।। পথে এবার নামো সাথী ।।
অরিন্দম নাথ
এবার আমরা স্মরণ করলাম প্রংকিতবাবুকে । তিনি ছিলেন ব-পার্টির প্রবাদপ্রতিম নেতা । অকৃতদার । দীর্ঘদিন বেঁচে ছিলেন । প্রংকিত কথার অর্থ আকর্ষণীয় । সত্যিকার অর্থেই তিনি ছিলেন এক আকর্ষণীয় চরিত্র । অন্তত এই প্রদেশের রাজনীতির ময়দানে । যৌবনে তিনি অনুশীলন সমিতির আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন । আদর্শ এবং নীতিপরায়ণতা ছিল তাঁর ট্রেডমার্ক । কাকদ্বীপ ষড়যন্ত্র মামলার পর স্বদেশী আন্দোলনকারীদের উপর অত্যাচার নেমে আসে । বঙ্গদেশে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয় । তখন তিনি ছাত্রনেতা । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন । পড়াশোনায় ভীষণ ভাল ছিলেন । তাঁর আর পড়াশোনা হয় না । ব-পার্টির নেতৃত্বের আদেশে এই প্রদেশে আসেন । গোপনে সংগঠন গড়ে তুলেন । স্বাধীন ভারতে তাঁর দল রাজনৈতিক অধিকার পায় । একসময় তিনি ক্ষমতার শিখরে পৌঁছেছিলেন।
তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখেছি । ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত অবস্থায় । আমি এখনও তাঁর সঙ্গে প্রথম সামনা-সামনি কথা বলার মুহূর্ত ভুলতে পারিনি । সেদিন একটি নতুন শব্দ শিখেছিলাম । ট্যাবুলা রাসা । ল্যাটিন শব্দ । আমি তখন উদয়পুরের মহকুমা পুলিশ আধিকারিক । সেপ্টেম্বরের এক সকাল । একজন সম্মানীয় অতিথিকে জেলা সদরের দ্বারপ্রান্ত থেকে অভিবাদন করে নিয়ে আসার দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছিল আমার উপর । যথাসময়ে পৌঁছে গিয়েছিলাম পাঠালিয়াঘাটে । জেলা সদরের দ্বার গোড়ায় । তিনি আসবেন আগরতলা থেকে । পাথালিয়াঘাটের ঐ স্থানে রাস্তায় একটি বাঁক ছিল । ফলে আগরতলার দিক থেকে গাড়ি এলে সহসা দেখা যেত না । তাই আমরা সাধারণত কোন পুলিশ কর্মীকে নিকটবর্তী কোন উঁচু টিলায় বসিয়ে রাখতাম । আগাম খবর দেবার জন্য । সকাল তখন আনুমানিক সাড়ে ন'টা । আমাদের গাইড ইশারা করল এসকর্টসহ একজন ভিআইপি আসছেন । আমি রাস্তার দিকে এগিয়ে গেলাম । আমাকে দেখে ভিআইপি কনভয় দাঁড়িয়ে পড়ল । আমি যার জন্য অপেক্ষা করছিলাম, তিনি সেই ব্যক্তিত্ব নন । তথাপি আমি সম্মান প্রদর্শন করে তাঁর দিকে এগিয়ে গেলাম । কালো ফ্রেমের চশমার কাচের ভেতর দিয়ে তিনি আমার নাম পড়লেন, 'এন. অরিন্দম' ।
তখন আমি শখ করে এ'রকম এক বিচিত্র পরিচয়পত্র ব্যবহার করতাম ।
-কি সৌভাগ্য ! আমাকে এক তরুণ পুলিশ অফিসার সমাদর করছে । আপনি কি কেরালার ?
- না, স্যার আমি বাঙালি ।
- আপনি কি ত্রিপুরার ?
- হ্যাঁ, স্যার । আমার বাসা ধর্মনগরে ।
- আপনি ত্রিপুরার বাঙালি! আপনার ট্যাবুলা রাসা ঠিক আছে তো ?
