।। এমন যদি হতো ।।
অরিন্দম নাথ
![](https://www.tripurainfo.com/BanglaArticle/Photos/514.jpg)
আজকাল ত্রিপুরার লোকজন বনভোজন খুব উপভোগ করে। সারা বছরই কোনো একটা আছিলায় ঘুরতে যায়। তাই অধিকাংশ পিকনিক স্পটে ভিড় থাকে। সত্যিকার অর্থে উপভোগ করা যায় না। আগরতলার এত কাছে এতো নিরিবিলি, এতো মনোরম একটি স্পট আছে আমার ধারণায় ছিল না। স্থানটির নাম ভাগলপুর । নরসিংহগড়ের অনতিদূরে অবস্থিত। গত ২০ শে মার্চ, ২০২৪, বুধবার গিয়েছিলাম সেখানে। সৌজন্যে জ্ঞান বিচিত্রার কর্ণধার দেবানন্দ দাম, অঞ্জনা বৌদি, কন্যা আবেরী এবং তাঁদের বাড়ি ও প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন । প্রধান উদ্যোক্তা উদয়শঙ্কর ভট্টাচার্য ওরফে মিঠুদা । মিঠুবাবুর সঙ্গে সেদিনই সম্যক পরিচয় । অল্পক্ষণেই আবিষ্কার করলাম তিনি সহোদর ভাইয়ের স্থান দখল করে নিয়েছেন । তাঁর অন্তর এবং বাহির মেন চিরপরিচিত। মিঠুদা ভালো তবলচি । আইসিএটিতে চাকুরী করতেন । এখন অবসরে । পাশাপাশি লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত।
![](https://www.tripurainfo.com/BanglaArticle/Photos/Tripurainfo-Pix-Eman-Jadi-Hoto-Arindam-Nath-29-03-2024-1.jpg)
বিমলেন্দ্র চক্রবর্তী আমাদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ । বিমলেন্দ্রদা ও আমি স্বস্ত্রীক এসেছি । সুভাষ দাস, সঞ্জয় কর, কাকলি গঙ্গোপাধ্যায়, অলকানন্দা চৌধুরী ও মিঠুদা সিঙ্গেল এসেছিলেন । সবাই ষাট পেরিয়েছেন । কৃষ্টি এবং কলার সঙ্গে জড়িত । মেঘবালিকা ব্যান্ডের অনন্যা সরকার । গিটার নিয়ে এসেছিল । বয়সে আবেরী দাম কনিষ্ঠা । অনন্যা দ্বিতীয়া । একজন ফটোগ্রাফার । সবমিলিয়ে সতের জন । একটি মিনিবাসে সকাল দশটায় রবীন্দ্রভবনের সামনে থেকে রওয়ানা হই । ঘন্টা খানেকের মধ্যে আমরা গন্তব্যে পৌঁছে যাই । প্রায় চৌত্রিশ বছর পর এখানে আসা । উনিশশো নব্বইয়ের এপ্রিলে পুলিশে যোগ দিই । কিছুদিন নরসিংহগড় পুলিশ ট্রেনিং কলেজে ছিলাম । প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে । তখন একদিন সকালে দৌড়াতে দৌড়াতে ওস্তাদজি এখানে নিয়ে এসেছিলেন । রাস্তাঘাটের অনেক উন্নতি হয়েছে । বসতি বেড়েছে । তবে গ্রামীণ পরিবেশ এখনও বিরাজমান । সেবার ছিল কাঁঠালের মরশুম । প্রচুর কাঁঠাল গাছ নজরে এসেছিল । আমারা কাঁঠাল খেয়েছিলাম ।
এখন বসন্তকাল । এখানে বসন্ত এসেছে । ঠিক ফুলেল নয় । দিঘির পারে গাছপালা প্রচুর । সঙ্গে গ্রামীন প্রকৃতি। একটি পলাশ । কয়েকটি শিমুল গাছও নজরে এলো । আমের মুকুল ঝরছে । অন্যথায় সর্বত্র ঝরা পাতার ফিসফিস । দখিনা বাতাস । দিঘির পারে একটি হাওয়া মহল । পাকা । অনেক বছর আগে এক বিধায়ক গড়ে দিয়েছিলেন । দুইপাশে বটগাছ । ডানপাশে গাজীবাবার দরগা । তাঁর ছবি । একটি চাতাল । ইটের । বাঁধানো নাটমন্দির । স্বপ্নে পাওয়া গাজীবাবার পাথর । পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশের সিঙ্গারবিল থেকে আনা । একজন ফকির নিয়ে এসেছিলেন । এই নিয়ে অনেক গল্পগাথা । পাথরটিতে থেকে নাকি জল গড়িয়ে পড়তো । একসময় বন্ধ হয়ে যায়। একসময় এখানে বাঘ ছিল। সেইথেকে স্থানটির নাম ভাগলপুর । বাঘের অপভ্রংশ ভাগলপুর । আমার মন মানতে চায় না । গাজীবাবার কাহিনী অনেকটা সুন্দরবনের বনবিবি ও শাহ জঙ্গলির অনুরূপ ৷
