ঊনকোটির মতো ভুবনও শৈবতীর্থ

পান্নালাল রায়

ত্রিপুরার ঊনকোটির সঙ্গে কাছাড়ের ভুবন পাহাড়ের এক আশ্চর্য সাদৃশ্য রয়েছে।দুটিই শৈবতীর্থ। পাথরের বিগ্রহ রয়েছে দুটি পাহাড়েই।তবে ভুবন তীর্থের বৈশিষ্ট্য হলো সেখানে রয়েছে বহুকথিত এক সুড়ঙ্গ পথ,যা ত্রিপুরার ঊনকোটিতে নেই। ভুবন পাহাড়কে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলের পর্যটন বিকাশের সম্ভাবনার সদ্ব্যবহারের দাবি উঠছে আজ।

ত্রিপুরার কৈলাসহরে ঊনকোটির অবস্থান। ধর্মনগর-কৈলাসহর সড়ক থেকে একটি শাখা পথ চলে গেছে ঊনকোটির বুক অব্দি।সেখানে পাহাড়ের গায়ে পাথরে খোদিত রয়েছে বিরাট বিরাট ভাস্কর্য।এ ছাড়াও রয়েছে পৃথক পৃথক পাথরের বিগ্রহ। শিব মূর্তির আধিক্য দেখে ঊনকোটিকে শৈবতীর্থ বলা হয়ে থাকে।প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে খ্রিষ্টীয় অষ্টম-নবম শতকে ঊনকোটির বিগ্রহ সমূহের সৃষ্টি শুরু হয়।ভুবন সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন, ভুবনের বিগ্রহ সকল ঊনকোটিরও আগেকার সৃষ্টি।তবে দুটি পীঠভূমিরই সৃষ্টি একই জনগোষ্ঠীর হাতে হয়েছে বলে তাদের অনুমান। এখানে এটা উল্লেখ করা যায় যে,ত্রিপুরার ঊনকোটির তুলনায় কাছাড়ের ভুবন যেন প্রচারের আলোয় এসেছে কিছুটা কম।

ভুবন পাহাড়ের চূড়ায় রয়েছে একটি প্রাকৃতিক জলাশয়।এক সময় পাহাড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল বেশ কিছু প্রাচীন ভাস্কর্য। সেসবের প্রায় সবই বিনষ্ট হয়ে গেছে।কিছু হয়তো বা চুরিও হতে পারে।শতাধিক বছর আগে প্রকাশিত 'কাছাড়ের ইতিবৃত্ত' গ্ৰন্হে লেখক উপেন্দ্রচন্দ্র গুহ ভুবনেশ্বর বিগ্রহ সম্পর্কে লিখেছেন,"কৌপিনবস্ত্র পরিহিত,দ্বিভুজ দ্বিনেত্র, কৃশোদর, বাম হস্ত বাম জানুর নিম্নে রক্ষিত এবং দক্ষিণ হস্ত হৃদয়ে ধারণ করতঃ পূর্ব্বাভিমুখে পাষাণোপরি দন্ডায়মান। গলদেশে প্রস্তর নির্ম্মিত মালা শোভা পাইতেছে।বিগ্ৰহের উচ্চতা প্রায় সার্দ্ধ দুই হস্ত।" ভুবনেশ্বরী বিগ্রহের বর্ণনা এই রকম-"ভুবনেশ্বর বিগ্রহের প্রায় ১০ ফিট উত্তর-পূর্ব্ব দিকে দ্বিভুজা,দ্বিনেত্রা,নব যৌবন সম্পন্না ভুবনেশ্বরী মূর্ত্তি স্বীয় বাম হস্ত বক্ষঃস্হলের কিঞ্চিত নিম্নে পার্শ্বান্তর প্রসারিত অবস্থায় দক্ষিণাস্যে দন্ডায়মান। এই বিগ্রহের দক্ষিণ হস্ত ভগ্ন মস্তক হইতে কটির উপরিভাগ পর্য্যন্ত অনাবৃত, কটিদেশ হইতে জানু পর্য্যন্ত প্রস্তরবসন পরিহিত এবং তম্নিম্ন ভাগ ভূমিতে প্রোথিত।"

