ধনকুবেরদের রাজত্বে আয় অসমতা ও আর্থিক বৈষম্য

পুরুষোত্তম রায় বর্মন

“সবকা সাথ সবকা বিকাশ” এই স্লোগানের আড়ালে ভারতবর্ষে জাঁকিয়ে বসেছে ধনিকতন্ত্র বা ‘প্লুটোক্রেসি’। ধন কুবেরদের রাজত্ব। আয়ের অসাম্য ও বৈষম্যের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেছে ভারত। “ভারতের আর্থিক অসাম্য: ধনকুবেরদের রাজত্বে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাজত্বের থেকেও বেশি অসাম্য” শীর্ষক রিপোর্ট সম্প্রতি প্রকাশ করেছে প্যারিস স্কুল অব ইকনমিক্স-এর ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ল্যাব। এই ল্যাবে দীর্ঘদিন ধরেই অর্থনীতিবিদরা সারা বিশ্বের আর্থিক অসাম্য নিয়ে গবেষণা করছেন। প্যারিস স্কুল অব ইকনমিক্সের টমাস পিকেটি, আনমোল সোমাঞ্চি, নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিতিন কুমার ভারতী ও হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের লুকাস চ্যানসেল এই রিপোর্টটি তৈরি করেছেন। প্যারিস স্কুল অব ইকনমিক্সের পেশাগত দক্ষতা ও বস্তুনিষ্ঠতা সারা বিশ্বে স্বীকৃত। আয়ের অসমতা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য ১৯২২ সন থেকে এঅব্দি ঐ অর্থনীতিবিদরা তন্ন তন্ন করে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করেছেন এবং একই সাথে সম্পদের অসাম্য সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য ১৯৫১ সন থেকে এই অবধি বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জোগাড় করে উপরোক্ত গবেষণাপত্র তৈরি করা হয়েছে। ২০২২-২৩ সনে ভারতের মোট সম্পদের ৪০ শতাংশই ধনীতম ১ শতাংশ ব্যক্তির হাতে কুক্ষিগত ছিল। দেশের মোট আয়ে ধনীতম ১ শতাংশের ভাগ ২২ শতাংশের বেশি। আরেক দিক শেষ সারির ৫০ শতাংশ বা দেশের অর্ধেক মানুষের আয় দেশের মোট আয়ের মাত্র ১৫% শতাংশ। বিত্তের দিক থেকে তুলনা করলে, উপরের ১ শতাংশ মানুষের গড় আয় বছরে ৫৩ লক্ষ টাকা। গড়পরতা ভারতীয়ের আয়ের ২৩ গুন। দেশের নীচের সারির ৫০% মানুষের গড় বার্ষিক আয় মাত্র ৭১ হাজার টাকা আর মাঝের সারির ৪০% মানুষের বার্ষিক গড় আয় ১ লক্ষ ৬৫ হাজার টাকা। আবার সবচাইতে ধনী ১০ হাজার ব্যক্তির গড় আয় বছরে ৪৮ কোটি টাকা। গড়পরতা মানুষের আয়ের দু’হাজার গুনেরও বেশি। আয়ের অসমতা কিভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে তা স্পষ্ট এই তথ্যে।

১৯৫১ সালে ধনীতম ১ শতাংশ মানুষ দেশের মোট আয়ের ১১.৫% পকেটে ঢোকাতে পেরেছিল। ২০২২ সালে দেশের মোট আয়ের ২২.৬% ধনীতম ১ শতাংশ মানুষের পকেটে গিয়েছিল। ১৯৫১ সনে দেশের ধনীতম ১০% মানুষ মোট জাতীয় আয়ের ৩৬.৭% মালিক ছিল, অন্যদিকে ২০২২ সনে এই ধনীতম ১০% মানুষ দেশের মোট আয়ের ৫৭.৭% নিজেদের পকেটে পুরেছিল। উল্টো দিক থেকে দেখলে, ১৯৫১ সনে দেশের নীচের সারির ৫০% মানুষ জাতীয় আয়ের ২০.৬% মালিক ছিল। ২০২২ সালে নীচের সারির ৫০% মানুষের জাতীয় আয়ের মালিকানা নেমে দাঁড়ায় ১৫%। মধ্যের সারির ৪০ শতাংশ ভারতীয়রা ১৯৫১ সনে মোট জাতীয় আয়ের ৪২.৮% এর মালিক ছিল; ২০২২ সালে তা এসে দাঁড়ায় ২৭.৩%। বিগত দু’দশকে ধনী ও গরিবের মধ্যে ব্যবধান বিরাট ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতে ধনবৈষম্য ও অসমতা ভয়ংকররকম অশ্লীল ও কদর্য। সবচাইতে ধনীতম ১০ হাজার ভারতীয় জাতীয় আয়ের ২.১%-এর মালিক। আয়ের প্রশ্নে দেশের উচ্চ সারিতে রয়েছে এক শতাংশ। এক কোটি ভারতীয় নিয়ে দেশের ধনীতম এক শতাংশ।

ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ল্যাব এই রিপোর্ট তৈরি করার ক্ষেত্রে জাতীয় আয়, মোট সম্পদ, কর প্রয়োগের নীতি, বিনিয়োগের তালিকা এবং আয়-ব্যয় ও‌ সম্পদের উপর সমীক্ষা করে দীর্ঘ ১০০ বছর ধরে ভারতের আয়‌ ও সম্পদ বৈষম্যের পরিমাণগত তথ্য তৈরি করেছে। ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ল্যাবের রিপোর্টে তথ্য ও পরিসংখ্যান দিয়ে দেখানো হয়েছে ভারতে রাজত্ব চলছে ধনকুবেরদের। এই রাজত্বে আর্থিক অসাম্য ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের থেকেও তীব্র। মোদি শাসনের দশ বছরে অর্থাৎ ২০১৪-১৫ থেকে ২০২২-২৩ আর্থিক বছরের মধ্যে এই অসাম্য রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। সবচাইতে ধনী দশ হাজার জনের গড় বার্ষিক আয় ৪৮ কোটি টাকা। আয়ের নিরিখে সবচাইতে পিছিয়ে থাকা দেশের ৫০% মানুষের আয় দেশের মোট আয়ের ১৫ শতাংশ। শুধুমাত্র ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ল্যাবের সাম্প্রতিক রিপোর্ট নয়, অক্সফ্যামের মতো প্রথিতযশা সংস্থা সাম্প্রতিক রিপোর্টে দেখিয়েছে, কিভাবে কোভিডের পর ভারতে ধনী-গরীবের ফারাক আরও তীব্রভাবে বেড়েছে। ধনীরা আরও ধনী হয়েছে ও গরীবরা আরও গরীব হয়েছে।

অর্থনীতির যতটুকুই বৃদ্ধি হচ্ছে, তার সমস্ত সুফল কুক্ষিগত করছে দেশের ধনীতম ১ শতাংশ। অন্যান্য তুলনীয় অর্থনীতির দেশগুলির সাথে তুলনায় ভারতবর্ষে আয়ের স্তরে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি না হলেও, জাতীয় আয়ে ভারতবর্ষের ধনীতম ১ শতাংশের অংশ অন্যান্য তুলনীয় দেশগুলির ধনীতম ১ শতাংশের জাতীয় আয়ের অংশের থেকে অনেক বেশি। ২০২২-২৩ সনে জাতীয় আয়ে ভারতের ধনীতম ১ শতাংশের ভাগ জাতীয় আয়ে চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, গ্রেট ব্রিটেন ও ব্রাজিলের ধনীতম ১ শতাংশের অংশীদারী থেকে অনেক বেশি। ভারতের ধনীতম ১ শতাংশের বার্ষিক গড় আয় ৫৩ লক্ষ টাকা এবং এটা একজন সাধারণ ভারতীয়ের বার্ষিক আয়ের চাইতে ২৩ গুণ বেশি।

