।। দ্রোহকালের প্রতীক্ষা ।।
অরিন্দম নাথ
এমন একটা পরিবেশে আমরা একত্রিত হব আশা করিনি । শম্ভু, সুনীলদা আর আমি । তিন মূর্তি । তিনজনই একসময় শিক্ষক ছিলাম । আমি পরে শিক্ষকতা ছেড়ে দিই । আমরা একই পাড়ার বাসিন্দা । ছোটবেলা থেকে একই পরিবেশে বড় হয়েছি । সেই বন্ধুত্ব আরো সুদৃঢ় হয়েছিল কলেজ জীবন থেকে । আমাদের এক বিরল নেশা ছিল । সন্ধ্যার পর সুযোগ পেলেই প্ল্যানচেট করতাম । প্ল্যানচেট মৃত আত্মার উপাসনা । একটি ফরাসি শব্দ । লিটল প্ল্যাঙ্ক । ছোট তক্তা । হৃৎপিন্ডের আকৃতির কাঠের টুকরো । আত্মার সাথে যোগাযোগের ডিভাইস । এরমধ্যে কলম অথবা পেন্সিল ঢুকানোর ছিদ্র থাকে । রোল করার জন্য ছোট চাকা থাকে ।
আমরা অগুন্তিবার আত্মাকে ডেকেছি । আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে আত্মা আবির্ভাব হত । কিংবা কিছু একটা । এমন নয় যে আমরা আত্মায় বিশ্বাস করতাম । তথাপি প্রায়ই সন্ধ্যার পর ত্রিমূর্তি প্ল্যানচেটে বসতাম । আমাদের প্ল্যানচেটের পদ্ধতি ছিল ভিন্ন । একটি আস্ত সাদা কাগজ নিতাম । তার উপর A থেকে Z পর্যন্ত ইংরেজি অক্ষরগুলি লিখতাম । শূন্য থেকে নয় পর্যন্ত সংখ্যাগুলি । 'ইয়েস', 'নো', 'স্টার্ট', এন্ড এইসবও লিখতাম । অন্ধকার ঘরে, কখনো খোলা মাঠে মোমবাতি জ্বালিয়ে প্ল্যানচেট করতাম । একটি টাকার কয়েন স্টার্ট ঘরে রেখে অন্ধকারে আমরা তিনজনে আঙ্গুল রাখতাম ।তারপর নিবিষ্টমনে আত্মার উপাসনা করতাম । মৃত লোকটি আমাদের তিনজনেরই পরিচিত থাকতেন । আত্মার প্রভাবেই হোক কিংবা আমাদের মনস্থাত্তিক ও শরীরবৃত্তীয় ক্রিয়ার প্রভাবে মুদ্রাটি কাগজের উপর চলতে শুরু করত । তখন আলো জ্বেলে প্রশ্ন করা হত । কয়েন বিভিন্ন অক্ষর স্পর্শ করত । আমরা ঈপ্সিত উত্তর পেতাম ।
এখন আমরা সিনিয়র সিটিজেন । প্ল্যানচেটের ধরন পাল্টেছে । একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রুম । খুবই ছোট । বড়জোর বার ফুট বাই দশ ফুট । আসবাব খুবই অল্প । এক পাশে একটি ডিভান । মধ্যে একটি টেবিল । গোলাকৃতি । টেবিলকে ঘিরে তিনটি চেয়ার । এর মধ্যে একটু একটু আলাদা । সেই চেয়ারে মিডিয়িম বসবে ।সে মাথায় একটি শিরস্ত্রাণ লাগাবে । সেটি চেয়ারের পাশে রাখা থাকে । অনেকগুলি ইলেকট্রোড এরযধ্য থকে বেরিয়ে এসেছে । সেগুলি একটি যন্ত্রে গিয়ে যুক্ত হয়েছে । সম্মোহনের যন্ত্র । দেখতে অনেকটা ইসিজি মেসিনের মত । ঘরে একটি মাইক্রোফোন সিস্টেম আছে । সঙ্গে সাউন্ড বক্স । সেটি কোথাও ফিক্স করা । ঘরের ম্লান আলোয় দেখতে পাচ্ছিলাম না। সুনীলদা বসেছিলেন সম্মোহনের চেয়ারে । উনার উপর আত্মা ভর করবে । শম্ভু আর আমি বসেছি অন্য দুটো চেয়ারে । শম্ভু আলো জ্বালবে । রিমোট কন্ট্রোলে । আমি প্রশ্ন করব । ছোটবেলা থেকেই আমরা রাজনীতি সচেতন । পাড়ার দেয়াল পত্রিকায় কার্টুন আঁকতাম । ছবি আঁকত শুভেন্দু নাগ । সোনার কাছাড় পত্রিকায় কাজ করতো । সে এখন মৃত । থিম আমরা দিতাম ।সঙ্গে ছড়া । দুই বা চার লাইনের ।
অনেকদিন পর আজ কৈশোরের আনন্দ উপভোগ করছিলাম । প্রথমেই আমরা ঠিক করলাম 'কবজ'-এর তিনজন নেতাকে স্মরণ করব । ক-পার্টি । ব-পার্টি । জ-পার্টি । সবাই কবজধারী । আমৃত্যু কাজ করেন । সমাজ সেবা । অবসর নেই । হয়তো প্রকৃত সুখী । সময় তাদের নিশ্চয় খুব দ্রুততায় কেটে যায় । আঁচও পান না । ঠিক করলাম তিন দলের একজন নেতার আত্মাকে ডাকব । তিনজনই কোনও না কোন সময়ে দলের এই প্রদেশের সভাপতি ছিলেন ।