শতাধিক বছর আগে প্রকাশিত গ্রন্থে ভুবন তীর্থের যে বর্ণনা রয়েছে সেই চিত্রটা আজ আর খুঁজে পাওয়া যাবেনা।কাছাড়ের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত ভুবন পাহাড়ের সর্বোচ্চ অংশের উচ্চতা তিন হাজার ফুট হবে।এই পীঠভূমিতে মন্দির সম্পর্কেও 'কাছাড়ের ইতিবৃত্ত' গ্ৰন্হে রয়েছে-" ভুবনেশ্বর মন্দির পূর্ব্বকালে প্রস্তর নির্ম্মিত ছিল। কথিত আছে যে,সর্ব্ব উপরিস্হ টীলার বৃহৎ প্রস্তরখণ্ড স্খলিত হওয়ায় তাহার আঘাতে উক্ত মন্দির ভগ্ন ও অনেক মূর্ত্তি বিধ্বস্ত হইয়াছে।নানা বিধ লতা-পাতা অঙ্কিত ছিন্ন বিচ্ছিন্ন প্রস্তর ভিন্ন অপরাপর চিহ্ন সকল লুপ্তপ্রায়।...ভুবনেশ্বর বাড়ী হইতে দেড় মাইল ছড়া-পথ অতিক্রম করিয়া চারটি টিলার মধ্য ভাগে একটি ক্ষুদ্র উপত্যকায় নানা দেবদেবীর মূর্ত্তি দেখিতে পাওয়া যায়।..." শ্রীগুহ তাঁর গ্ৰন্হে এ রকম কিছু বিগ্রহের কথা উল্লেখ করেছেন যেসব শতাব্দীকাল আগেও ভুবন পাহাড়ে দেখতে পাওয়া যেত।তিনি কারুকার্যময় বহু প্রাচীন প্রস্তর খন্ডের কথাও উল্লেখ করেছেন। শতাব্দীকাল আগেই শ্রীগুহ লিখেছিলেন যে,ভুবন পাহাড়ে এমন অনেক কিছু রয়েছে যা সাধারণ মানুষের কাছে অজ্ঞাত। এই অঞ্চলের আবৃত ইতিহাস উন্মোচনে তিনি ভুবন পাহাড়ের প্রত্ন সম্পদ বিষয়ে বিশেষ অনুসন্ধানেও গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।

অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগেও সাধারণ মানুষের কাছে ভুবন পাহাড়ের কথা প্রায় অজ্ঞাত ছিল। পথও ছিল অগম্য। ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে কাছাড়ের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের(১৭৮০-১৮১৩ খ্রিঃ) সচিব জয় সিংহ একটি মন্দির নির্মাণ করার উদ্দেশ্যে অনেক লোক লস্কর নিয়ে ভুবন পাহাড়ে যাত্রা করেছিলেন। এমন কথিত আছে যে,তিনি স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে এতে নিবৃত্ত হন এবং সোনাইমুখের কাছে চন্দ্রগিরিতে শিবলিঙ্গ স্হাপন করে একটি ছোটো মন্দির নির্মাণ করিয়ে দেন।যাইহোক, অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালে ভুবন পাহাড়ের প্রতি সমতলবাসী পুণ্যার্থীদের আকর্ষণ বাড়তে থাকে।বর্তমানে শিব চতুর্দশীর সময় ভুবনে বিরাট মেলা বসে।বিপুল সংখ্যক মানুষের সমাগম ঘটে মেলাতে।

এখানে উল্লেখ করা যায় যে,অতীত কাল থেকেই ভুবন নাগা জনজাতিদের কাছেও এক পুণ্য পীঠভূমি।এরকম কথিত আছে যে ভুবনের নানা দেবদেবীর বিগ্রহকে নাগা জনজাতিদের আদি পুরুষ বলে ভাবা হতো।ভুবন পাহাড়ে নাগা বিষ্ণু মন্দিরে বর্তমানে খুব উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যে বার্ষিক ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয়ে থাকে।পূর্বোত্তরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পুণ্যার্থীরা ভুবন পাহাড়ে নাগা বিষ্ণু মন্দির পরিদর্শনে আসেন।এরকম জানা যায় যে,রানি গাইদিন লিউ ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনের সময় এখানে এসে বিষ্ণুর আশীর্বাদ প্রার্থনা করেছিলেন।রঙ্গমেই নাগা ধর্মীয় নেতা হাইপৌ জাদোনাঙ্গও ভুবন পাহাড়ে এসেছিলেন।