ভারত বিশ্বগুরু হয়েছে আর্থিক বৈষম্য ও আয় অসমতার প্রশ্নে। ব্রাজিলের ধনীতম ১০ শতাংশ জাতীয় আয়ের ৫৬.৮ শতাংশের মালিক। চীনের ধনীতম ১০ শতাংশ জাতীয় আয়ের ৪৩.৪ শতাংশের মালিক। ফ্রান্সে ধনীতম ১০ শতাংশ জাতীয় আয়ের ৩৪.৮ শতাংশের মালিক। গ্রেট ব্রিটেনের ধনীতম ১০ শতাংশ জাতীয় আয়ের ৩৩.৭ শতাংশের মালিক। এই পাঁচটি দেশকে ছাপিয়ে ভারত শীর্ষস্থানে রয়েছে। ভারতের ধনীতম ১০ শতাংশ জাতীয় আয়ের ৫৭.৭ শতাংশের মালিক। এই অর্থে ভারত অবশ্যই বিশ্বগুরু। ৯ কোটি ২০ লক্ষ ভারতীয় জাতীয় আয়ের ৫৭.৭ শতাংশের মালিক, অন্যদিকে নিচের সারির ৫০ শতাংশ অর্থাৎ ৪৬ কোটি ১০ লক্ষ ভারতীয় জাতীয় আয়ের মাত্র ১৫ শতাংশের মালিক। মধ্যের সারির ৪০ শতাংশ ভারতীয় অর্থাৎ ৩৬ কোটি ৯০ লক্ষ্ ভারতীয় জাতীয় আয়ের ২৭.৩ শতাংশের মালিক। পৃথিবীর অন্য কোন দেশে এই ধরনের আয় অসমতা ও আর্থিক বৈষম্য নেই।

ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ল্যাবের রিপোর্ট ভারতবর্ষে ক্রমবর্ধমান আয় অসমতা ও আর্থিক বৈষম্য নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থাসহ দেশের বিভিন্ন অর্থনীতিবিদরা যে তথ্য-পরিসংখ্যান হাজির করেছিলেন তাকেই প্রতিষ্ঠিত করল। বিশ্ব খুধার সূচকে ভারতের অবস্থান ক্রমতালিকার ১১১ নম্বরে। মোট ১২৫টি দেশের তালিকায় খাদ্য সুরক্ষা ও খুধা মুক্তিতে ভারতের থেকে ১১০টি দেশ এগিয়ে। এ দেশে ৩১.৭% শিশু বয়সের তুলনায় কম ওজন ও উচ্চতা নিয়ে বড় হচ্ছে অপুষ্টির কারণেই। উচ্চতা ও ওজনের প্রশ্নে শিশুরা সার্বিক বিকাশ থেকে বঞ্চিত। এই রিপোর্ট হঠাৎ করে হাজির হয়নি। কয়েক বছর পূর্বে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটি তাঁর যুগান্তকারী গবেষণার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে পৃথিবীতে আর্থিক বৈষম তীব্রভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ভারতে আয় অসমতা ও আর্থিক বৈষম্যের বৃদ্ধি নজিরবিহীন।

“সবকা বিকাশ এবং সবকা সাথ” স্লোগানের অর্থ হচ্ছে ধনীদের আরও ধনী করা আর গরীবদের তস্য গরীবে পরিণত করা। একদিকে বিভিন্ন বাছাই করা কর্পোরেট সংস্থাগুলোকে নজিরবিহীন সুযোগ প্রদান, ধান্ধা পুঁজিবাদের অবাধ লুট, অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ। এই যুগলবন্দীতে দেশের অর্থনৈতিক বৈষম্য ও আয় অসমতা এক বিস্ফোরক অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছে। এই ধরনের চূড়ান্ত অসমতার ফলে রাজনৈতিক গণতন্ত্র অর্থহীন এবং ঠুনকো হয়ে পরার বিলক্ষণ সম্ভাবনা রয়েছে বলে অর্থনীতিবীদদের বক্তব্য।কেন বাড়ছে এই অসমতা এই সম্পর্কে এক দল অর্থনীতিবিদের বক্তব্য – “সরকার এবং বেসরকারি ক্ষেত্রে বেতন বৃদ্ধির ফারাক একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে”। একই সাথে তারা বলছেন, মূলধন বা পুঁজি থেকে আয় এই অসমতার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করছে।