প্ল্যানচেটের নিয়ম হচ্ছে যাকে ডাকব, তিনি তিনজনেরই পরিচিত হতে হবে । জীবনে কোন না কোন ভাবে ওনার সঙ্গে ফর্মাল বা ইনফরমাল ইন্টারেকশন হয়েছে । অন্যতায় তাঁর আত্মার স্থলে অন্য আত্মা এসে বিগরজালি করবে । তাঁর ছবি, জীবনযাত্রা, বুলি ইত্যাদি নিয়ে ভাবতে হয়। প্ল্যানচেটে বসে প্রথমে আমরা স্মরণ করলাম ধীরেন্দ্রবাবুকে । তিনি ক-পার্টির নেতা ছিলেন । একবার মন্ত্রী হয়েছিলেন । আমি মনে মনে তাঁর চেহারা কল্পনা করছিলাম । শিক্ষক ছিলেন । নিপাট ভদ্রলোক। সংস্কার-মনা মানুষ । খুবই নরম মনের । একটি খলিফার দোকানে যেতেন । কথিত আছে মন্ত্রী হয়ে প্রথমেই খলিফার ছেলেকে চাকুরি দেন । নীতি-পরায়ণ ছিলেন বলেই জানতাম । একটুও অহংকার ছিল না । খুবই সংসারী ছিলেন । মা-বাবা-স্ত্রীকে নিয়ে ছিল তাঁর সংসার । স্ত্রীকে খুব ভালোবাসতেন । বলতেন, সংসার সুখের হয় রমণীর গুনে । স্ত্রীর প্রতি অদ্ভুত রকম আন্তরিকতা ছিল । রাজনীতি তাঁকে সম্মান দিয়েছে । পাশাপাশি বদনামও যুগিয়েছে । পারিষদ দোষে ভুগেছেন । আমার সঙ্গে বেশ কয়েকবার সংঘাত হয়েছে । তখন তিনি মন্ত্রী ছিলেন। আর আমি পুলিশের পদস্থ কর্তা । একবার তাঁর দলের স্থানীয় এক নেতাকে আটক করেছিলাম । আমি আমার কর্তৃত্ব বজায় রেখেছিলাম । থানা থেকে জামিন দিইনি। কোর্টে পাঠিয়েছিলাম । তবে সবসময় তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা মিশ্রিত আচরণ করে এসেছি। উনার আত্মা হাজির হলে আমিই প্রশ্ন করি, "স্যার, আপনি কি এই প্রদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে খুশি ? দলের দায়িত্বে থাকলে নেতা হিসেবে কি করতেন ?"
সুনীলদার মুখে ধীরেন্দ্র বাবুর সুরে কথা শুনে নিজেই অবাক হচ্ছিলাম। তিনি কথা বলছিলেন একটু নিচু স্বরে । তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে । আমি বারবার সুনীলদার মুখের পানে তাকাচ্ছিলাম । সুনীলদা বীরেন্দ্রবাবু থেকে কাল । তবে শার্প চেহারা । তুলনায় তাঁর চেহারা ছিল একটু ধ্যাবড়া মত । ধীরেন্দ্রবাবুর আত্মা খুব প্রত্যয়ের সঙ্গে উত্তর দিচ্ছিলেন, "একদমই খুশি নই । কিছুদিন আগে নির্বাচন হয়ে গেল । একে কি নির্বাচন বলে ! বিরোধী দলের এজেন্ট নেই! আমাদের সময়েও ভোটের রিগিং-এর অভিযোগ উঠেছে । ভোট কারচুপির জন্য বিরূপ প্রচারও হয়েছে। তখন প্রশাসনের কাজ প্রশাসন করত । পুলিশের কাজ পুলিশ করত । রাজনৈতিক শিষ্টাচার মেনে আইনের প্রতি আমরা দায়বদ্ধ ছিলাম । সংবিধানকে মান্যতা দিতাম ।"
- মাফ করবেন স্যার! আপনার সময়ের একটি উপনির্বাচনের কথা ভুলে গেলেন ! প্রহরপুর বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচন ।
- ভুলিনি । তখন কেন্দ্রে আমাদের দলের সরকার। নির্বাচন কমিশন সেই সময়টায় সক্রিয় ভূমিকা নিল । ব্যাপক সংস্কার নিয়ে এলো । অন্য কোন দল হলে সেটা হতে দিত না । আমার খারাপ লাগে আমাদের দলের একনিষ্ঠ সমর্থক পরিবার গুলির জন্য । আমার দলের প্রাক্তন সহযোদ্ধাদের অনেকেই বেইমানি করেছে । দল পাল্টেছে । অনেক পাল্টিকুমার দেখেছি । অনেকে ভুল জেনে প্রায়শ্চিত্ত করার চেষ্টা করেছে । হয়তো এই জীবনে সেই প্রায়শ্চিত্ত শেষ হবে না ।
- আবারো আমায় মাফ করবেন স্যার । আপনি কি কখনো দল পাল্টাননি ?