- মাফ করবেন স্যার, আমি শব্দটির সাথে পরিচিত নই । তিনি তখন গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আমাকে ট্যাবুলা রাসার অর্থ বোঝালেন । প্রাকৃতিক পরিবেশে আমি নতুন জ্ঞান আহরণ করেছিলাম।
জন্মের সময় আমাদের জ্ঞানের পরিধিকে ট্যাবুলা রাসা বলা হয় । যেন এক টুকরো আনকোরা সাদা কাগজ । তাতে কোন লেখা থাকে না । আমাদের জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতার বৃদ্ধি ঘটে । সময় গড়ানোর সাথে সাথে । ট্যাবুলা রাসার উপর আঁক বসতে থাকে । এই তত্ত্বের বিশ্বাসীরা আমাদের ব্যক্তিত্ব, সামাজিকতা, আবেগ এবং বুদ্ধিমত্তার বিকাশে প্রকৃতির দানকে মুখ্য হিসাবে বিবেচনা করেন । লালন-পালনের ভূমিকাকে গৌণ হিসেবে দেখেন । ইংরেজিতে ট্যাবুলা রাসা বোঝাতে খালি স্লেটের উপমা টেনে আনা হয় । আরো সঠিকভাবে বলতে গেলে পুরানো লেখা মুছে ফেলে, চক দিয়ে নতুন লেখাকে বোঝায় । শব্দটির ব্যুৎপত্তি রোমান শব্দ ট্যাবুলা বা মোমের ট্যাবলেট থেকে । রোমান যুগে মোমের ট্যাবলেট গলিয়ে সমতল কোন কিছুর উপর হাল্কা একটি আস্তরণ দেওয়া হত । তারপর তার উপর লেখা হত । শুরুতে আমাদের জীবন আনকোরা সাদা কাগজের মত ।
এবার বর্তমানে আসি । সুনীলদার মুখে প্রংকিতবাবুর গলা শুনে আমি তাঁকে অভিবাদন জানাই । আমাদের প্ল্যানচেটের প্রশ্নোত্তর পর্ব না হয়ে, সাক্ষাৎকারে পরিণত হয়, "আপনি প্ল্যানচেটে আসবেন সেটা আশা করিনি ।"
- সেটা কেন ?
- আপনার ব-দলের নীতিতে প্ল্যানচেট নিশ্চয় কুসংস্কার । সেখানে ভূতের স্থান আছে কি ?
- ডাস ক্যাপিটালে এসব নেই । সেখানে পুঁজি আর পুঁজির চরিত্র বর্ণনা করা হয়েছে । বৈশ্বিক পুঁজিবাদের উত্থান । সামন্ত প্রথার বিলোপ । বিশ্বায়ন । বিশ্ববাজার । সর্বোপরি মানুষের সব কার্যক্রম ও লেনদেনকে মূল্যায়ন করা হয়েছে । পুঁজিবাদ সবই বিক্রয়যোগ্য করে তোলার প্রয়াস নেয় । আর মালিকপক্ষ মুনাফা করে । শ্রমিকেরা শোষিত হয় । বিপ্লব ছাড়া শোষণমুক্তি ঘটে না। সমাজতন্ত্র আসে না । ডাস ক্যাপিটালে শ্রমকেই মূল্য উৎপাদনের একমাত্র উৎস হিসেবে দেখান হয়েছিল । সম্পদের অন্যান্য উৎস, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ইত্যাদি পরে যুক্ত হয়েছে। তুমি ডাস ক্যাপিটাল পড়েছ?
- স্যার, সেটা বলার ধৃষ্টতা আমার হয়নি । যদিও বইটি পৃথিবীর সর্বকালের দশটি বেস্ট সেলার বইয়ের একটি হবে ।
- তুমি অকপটে স্বীকার করে অন্যায় করনি । আমার দলের বর্তমান নেতৃত্বের খুব কমই এই বই পড়ে থাকবে ।
- আমি পুলিশের আমলা ছিলাম । তাই এই বই পড়ার প্রয়োজন মনে করিনি ।
- তোমার কথা বলতে পারব না । তোমাদের আমলারা বড় নরম ধাতুতে গড়া । বিশেষকরে সিভিল সার্ভেন্টরা ।
- সেটা কি রকম?
- খুবই সহজ কথা । তাঁদের মধ্যে শক্ত ধাতুর দৃঢ়তা থাকে না । অল্প উত্তাপেই গলে যায় । তরলের কোন আকার হয় না । যে পাত্রে রাখা যায় তারই আকৃতি নেয় । তখন তাঁরা অমেরুদন্ডী প্রাণী !
- স্যার, আপনার এই উপলব্ধির পেছনে রাজ কী?
