শখের ডাক্তার রবীন্দ্রনাথ

পান্নালাল রায়

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে চর্চার শেষ নেই। শুধুই যে তাঁর বিপুল সৃষ্টিকর্ম নিয়েই চর্চা হচ্ছে তা কিন্তু নয়।চর্চা হচ্ছে মানুষ রবীন্দ্রনাথ নিয়ে,চর্চা হচ্ছে কবির অন্যান্য গুণাবলী নিয়েও! রবীন্দ্রনাথের কৃষি,সমবায়,বনায়ন ইত্যাদি চিন্তা চেতনা আজ আমাদের দিশারী।আমরা জানি জমিদার রবীন্দ্রনাথকেও। ত্রিপুরার রাজপরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্রে আমাদের কাছে উদ্ভাসিত হয়েছেন এক অন্য রবীন্দ্রনাথ।তিনি রাজনীতিক, আবার অর্থনীতিবিদও। দেশীয় রাজ্যের বাজেট কেমন হওয়া প্রয়োজন সে বিষয়ে রাজার কাছে নোট পাঠান কবি।তবে রবীন্দ্রনাথ যে একজন শখের চিকিৎসকও ছিলেন কেউ কেউ জানলেও অনেকের কাছেই হয়তো অজানা তা।প্রথাগত ভাবে ডাক্তারী না পড়েও চিকিৎসা করতেন কবি।হাতযশও ছিল তাঁর। হোমিওপ্যাথি-বায়োকেমিকে প্রবল আস্হা ছিল কবির। বারবার সাফল্য পেয়েছেন তিনি।ঘরে-বাইরে পরিচিত মানুষ ছাড়া কবি নিজের চিকিৎসাও নিজে করেছেন।শাহজাদপুর থেকে একবার স্ত্রীকে লিখছেন কবি-"...আবার ইন্সপেক্টরের গলা ভেঙে গেছে বলে তাকে হোমিওপ্যাথিক ওষুধও দিয়েছি-এতে অনেক ফল হতে পারে..."।কবির ডাক্তারি সম্পর্কে প্রমথনাথ বিশী লিখেছেন-"অন্যত্র রোগী চিকিৎসক খুঁজিয়া বেড়ায়,এখানে চিকিৎসক রোগী খুঁজিয়া বেড়াইতেন।"তিনি আরও জানিয়েছেন, আশ্রমের কেউ অসুস্থ হয়েছে জানতে পারলে রবীন্দ্রনাথ উপযাচক হয়ে ওষুধ পাঠিয়ে দিতেন।এমনকি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নিজেই নিজের সম্পর্কে বলতেন, "আমি শুধু কবি নই,কবিরাজও।"রবীন্দ্রনাথের আপ্ত সহায়ক নন্দগোপাল সেনগুপ্ত জানিয়েছেন কবি সর্বদা হোমিওপ্যাথি-বায়োকেমিক ওষুধের বাক্স সঙ্গে রাখতেন। রবীন্দ্রনাথের ডাক্তারি সম্পর্কে এ ধরণের নানা চমকপ্রদ তথ্য রয়েছে পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক গ্রন্হ 'না জানা ঠাকুরবাড়ি'-তে।

জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে কৃতী মানুষের ভিড় ছিল। সবার ওপরে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ঠাকুরবাড়ির কৃতীদের নানা সৃষ্টিকর্ম নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে।আগামী দিনেও নিঃসন্দেহে তা অব্যাহত থাকবে।কিন্তু শুধু সৃষ্টিকর্মই নয়,ঠাকুরবাড়ির সৃষ্টিশীল মানুষদের নিয়েও আমাদের আগ্রহ কম নয়।কেমন ছিল রবীন্দ্রনাথের পারিবারিক জীবন,কবির পোশাকআশাক,কবি কন্যার মৃত্যু,ইংরেজদের চোখে রবীন্দ্রনাথ 'দাগী আসামী',পুরীতে গগনেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে কবি,কবির ভালোবাসার পশুপাখি,রবীন্দ্রনাথের সাঁতার কাটা,নোবেল প্রাপ্তির সম্বর্ধনায় কবির ক্ষোভ ইত্যাদি নানা বিষয় উপস্থাপিত হয়েছে পার্থজিৎবাবুর গ্রন্হটিতে।এ ধরণের চল্লিশটি প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে এতে।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর সন্তানদের পরম মমতায় আগলে রাখতেন। শত ব্যস্ততার মধ্যেও সন্তানদের প্রতি তাঁর স্নেহের ঘাটতি হতো না।মাত্র ৩২ বছর বয়সে কবির প্রথম সন্তান মাধুরীলতার অকাল মৃত্যু ঘটেছিল। জামাতা শরৎকুমারের সঙ্গে কবির সম্পর্ক মোটেই সুখকর ছিল না।অথচ কবি জামাতাকে ব্যারিস্টারী পড়তে বিলেতও পাঠিয়েছিলেন। দেশে ফিরে কলকাতা হাইকোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করেন তিনি।এই জামাতার কাছ থেকে কবি মানসিক আঘাত পেয়েছেন বিস্তর।যক্ষ্মা রোগাক্রান্ত কন্যাকে দেখতে এসেও কবি অপমানিত হয়েছেন।পরে জামাতা শরৎকুমার যখন বাড়ি থাকতেন না তখন কবি কন্যাকে দেখতে যেতেন।একদিন এরকম কন্যাকে দেখতে যাবার পথেই দুঃসংবাদ পেলেন কবি কন্যা মাধুরীলতা আর নেই।