![](https://www.tripurainfo.com/BanglaArticle/Photos/Tripurainfo-Pix-Eman-Jadi-Hoto-Arindam-Nath-29-03-2024-2.jpg)
গাইড মিঠুদার পরিচিত । দরগার কাছেই বাড়ি । বয়স পঞ্চান্ন। পুরানো বাসিন্দা । তারা এসেছেন বাংলাদেশের সিঙ্গারবিল এলাকা থেকে । ষাটের দশকের শুরুতে । জমি বিনিময়ের মাধ্যমে । এখানে মুসলিম বসতি ছিল । তারা চলে গেছে হিন্দুদের গ্রাম ক্ষিরাতলায় । নিজেদের মধ্যে সৌভ্রাতৃত্য এখনো বিরাজমান । দরগায় প্রতি সন্ধ্যায় হিন্দুরাই প্রদীপ জ্বালায় । উরুসের মেলা বসে । তখন বাংলাদেশ থেকে মুসলিম লোকেরা আসে । বর্ডারে পাহারা শিথিল হয় । এরবাইরে একবার একজন পক্ষঘাতগ্রস্থ রোগী এসেছিলেন । কাঠের তক্তাতে করে । তাঁর স্বপ্নে গাজীবাবা এসেছিলেন । এই দরগার লাগোয়া একটি বেল গাছে বেল মিলবে । সেটি খেলে তিনি সুস্থ হয়ে যাবেন । তখন বেলের সময় নয় । অনেকগুলি বেলগাছ খুঁজেও কোথাও কোন বেল পাওয়া যায় না । শেষ পর্যন্ত আবিষ্কার হল একটি গাছে বেলের চারদিকে পিঁপড়ে বাসা বানিয়েছে । সেটি খেয়ে ভদ্রলোক মাস তিনেকের মধ্যে সুস্থ হয়ে ওঠেন । আবার এখানে আসেন । এবার হেঁটে । সঙ্গে বেশ কিছু লোকজন । সবাই মুসলিম । দুটো খাসি । বিরাট বিরাট । একটি হিন্দুদের জন্য । অন্যটি মুসলিমদের জন্য । তারপর দুই পক্ষ মিলে একসঙ্গে ভোজ সম্পন্ন করে । পরে পারমিতা তার বিশ্বাসের কথা আমায় বলেছিল । তক্তাতে বেঁধে আনায় এবং বিশ্রামের দরুণ ভদ্রলোক সুস্থ হয়েছিলেন ।
দেবানন্দদা তোফা আয়োজন করেছিলেন । তবে তিনি বারবার মিঠুদাকে বাহবা দিচ্ছিলেন । মিঠুদাই আয়োজন করেছেন । দেবানন্দদা স্পনসর করেছেন । ব্রেকফাস্টে লুচি এবং পিঠে । লুচি সবজি বর্জিত । পিঠে দেখতে ইডলির মত । খুবই সুস্বাদু । কয়েকজন গ্রামবাসী এলেন । একজন ব্লকের স্টাফ । কালীবাবু । নাট্যপ্রেমী । নিজেরাও নাটক করেন । সঞ্জয়দা এসেছেন খবর পেয়ে হাজির হয়েছিলেন । মিঠুদার পরিচিত । প্রথমে কাকলিদি একটি আবৃতি করলেন । নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতা । একশত বছর আগে লেখা । কোনঠাসা পরিবেশে একজন স্বাভিমানী লোকের কি করা উচিত । দেবানন্দদা লিখে এনেছিলেন। কবিতার কথাগুলি আজও ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক ।এরপর অনন্যা গিটার বাজিয়ে দুইটি গান গাইলো । প্রথম গান, "এমন যদি হতো, আমি পাখির মতো, উড়ে উড়ে বেড়াই সারাক্ষণ... ।"
![](https://www.tripurainfo.com/BanglaArticle/Photos/Tripurainfo-Pix-Eman-Jadi-Hoto-Arindam-Nath-29-03-2024-3.jpg)