- হ্যাঁ পাল্টে ছিলাম । ভুল বুঝতে পারি । মূলে থেকে ফুলে যাওয়া ঠিক নয় । ঝরে পড়ে যাওয়ার ভয় থাকে । আমার ক্ষেত্রে তাই হয়েছিল । আর তখনই আমার উপলব্ধি হয় দলের প্রতি, আদর্শের প্রতি অবিশ্বাস মৃত্যুর শামিল। নতুন দলে গিয়ে ফসিল জ্বালানির মত জ্বলতে হয়। আলো দেওয়ার প্রতিযোগিতায় নামতে হয় । কম ভোগান্তি নয় । তাই আমি আবার মূলে ফিরে আসি ।
- রাজনীতিতে আপনার উত্থান এক অর্থে উল্কার মত । আপনার মত নিপাট ভদ্রলোকের রাজনীতিতে আসা বেশ বেমানন । এটা ঘটলো কিভাবে?
- রাজনীতি তখন এত কদর্য ছিল না । যদিও ভোটের সময়ের রিগিং স্বাধীনতার আগে থেকেই চলে আসছে । ইংরাজরা আমাদেরকে স্বায়ত্ত শাসনের অধিকার দিয়েছিল । উনিশশো ত্রিশের দশকে । তখনো ভোটে কারচুপি হয়েছে । তথাপি প্রত্যেকে প্রত্যেকের নীতি আদর্শে বিশ্বাসী থাকত । দলবদলু কিংবা পাল্টিকুমারের কথা শুনিনি ।
আমার কথায় আসছি। রাজনীতির প্রতি আমার আগ্রহ ছিল । আমি ভাগ্যে বিশ্বাসী ছিলাম । আমার একজন বিশ্বস্ত হস্তরেখাবিদ ছিলেন । তিনি প্রথম আমার মধ্যে সম্ভাবনার কথা বলেন । তাঁর ভবিষ্যত বাণীর ছয় মাসের মধ্যে ক-পার্টির হয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অনুরোধ আসে । আমি সেই সুযোগ হাতছাড়া করি না । ভোটে দাঁড়িয়ে আমি জয়ী হই। তারপরের ইতিহাস সবার জানা ।
- কিন্তু আপনিতো পুরো মেয়াদ মন্ত্রী থাকতে পারেননি !
- কেন পারিনি সবাই জানে। রাজনীতিতে যোগ দিয়ে বুঝতে পারি ক্ষমতা এবং অর্থের জন্য অধিকাংশ লোক রাজনীতি করে । ইংরেজিতে একটা কথা আছে, "Power tends to corrupt; absolute power corrupts absolutely." সুতরাং পাপ আমাকেও ছাড়ে না । আমিও মামলা মোকদ্দমায় জড়িয়ে যাই । রাজনীতি যেন চক্রব্যূহ! এখানে একবার ঢোকা যায়, বেরুনো যায় না । আমার মত রথীদের প্রবেশের সুযোগ আছে কিন্তু বেরুবার সুযোগ নাই । আমার থেকে অন্যায়ভাবে অনেক কিছু অনেকে বাগিয়ে নিয়েছে । তবে একটি বিষয় গর্ব করতে পারি । এই প্রদেশের কর্মচারীদের জন্য আমি যা করেছি ভূ-ভারতে কেউ করার সাহস দেখায়নি।
- সেটা ঠিক। আপনি এখন জীবিত থাকলে কি করতেন?
- এখন জ-দলের সরকার। আমি ব-পার্টির সরকারের অত্যাচার সহ্য করেছি। আমার উপর যখন তখন আক্রমণ নেমে এসেছে। তথাপি আমি চেষ্টা করেছি আমার সমর্থকদের উপর আজ যেন আঁচ না পড়ে। সব সময় আমি তাদের পাশে থেকেছি । সুদিনে এবং দুর্দিনে তাদের কাছে গিয়েছি । ভয় পেয়ে ঘরে বসে থাকিনি । আমার ধারণা, আমাদের পার্টির এখনকার নেতারাও এই সত্য বুঝবেন । তবে চূড়ান্ত দ্রোহকাল এখনো আসেনি । ক্রাইসিসি মানুষকে উত্তরণের পথ দেখায় । তাই দ্রোহকালের প্রতীক্ষায় থাকব ।