- রাজ কিছুই নয় ! প্রথম মন্ত্রী হওয়ার আগে বিরোধী দলনেতা ছিলাম । তখন আমলারা এক রকম আচরণ করত । বলতে পার, পাত্তা দিত না । যখন নিজে মন্ত্রী হলাম তখন তাঁদের ভক্তি দেখে আমি অবাক ! আমাকে ডাস ক্যাপিটাল বুঝাচ্ছে । ভেবেছে আনপড়, বনে জঙ্গলে কাটিয়ে এসেছে ! প্রথম দিনেই বিড়াল মারলাম । তবে তখনকার আমলাতন্ত্রের কোয়ালিটি ছিল । আমার সিএস যত গ্রাম প্রদেশ ঘুরেছেন, আমাদের অনেক মন্ত্রী-এমএলএ সেই কষ্ট করে উঠতে পারেননি । আর সবচাইতে বড় কথা তিনি ছিলেন ডাউন-টু-আর্থ ।
- ঠিক বলেছেন স্যার ।
- আর এখনকার অধিকাংশ আমলা সবসময় নিজেদের বৈষয়িক উন্নতির কথা ভাবে । শেয়ারে টাকা খাটাবে । কর্পোরেটের গোলামি করবে । অবসরের পর কর্পোরেটে চাকুরী নেবে । বাচ্চাদের পড়াশোনা । আইএস আইপিএস বানাতে হবে । অবসরের পর পুনর্বাসন । কমিশন । এখানকার বন ধ্বংস করে দেশের বাড়িতে আসবাব পাঠানো । অফিসে রাজনৈতিক প্রভুদের গোলামি করা । মোসাহেবি করা ।
- স্যার, এই পরিস্থিতির কি পরিবর্তন হবে না ?
- হবে, আবার হবেও না!
- এর অর্থ কি স্যার ?
- রাজনীতি ক্রিকেট বা ফুটবল খেলার মত । কখনো একটি দল একতরফা খেলেই যায় । হঠাৎই একটি বা দুইটি আউট, অথবা গোল, খেলার গতিপ্রকৃতি পাল্টে দেয়। বর্তমানে একতরফা খেলা চলছে । তার উপর....
- তার উপর কি স্যার?
- বর্তমান রাজনৈতিক প্রজন্ম খুবই পরশ্রীকাতর! অন্যের ভালো তাঁরা সহ্য করতে পারে না । আর যেকোনো দলের জন্যই সেটা প্রযোজ্য। রাজনৈতিক শিষ্টাচারের অভাব । একটা উদাহরণ দিচ্ছি । তখন ক-পার্টির শাসন চলছে। আমাদের দল বিরোধী বেঞ্চে । আমি বিরোধী দলনেতা । মুখ্যমন্ত্রী উল্লাসবাবু । আমারই মত অকৃতদার। আমারই বয়সী । আমি তাঁদের বাড়িতে যেতাম । উনার মাকে নিজের মায়ের মত শ্রদ্ধা করতাম । উনি মারা গেলে আমি কেঁদেছিলাম । শ্মশান যাত্রী হয়েছিলাম । আমরা রাজনীতি করেছি । আবার একই সাথে আড্ডাও দিয়েছি।
- স্যার, এমনটা হল কেন ?
- শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি মনে হয় । আগে সাবজেক্টিভ শিক্ষার উপর গুরুত্ব ছিল । এখন সব অবজেক্টিভ । এমসিকিউ । অনেকে পুরো সিলেবাস পড়ে না । কিছু অর্থ বই পড়ে । তাতেই বড় বড় ডিগ্রী আদায় করে নেয়। আমলারা তুলনামূলক পড়াশোনায় ভালো । তাঁরা রাজনীতিবিদদের এই দুর্বলতার সুযোগ নেয় । ইশারায় চলে । নিজেদের আখের গোছায় । কিংবা একসঙ্গে পঙ্কিল আবর্তে আবর্তিত হয় । দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এই বিচ্যুতি শিক্ষা, কারিগরী, স্বাস্থ্য, শিল্প সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে । কর্পোরেটের রমরমা ।
- আপনি এখন বিরোধী নেতৃত্ব থাকলে কি করতেন?
- একটাই গান গাইতাম -
"পথে এবার নামো সাথী পথেই হবে পথ চেনা
জনস্রোতে নানান মতে মনোরথের ঠিকানা,
হবে চেনা, হবে জানা....।।"
আর, রাস্তায় নামতাম । পাঞ্জাবিতে দাগ লাগাতাম । ধূলায় গড়াগড়ি খেতাম । সাদা পাঞ্জাবির রাজনীতিতে আমি বিশ্বাসী নই।