তার গলা ভীষণ রকম মিষ্টি। সবাই উপভোগ করছিল । এমনকি স্থানীয় কয়েকটি ছাগল ছিল । ভীষণই মিশুকে । তারাও তন্ময় হয়ে দাঁড়িয়েছিল । আমি ভাবছিলাম সঙ্গীতের স্বরগ্রামের কথা । 'গা' এসেছে ছাগলের ডাক থেকে । গান এবং কবিতার পাশাপাশি চলে জমিয়ে আড্ডা । এরপর সবাই মিলে বেরুলাম ঘুরতে । মাঠে ধান নেই । আখের ক্ষেত । রবি ফসলের জন্য মাঠ তৈরি হচ্ছে । কাঁটাতারের বেড়া । বর্ডার । নো-ম্যান্স ল্যান্ড । সেখানে কাঁঠাল বাগান । অল্পদূরে বাংলাদেশের মাটিতে একটি স্কুল । আমাদের ত্রিপুরার মতো ঘরের গঠনশৈলী । আমাদের ত্রিপুরার বিল্ডিং এর মত চাল । বিএসএফের টহল । বর্ডার রোড । রাস্তার অবস্থা খারাপ । আমাদের দেওয়া করের টাকায় তৈরি । দুর্নীতি ও সামাজিক অবক্ষয় । রাবার বাগান ত্রিপুরা গ্রামীণ প্রকৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গেছে। এখানেও রাবার বাগান নজরে আসে । ঝরা পাতা । প্রচুর ফটোসেশন হলো । ভাঁট ফুলের ঝোপ দেখে মিঠুদা ও সুভাষদা মিলে গান ধরলেন, "বসন্তে ফুল গাঁথল আমার জয়ের মালা। বইল প্রাণে দখিন হাওয়া আগুন-জ্বালা....॥" আমার মনে একটিই গান আসছিল, "ঝরা পাতা গো, আমি তোমারি দলে। অনেক হাসি অনেক অশ্রুজলে, ফাগুন দিল বিদায়মন্ত্র আমার ...।"
ফেরার পথে সবাই দরগায় গেলাম । পারমিতা ও আমি চাতালে বসে অনেকক্ষণ বসন্ত প্রকৃতি উপভোগ করলাম । দুপুরের খাবারের ডাক এলো । এলাহি আয়োজন । ভাত, ডাল, সিদল চাটনি, মাছ ভাজা, মাছের কালিয়া, ডিমের কষা, টম্যাটোর চাটনি, পাপড়, স্যালাড এবং আরো কিছু আইটেম । আমি ব্যুফেতে খেলাম। পারমিতা মাঝে মাঝে এসে পরিবেশন করলো । বাতাসে তোড়ো সবকিছু উল্টে যাওয়ার অবস্থা। খাওয়ার পর চললো স্মৃতি রোমন্থনের পালা । অন্য ধারার গল্প । দেবানন্দদার স্টক আনলিমিটেড । বিমলেন্দ্রদা আমাদের মধ্যে সবকিছুর বিচারে টলেস্ট । বয়স, উচ্চতা এবং খ্যাতির নিরিখে । সঞ্জয়দা, মিঠুদা, অলাকানন্দাদি, কাকলিদি স্বমহিমায় বিরাজমান ছিলেন । তুলনায় সুভাষদা একটু ফিকে ছিলেন । অসুস্থ বোধ করছিলেন । ওখানে থাকতে থাকতেই সঞ্জয়দা জনালেন তাঁর প্রযোজিত ডকুমেন্টারি ছবি 'দীপশিখার বিড়ম্বনা' রাষ্ট্রীয় মানবাধিকার কমিশন আয়োজিত প্রতিযোগিতায় ১৩৯ ছবির মধ্যে পঞ্চম হয়েছে । আমরাও সেই আনন্দের ভাগীদার হলাম । দেবানন্দদা জানালেন আমার লেখা বই 'ওই উজ্জ্বল দিন' এবারের আগরতলা বইমেলায় বেস্ট-সেলার ছিল । বিমলেন্দুদা তিতাস পারের ছেলে । ছোটবেলা থেকেই নৌকা বাইতে ওস্তাদ । যেন রক্তে মিশে গেছে । দিঘিতে একটি ডিঙ্গি নৌকা ছিল । সেটি চালিয়ে সবাইকে আনন্দ দিলেন । সওয়ারি ছিল আবেরী, পারমিতা, মিঠুদা এবং আরো এক দুইজন। তিনি কব্জির মোচরে বৈঠা চালিয়ে নৌকা চালাচ্ছিলেন । যেন একটা ধ্রুপদী ঘরানা । অবলীলায় নৌকা চলছিল ।