ভুবন পাহাড়ে একটি দীর্ঘ সুড়ঙ্গ পথ নিয়েও রয়েছে রহস্য। কারা সৃষ্টি করেছিল এই সুড়ঙ্গ পথ? নাকি প্রাকৃতিক উপায়ে সৃষ্ট এই সুড়ঙ্গ? এমন কথাও প্রচারিত আছে যে,সুদূর অতীতে পার্বত্য অঞ্চলের জনজাতিরা বিপদে আশ্রয় নেয়ার জন্য এই সুড়ঙ্গ সৃষ্টি করেছিল।তবে শ্রীগুহ এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে,কাছাড়ে রাজত্বকালে ত্রিপুরার কোনও পরাক্রমশালী রাজা মুণি-ঋষি বা বৌদ্ধ যতীদের যোগ সাধনার জন্য এই সুড়ঙ্গ খনন করিয়েছিলেন। ভুবন পাহাড়ের সুড়ঙ্গ পথ সম্পর্কে আধুনিক কালের বর্ণনা রয়েছে বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ সুজিৎ চৌধুরীর 'শ্রীহট্ট-কাছাড়ের প্রাচীন ইতিহাস' গ্ৰন্হে।তিনি লিখেছেন-"সংকীর্ণ একটি সুঁড়িপথ অতিক্রম করে পাওয়া যায় একটি ছড়া,সেই ছড়া অতিক্রম করে সুড়ঙ্গটির প্রবেশ পথ।প্রবেশ পথ অতিক্রম করে প্রথমেই পাওয়া যায় একটি চত্বর,যার দৈর্ঘ আশি ফুট,প্রস্হ ত্রিশ ফুট এবং উচ্চতা বিশ ফুট।তারপর আরেকটি প্রবেশ পথ নিচে নেমে গেছে,সেটা দিয়ে নেমে প্রথম চত্বরের মতোই দ্বিতীয় আরেকটি প্রশস্ত স্হান। অতঃপর আরেকটি প্রবেশ দ্বার, সেটা সংকীর্ণ ও দীর্ঘ-তারপর পাওয়া যাবে তৃতীয় আরেকটি চত্বর।ডানদিকের পাথুরে দেয়ালে দুটো মূর্তি খোদাই রয়েছে,কিন্তু ঘন শেওলার আস্তরণের জন্য সেগুলোর চেহারা বোঝা যায় না।এর পরেও দুটো প্রবেশ পথ দিয়ে আরও ভেতরে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে...বলা হয়ে থাকে যে সর্বশেষে আরেকটি চত্বর রয়েছে সেটির মধ্যিখানে রয়েছে একটি শিবলিঙ্গ।..."এক সময় এমন জনশ্রুতি প্রবল ছিল যে ভুবনের সুড়ঙ্গ পথের সঙ্গে কামাখ্যা পাহাড়ের সংযোগ রয়েছে।অবশ্য এর যে কোনও অস্তিত্ব নেই তা বলা নিষ্প্রয়োজন।তবে ভুবন তীর্থের সুড়ঙ্গ পথের পুরোটাই যে মনুষ্য সৃষ্ট নয় সে কথাও বলেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞগণ। প্রাকৃতিক গুহার অভ্যন্তরে মানুষের মেধা ও শ্রমের প্রয়োগ ঘটেছিল।প্রশস্ত হয়েছিল সুড়ঙ্গের প্রবেশ পথ।

কিন্তু কোন্ সে সুদূর অতীতে কারা সাজিয়েছিল এই ভুবন তীর্থ? কারা বানিয়েছিল নানা দেবদেবীর বিগ্রহ। অনেকে এরকম অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে,ভুবন তীর্থ কোনও একটি বিশেষ যুগের বিশেষ মানব গোষ্ঠীর সৃষ্টি নয়।বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানব গোষ্ঠী গড়ে তুলেছেন এই পীঠভূমি।ত্রিপুরার ঊনকোটি সম্পর্কেও এই অভিমত যে,বিভিন্ন ধর্মীয় ধ্যান ধারণায় পুষ্ট হয়েছে ঊনকোটি।নানা সময়ে সৃষ্টি হয়েছে তার নানা বিগ্রহ। কিন্তু শুরুটা তো এক সময় হয়েছিল!সেটা কারা কখন করেছিল?এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে অনেকে 'রাজমালা'র আশ্রয় নিয়েছেন। এক সময় ত্রিপুরার রাজারা 'ত্রিবেগ' নগরী ছেড়ে সরে এসেছিলেন দক্ষিণ দিকে।বরবক্র অর্থাৎ বরাক নদীর উজানে 'খলংমা'তে তারা রাজধানী স্হাপন করেছিলেন। কাছাকাছি ভুবন পাহাড়ের আদি শিল্পকর্ম গুলো হয়তো তখনই গড়ে উঠেছিল। ভুবন পাহাড়ে ত্রিপুরীরাই প্রথম শিল্পকর্ম গড়ে তুলেছিল বলে সুজিৎ চৌধুরীও অনুমান করেছেন।

ভুবন বিভিন্ন ভাষাভাষি মানুষের এক মিলন তীর্থে পরিণত হয়েছে বললে অত্যুক্তি হবেনা।নাগা ধর্মপ্রাণ মানুষের কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে।কাছাড়ের মণিপুরীদের কাছেও ভুবন এক পবিত্র তীর্থ।মণিপুরের রাজা বোধচন্দ্র ভুবন তীর্থ দর্শন ও পাহাড়ে রাত্রিবাসের পর মণিপুরীদের মধ্যে ভুবনের তীর্থ মাহাত্ম্য আরও ব্যাপক ভাবে প্রচার লাভ করে।সব মিলিয়ে ভুবন তীর্থ যেন এক ঐতিহ্যের আলোয় উদ্ভাসিত। এই তীর্থভূমির উন্নয়নে সাম্প্রতিক কালে কিছু কিছু কাজ হলেও সামগ্ৰিক ভাবে একে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলে পর্যটন বিকাশে সম্ভাবনার সদ্ব্যবহারের উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বেশ কিছুদিন আগে ঘোষণা করা হয়েছিল অসমের অন্য ক'টি জায়গার সঙ্গে ভুবন পাহাড়েও রোপ ওয়ে করা হবে।কিন্তু এর কার্যকরী রূপ কই?ভুবনকে কেন্দ্র করে রাস্তাঘাট সহ পরিকাঠামোর উন্নয়নে অনেক কিছুই করার আছে।সেসব রূপায়িত হলে ভুবনে পুণ্যার্থী পর্যটকদের আগমন বাড়বে এবং এতে স্বাভাবিক ভাবেই স্হানীয় অর্থনীতিতেও তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.