৯০-র দশক থেকে চালু হয়েছে উদারনীতি, বিগত ১০ বছরের মোদি শাসনে উদারনীতি তীব্র হয়েছে। তার ফলশ্রুতি হচ্ছে এই আয় অসমতা ও আর্থিক বৈষম্য। ৩.৭ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির সমস্ত সুযোগ সুবিধা নিচ্ছে ধনকুবেররা। অন্যদিকে সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকার মান ক্রমশ নীচের দিকে নামছে। ভারতের অর্থনীতি সংক্রান্ত দেশের বিভিন্ন গবেষণাসংস্থার বক্তব্যে ও কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন পরিসংখ্যানেও এই অসমতার চিত্র ফুটে উঠছে। এখনও এই দেশের ৮০ কোটি ভারতীয়কে প্রতি মাসে ৫ কিলো বিনামূল্যে চালের উপর নির্ভর করতে হয় এবং সরকারকে বিনামূল্যে চাল দিতে হয়। এর থেকে অকাট্যভাবে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, ৮০ কোটি ভারতীয়ের ক্রয়ক্ষমতা তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছে এবং ক্রয়ক্ষমতা তলানিতে গিয়ে পৌঁছানোর কারণ হচ্ছে মানুষের হাতে কাজ নেই, শহরাঞ্চলে এবং গ্রামাঞ্চলে তীব্র বেকারী।

ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ল্যাবের রিপোর্টে অত্যন্ত যথার্থভাবেই এই বলে সতর্কবার্তা উচ্চারণ করা হয়েছে “It is unclear how long such inequality levels can sustain without major social and political upheaval”রিপোর্টে কতগুলো নীতিগত সুপারিশও করা হয়েছে। যেমন বিলিয়নেয়ারদের উপর সুপার ট্যাক্স আরোপ করা এবং মাল্টিমিলিয়নেয়ারদের উপর ২% অতিরিক্ত কর আরোপ করা। কর কাঠামো ঢেলে সাজানো, ইত্যাদি।

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিদগ্ধ অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু অতি সম্প্রতি আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত "ভাবতে ভয় হয়" শীর্ষক উত্তর সম্পাদকীয় প্রবন্ধে বলেছেন, বৈশ্বিক আর্থিক মন্দার বছর ২০০৮ বাদ দিলে ২০০৩ থেকে ২০১১ পর্যন্ত ভারতীয় অর্থ ব্যবস্থায় জিডিপির বৃদ্ধির যে হার ছিল, বর্তমান বৃদ্ধির হার, তার তুলনায় শ্লথতর। উক্ত প্রবন্ধে তিনি আরও বলেছেন, ২০১৬ থেকে টানা পাঁচ বছরের প্রতি বছর আর্থিক বৃদ্ধির হার তার আগের বছরের তুলনায় কম ছিল। ভারতে এ জিনিসটা আগে কখনও হয়নি। বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে মাথাপিছু আয় এর নিরিখে, বাংলাদেশ ২০১৮ সালে ভারতকে টপকে গিয়েছে এবং তার পরের পাঁচ বছর সেই অবস্থান বজায় আছে। কৌশিক বসু উক্ত প্রবন্ধে বলেছেন, ভারতে যে আর্থিক বৃদ্ধি ঘটছে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার প্রায় পুরোটাই অতি ধনীদের কুক্ষিগত। ভারতীয় তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার এবং দেশের সার্বিক আর্থিক অসাম্য সর্বকালের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছে - এই বলে কৌশিক বসু গভীর আশঙ্কা ও খেদ প্রকাশ করেছেন। ভারত চূড়ান্ত অসাম্যের আগ্নেয়গিরির উপর বসে আছে।

ভারতীয় সংবিধানের চতুর্থ অধ্যায়ে রাষ্ট্রের প্রতি নির্দেশাত্মক নীতিগুলোর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ৩৯ ধারা। ৩৯ ধারায় বলা হয়েছে রাষ্ট্রকে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এমন ভাবে পরিচালনা করতে হবে যাতে সর্বজনের স্বার্থের বিপরীতে সম্পদ ও উৎপাদন উপকরণের কেন্দ্রীকরণ না ঘটে। সংবিধানের ৩৮ ধারায় বলা হয়েছে, জনগণের কল্যাণের উদ্দেশ্যে, রাষ্ট্র সবার জন্য সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায় নিশ্চিত করতে সক্ষম সামাজিক ব্যবস্থা কায়েম করার জন্য প্রচেষ্টা নেবে এবং জাতীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলিকে এই লক্ষ্যেই পরিচালনা করবে।