![](https://www.tripurainfo.com/BanglaArticle/Photos/Tripurainfo-Pix-Eman-Jadi-Hoto-Arindam-Nath-29-03-2024-4.jpg)
ভাগলপুর নামের ব্যুৎপত্তি নিয়ে মনে প্রশ্ন ছিল । দিঘিটি কবে খনন করা হয়েছে তাও জানা হয়নি ।একটি জঙ্গলাকীর্ণ জায়গায় গাইড কিছু ইট দেখিয়েছিল । বর্গাকৃতির । আট ইঞ্চি বাই আট ইঞ্চি । দুই ইঞ্চির মতো উচ্চতা । জঙ্গলের নিচে কোন পুরনো স্ট্রাকচার থাকবে । আমি আমার বন্ধুর শরণাপন্ন হলাম । শ্রুতিকর্ণ । আমার লেখা বই 'আমি কান পেতে রই'-য়ে বিস্তৃত উল্লেখ করেছি । সে-নাকি ইট, বালি, পাথর, গাছপালা ইত্যাদির ভাষা বুঝতে পারে । বার্তালাপ করতে পারে । তার সঙ্গে আমার কোনদিন সামনাসামনি কথা হয়নি । ফেসবুকের মাধ্যমেই যোগাযোগ হয় । দিন দুয়েক পর সে একটি উত্তর পাঠিয়েছে । তবে এরমধ্যে খাদ থাকতে পারে । আপনারা এই ব্যাখ্যা নিজ দায়িত্বে গ্রহণ করবেন।
![](https://www.tripurainfo.com/BanglaArticle/Photos/Tripurainfo-Pix-Eman-Jadi-Hoto-Arindam-Nath-29-03-2024-5.jpg)
মহারাজা কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য ১৮৩০ থেকে ১৮৪৯ সাল পর্যন্ত ত্রিপুরায় রাজত্ব করেন । তিনি ছিলেন ভীষণ রকম অমিতব্যয়ী । তাঁর খাই মেটানোর জন্য রাজস্ব আদায়ে জুলুম চলতো । সঙ্গে তিনি প্রচুর ঋণও করেছিলেন । তিনি যখন মারা যান প্রচুর টাকা রাজকোষে ঋণ ছিল । এগারো লক্ষেরও বেশি । পরবর্তী রাজা ঈশাণচন্দ্র এই ঋণ মেটানোর জন্য অনেক কষ্ট করেন । আরো একটি কারণ ছিল এই ঋণ বৃদ্ধির পেছনে । মহারাজা কৃষ্ণকিশোরের উজির ছিলেন দুর্গামনি । তিনি দেখলেন রাজকোষ প্রায় খালি হয়ে যাচ্ছে । তার জন্য কিছু থাকবে না । শেষ সঞ্চিত অর্থ নিয়ে পালিয়ে যান । সিঙ্গারবিল এলাকায় কোথাও আত্মগোপন করেন । সেই থেকে স্থানটির নাম ভাগলপুর।
দিঘিটি সম্ভবতঃ উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে খনন হয় । গড় কথার দুইটি অর্থ। দুর্গ এবং গর্ত । অনেকে দুর্গম স্থানকেও গড় বলে। যেমন উগ্রপন্থীদের গড়। রাজন্যা আমলে যুদ্ধবিগ্রহ লেগে থাকতো । তাই রাজারা সৈন্যদল রাখতেন । দুর্গ বানাতেন । এইগুলি পাথর, বালি, কাদামাটি, পোড়ামাটি, বাঁশ প্রভৃতি দিয়ে তৈরি হতো । ত্রিপুরায় পর্যাপ্ত পাথর নেই । তাই ইট বানানো হত । প্রতিটি কেল্লার ঘরের সঙ্গে একটি জলের উৎস থাকতো । বিশেষকরে এই দীঘি থেকে মাটি তুলে ইট বানানো হতো । এমনি একটি গড় নরসিংহগড় । এখানে মহারাজার সুরক্ষিত সেনানিবাস ছিল । ক্যান্টনমেন্ট । রাজপরিবারের অনেক পুরুষ এই সেনাদলে যোগ দিতেন । বীরচন্দ্র মাণিক্যের সময় কর্ণেল মহিম ঠাকুর একটি উদাহরণ । আরেকজন ছিলেন ক্যাপ্টেন যোগেন্দ্র দেববর্মা । নরসিংহ ছিলেন বীরচন্দ্র মাণিক্যের নাতি । মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্যের ছেলে । নরসিংহের নেতৃত্বে এখানে একটি গড় বা দুর্গ গড়ে উঠেছিল । সেই দুর্গ গড়তে দিঘি খনন করা হয় । আর তা সম্ভবতঃ হয়েছিল উনবিংশ শতকের উষালগ্নে।