয়া শুরু করল । এদিকে ট্রাকওয়ালা যারা মাল নিয়ে আসে তাদের কাছে আড়তদারের বাকি ছিল । আড়তদার এই টাকায় গাড়ির ভাড়া মেটালো । গাড়ির মালিক এই টাকা দিয়ে ড্রাইভারের বেতন দিল । ট্রাক ড্রাইভার সেই টাকা পাড়ার মুদিখানায় দিল । মুদির দোকানের মালিকের বাচ্চা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে । সেই টাকায় দোকানদার স্কুলের ফিস মেটালো । স্কুল কর্তৃপক্ষ তা দিয়ে তাদের স্কুল বাসের লোনের কিস্তি জমা দিল । ব্যাংকের টাকা ব্যাংকে ফিরে এল । মেঘনাদবাবুর মনে হয়তো পুঁজি তৈরির বাসনা কাজ করেছিল । তাই তিনি সেই কুড়িয়ে পাওয়া ধন লটারিতে লাগিয়েছিলেন ।

টাকা যত হাত বদল হয়, মূল্য তত বাড়ে । তিনি ভাবেন মন্দির - মসজিদ - গির্জায় জমা হওয়া টাকা কি সাধারণ মানুষের কাজে আসতে পারে না । ভারতবর্ষের এইসব প্রতিষ্ঠানে যত ধন জমা আছে তা দেশের একবছরের জিডিপির কাছাকাছি হবে । একটি প্যারালাল অর্থনীতি চলতে পারে । কুড়িয়ে পাওয়া ধন সেখানে জমা করে আমরা হয়তো কোন পূণ্য করছি না। তিনি ত্রিপুরার দশ হাজার তিনশত তেইশজন ছাঁটাই শিক্ষক কর্মচারীর কথা ভাবেন । তাদের পরিবারের কথা । তারা কি দুর্দশায় আছে । এরমধ্যে একশত তিহাত্তর জন মারা গিয়েছে। 'ও অকূলের কূল, ও অগতির গতি, ও অনাথের নাথ, ও পতিতের পতি'। ভগবান-আল্লা-প্রভু আমাদেরতো পথ দেখাতে পারেন ।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.