সংবিধানের প্রস্তাবনায়ও সবার জন্য সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায় অর্জনের লক্ষ্যের কথা বলা হয়েছে। সংবিধানের অন্যতম রূপকার ডঃ বি আর আম্বেদকর অত্যন্ত সঠিকভাবেই বলেছিলেনঃ- যে ভারত চরমভাবে বৈষম্য ও অসাম্য পীড়িত একটি দেশ। এরকম একটি দেশে রাজনৈতিক গণতন্ত্র কথার কথা থেকে যাবে যদি সামাজিক অসাম্য ও বৈষম্য আমরা দূর না করতে পারি। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পর দেশে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য হিমালয় সদৃশ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। স্বাধীনতার পরেও দেশে আয় অসমতা ও আর্থিক বৈষম্য ছিল। কিন্তু ৯০-র দশকের পর থেকে বিশেষত বিগত এক দশকে আয় অসমতা ও বৈষম্য প্রচন্ড তীব্রতা লাভ করেছে, এর মূল কারণ, অর্থনৈতিক উদারীকরণ এবং অর্থনৈতিক উদারীকরণের হাত ধরেই এসেছে ধান্দা পুঁজিবাদ বা ক্রনি ক্যাপিটালিজম। আর, এস্ এস - বি জে পি-র শাসনে ধান্দা পুঁজিবাদ ব্যাপক আগ্রাসী চেহারা নিয়েছে। এরই ফলশ্রুতিতে আয় অসমতা ও আর্থিক বৈষম্য তীব্র ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সংবিধানের নিরদেশত্মক নীতিগুলো নিয়ে কিন্তু কেউ কোন কথা বলেন না। কর্পোরেট মিডিয়া কখনও উল্লেখ করে না যে, নির্দেশাত্মক নীতিগুলি রাষ্ট্রকে দায়িত্ব দিয়েছে আয় অসমতা ও আর্থিক বৈষম্য কমানোর জন্য। বিগত ৭৫ বছরে বিশেষ করে গত ১০ বছরে নিরদেশত্মক নীতিকে প্রতিমুহূর্তে বিদ্রুপ করে এবং অস্বীকার করে উদারবাদের বুলডোজার প্রয়োগের মধ্য দিয়ে দেশজুড়ে আয় অসমতা ও আর্থিক বৈষম্য বিপজ্জনক মাত্রায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এর ফলে রাজনৈতিক গণতন্ত্র বিপন্ন হয়ে পরার বিলক্ষণ সম্ভাবনা রয়েছে। যখন সমস্ত অর্থনৈতিক সম্পদ একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে, তখন এটা স্বাভাবিক রাজনৈতিক ক্ষমতা তাদের হাতেই কেন্দ্রীভূত হয়েছে। সভ্যতার ইতিহাস একথা জানান দেয় যে, যার হাতে সম্পদ তার হাতেই শাসনক্ষমতা। আর এই শাসনক্ষমতা ব্যাবহার করে বিপুল জনসম্পদের উপর তাদের সম্পদ আরও স্থিত হয়েছে।

আমাদের সামাজিক সম্পদ যারা প্রতিমুহূর্তে লুট করে নিজেদের হাতে কুৎসিত ভাবে জমা করছে, তারা কোনোভাবেই তাদের শাসন সম্পদে গরীবদের ভাগ বসাতে দেবেন না, দিতে পারে না। ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ল্যাব তাদের রিপোর্টে পরামর্শ দিয়েছে আয় অসমতা ও আর্থিক বৈষম্য কমানোর জন্য গড় ভারতীয়দের সক্ষম করতে হবে এবং তাদের সক্ষম করার‌ জন্য কর ব্যবস্থা পূনর্গঠন করতে হবে। শুধু তাই নয়, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পুষ্টিতে জনসাধারণের জন্য বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এই বিনিয়োগ‌ই জনসাধারণকে আত্মনির্ভর হতে সাহায্য করবে।