সন্তানদের স্নেহ ডোরে বেঁধে রাখলেও কবি প্রয়োজনে কঠোর হতেও পারতেন। ঠাকুরবাড়ির জমিদারী এলাকায় নিষিদ্ধ ছিল পাখি মারা।কিন্তু রথীন্দ্রনাথ নিজের হাতে গুলতি তৈরি করে একটি শালিক মারার পর কবির ভীষণ বকুনি খেয়েছিলেন।কি ভাবে বাবার কাছে তিরস্কৃত হয়েছিলেন তাও বিশদে জানিয়েছেন রথীন্দ্রনাথ। কবিপুত্র জানিয়েছেন মারধর ছিল কবির স্বভাব বিরুদ্ধ।শৈশব থেকে যুবক বয়স পর্যন্ত মাত্র তিনবার তিনি বাবার কাছে বকাঝকা খেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। রথীন্দ্রনাথ শৈশবে স্নান করতে চাইতেন না।মাকে খুব জ্বালাতন করতেন। কবি সব লক্ষ্য করছিলেন।একদিন পুত্রকে দুহাতে ধরে আলমারির মাথায় তুলে দিলেন কবি।এরপর স্নান করাবার জন্য মাকে আর বেগ পেতে হয় নি বলে জানিয়েছেন রথীন্দ্রনাথ।

পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট শিশু সাহিত্যিক ও গবেষক পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের আলোচ্য গ্রন্হটিতে ঠাকুরবাড়ি নিয়ে এধরণের নানা ঘটনা খুব আকর্ষণীয় ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।একবার অধ্যায় গুলো পড়তে শুরু করলে তা শেষ করতেই হবে।যেমন সুখপাঠ্য, তেমনই তথ্যবহুল। অবশ্য ঠাকুর বাড়ি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের পত্র পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখে চলেছেন।এ পর্যন্ত ঠাকুরবাড়ি নিয়েই তাঁর চোদ্দটি গ্রন্হ প্রকাশিত হয়েছে।আর ঠাকুরবাড়ি বিষয়ক অন্তত কুড়িটি বই তিনি সম্পাদনা করেছেন।আলোচ্য গ্রন্হটির বিষয় বৈচিত্র্যও পাঠকদের শুধু কাছেই টানবে না,ভাবাবেও।কেমন ছিলেন কবি,কেমন ছিল তাঁর ক্ষোভ,দুঃখ বেদনা আর মানুষের প্রতি সহমর্মিতা! শান্তিনিকেতনে নোবেল প্রাপ্তির সম্বর্ধনা সভায় কবি কেন ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন? কবি সেদিন বলেছিলেন," দেশের বহু লোকেরই আমার প্রতি যথার্থ কোনও ভালোবাসা নেই, সেটা আমি জানি।আজ একটা আকস্মিক আনন্দের জোয়ারে অনেকে ভেসে চলেছেন, কিন্তু এ স্রোত চলে গেলেই আবার ধাপে ধাপে পাঁক বেরিয়ে পড়বে।...যাঁরা আজ আমাকে অভিনন্দিত করতে এসেছেন,তাঁদের সম্মানার্থে তাঁদের প্রদত্ত অভিনন্দন আমি গ্রহণ করলুম, কিন্তু অন্তরের সঙ্গে নয়।"

কবির দরজা সর্বক্ষণ সর্ব সাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকত।দেশ বিদেশের নানা বিশিষ্ট মানুষ যেমন প্রায়শ কবির সঙ্গে দেখা করতে আসতেন, তেমনই আসতেন গ্রামের সাধারণ মানুষও।কবির অত্যন্ত স্নেহভাজন রাণী চন্দ লিখেছেন,কবির সঙ্গে দেখা করতে পাগলই আসত কত রকমের। সংসারে যে কত রকমের পাগল আছে গুরুদেবের কাছাকাছি না থাকলে তা ভাবতেই পারতাম না!এক পাগল কবির সঙ্গে দেখা করার ছুতোয় গাঁজা খাওয়ার পয়সা চাইত।কবি সাধারণ মানুষের সঙ্গে গল্প করতেন, তাদের সমস্যার কথা জানতেন। কবি যখন খ্যাতির শীর্ষে তখনও এই ধারা অব্যাহত ছিল। এতে করে লেখার চাপ সামলানো ছিল দুষ্কর। কবিকে না জানিয়েই একদিন তাঁর সচিব নির্দেশ জারি করে দিলেন যে, এখন থেকে আর যখন তখন কবির কাছে যাওয়া যাবে না।কার্যকরও হলো সেই নির্দেশ। দু'দিন পরই কবি বুঝতে পারলেন তাঁর কাছে সাধারণ মানুষের আসা যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে।জানলেন সচিবের নির্দেশের কথাও। কবি খুব রাগান্বিত হলেন।কত দূর থেকে সাধারণ মানুষ আসেন একটু দেখা করতে!তাদের সেপাইশাস্ত্রী পেরিয়ে আসতে হবে নাকি!সচিব বললেন লেখার সময় বিরক্ত করলে কবির অসুবিধা হবে বলে এই ব্যবস্থা।কবি বললেন, লেখার ক্ষতি হলে হোক।তবু সাধারণ মানুষের জন্য দরজা খোলা থাকবে।কবি নির্দেশ দিলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসা সাধারণ মানুষদের আর কখনও যেন বাঁধা দেয়া না হয়।এই হলেন মানুষ রবীন্দ্রনাথ। আলোচ্য গ্রন্হটিতে কবিকে নিয়ে এমন অনেক টুকরো টুকরো ঘটনার উল্লেখ রয়েছে যাতে কিনা চেনা যায় মানুষ রবীন্দ্রনাথকে।



না-জানা ঠাকুরবাড়ি/ পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়/দীপ প্রকাশন/ ২০৯এ বিধান সরণি,কলকাতা ৭০০০০৬/প্রচ্ছদ-সুব্রত চৌধুরী/মূল্য ২৫০ টাকা।








You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.