সাধারণ ভারতীয়দের সক্ষম ও আত্মনির্ভর করার জন্য জরুরী - খাদ্যের অধিকার, কর্মসংস্থানের অধিকার, বেকার ভাতা প্রদান, সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির মাধ্যমে নূন্যতম উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিনামূল্যে মানসম্মত শিক্ষার অধিকার, জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবার মাধ্যমে‌ সার্বজনীন বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার , আজীবন সার্বজনীন ও অনুদানমূলক বার্ধক্য পেনশন ও প্রতিবন্ধকতা জনিত সুবিধা পাওয়ার অধিকার - এই ৫টা মৌলিক অধিকার সবার জন্য নিশ্চিত করা। এটা করতে গেলে, যা ব্যয় হবে, তা জিডিপি-র ১০%।‌ এই‌ ১০% খুব সহজে জোগাড় করা যাবে দেশের ধনীতম ১% -এর উপর দুটি কর আরোপ করে - প্রথমটি ২% সম্পদ কর , দ্বিতীয়টি যে কোন সম্পত্তি হস্তান্তরে সেই সম্পত্তির ১/৩ মূল্যের উপর উত্তরাধিকারী কর আরোপ করে। দেশের ১৬৭ টি ধনীতম পরিবারের উপর যদি ২ শতাংশ সম্পদ কর বসানো হয় তবে সেই কর থেকে যে সরকারী আয় হবে, তা দিয়ে সার্বজনীন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সবার জন্য খাদ্য সুরক্ষা, কর্মসংস্থান অথবা কর্মসংস্থান সাপেক্ষে বেকার ভাতা এবং সমস্ত প্রবীণ নাগরিকদের জন্য নূন্যতম মাসিক ১০ হাজার টাকা পেনশনের ব্যবস্থা করা যায়। এর জন্য মোট খরচ জি.ডি.পি.র ১০% বেশি হবে না এবং এই খরচ তোলা সম্ভব ১৬৭টি ধনী পরিবারের উপর ২ শতাংশ সম্পদ কর আরোপ করে। এটা বলা বাহুল্য ধনীরা আয় করছেন জাতীয় সম্পদ লুট করে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কর্পোরেট বান্ধব কর ছাড়া নীতির সুবাদে। আমাদের দেশে কর কাঠামো মূলত পরোক্ষ করের উপর নির্ভরশীল। দেশের সিংহভাগ কর আসে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে পরোক্ষ কর আদায় করে, অন্যদিকে ধনীদের উপর প্রত্যক্ষ কর পৃথিবীর অন্য সমস্ত দেশগুলোর তুলনায় ভারতবর্ষে সবচাইতে কম।

লোকসভা নির্বাচনের মুখে যখন সারাদেশে কৃত্তিম সমৃদ্ধির ঢোল পেটানো হচ্ছে, তখন এই ধরনের রিপোর্টের মুখে দাঁড়িয়ে সরকার ও শাসক দল বেকায়দায় পরে বলছেন, এই ধরনের রিপোর্ট সঠিক নয়। সরকারের পোষা কলমজীবিরা নেমে পড়েছেন মাঠে ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ল্যাবের রিপোর্টে ভুল ত্রুটি ধরার জন্যে। দেশের আর্থিক দুর্দশার করুণ ছবি যাতে জনসমক্ষে না আসে, তার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার অর্থনীতি সংক্রান্ত সমস্ত সরকারী পরিসংখ্যান প্রকাশ্যে আনা বন্ধ করে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার চরম তথ্য বিকৃতি করছে। যেমন কিছুদিন পূর্বে, নীতি আয়োগের একজন বরিষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন মোদি সুশাসনে দারিদ্র্যের হার কমে দাড়িয়েছে মাত্র পাঁচ শতাংশ। এই ধরনের পরিসংখ্যান সত্যের অপলাপ ছাড়া আর কিছুই নয়। সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন-যাপনের তিক্ত কর্কশ অভিজ্ঞতা বিপরীত কথা বলে। লোকসভা নির্বাচনের মুখে অর্থনীতির করুন অবস্থা ও জনগণের জীবন-জীবিকার ভয়ানক অবস্থা থেকে দৃষ্টি ফেরানোর একমাত্র মুখ্য অস্ত্র হচ্ছে ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ। কিন্তু এভাবে বেশিদিন চলতে পারে না।

(এই লেখাটি দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় ১১ই এপ্রিল ২০২৪ তারিখে প্রকাশিত হয়েছিল)


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.