২৬ শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার দিন
প্রদীপ চক্রবর্তী
হঠাৎ করেই পুলিশ ওয়ারলেসে ভেসে আসে সেই রাশভারী কন্ঠস্বর। "This may be last message to you from today Bangladesh is independent "".জহুর আহমেদ চৌধুরী এই বার্তা পেলেন।আর সেই বার্তা পাঠিয়েছেন বাংলার বীর সন্তান শেখ মুজিবুর রহমান। যেদিন বার্তা পাঠানো হয়েছিল সেদিনটি ছিল ২৬ শে মার্চ ১৯৭১। জহুর আহমেদ চৌধুরী ছিলেন ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলসে। সংক্ষেপে ইপিআর।এই বার্তা ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা। অর্থাৎ এই মুহূর্ত থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।
গোটা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ল এই বার্তা।তৎপরতা শুরু হলো চট্টগ্রাম থেকে সিলেট,ঢাকা থেকে রাজশাহী, কুমিল্লা,ময়য়নসিং।৪ঠা এপ্রিল ১৯৭১ সিলেটের তেলিয়াপাড়া চা বাগানে এম এ জি ওসমানী র নেতৃত্বে বসে গুরুত্বপূর্ণ সভা। সেই সভায় বক্তব্য রাখেন ওসমানী সহ আরো দুজন। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে গঠন করা হয় মুক্তিফৌজ।মোট ৫০০০ সামরিক এবং ৮০০০ বেসামরিক মুক্তি ফৌজে যোগ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন।বিস্তর আলোচনার পর অবশেষে গঠন করা হয় মুক্তিফৌজ। পরবর্তী সময়ে মুক্তিফৌজ, মুক্তি বাহিনী নামে শুরু করে রনাঙ্গনের প্রাথমিক প্রস্তুতি। খুব দ্রুত চলতে থাকে প্রস্তুতি।অনেকটাই গেরিলা কায়দায়। চারিদিকে শুধু প্রস্তুতি আর প্রস্তুতি। ছোটাছুটি।কারো মুখে রা নেই।নীরবে কাজ। দেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম।একই কম বড় কথা।
গঠন করা হয়ে গেল মুক্তি যুদ্ধের কমান্ড।এর সর্বাধিনায়ক হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। সহকারী সৈয়দ নজরুল ইসলাম,তাজ উদ্দিন আহমেদ এবং এম এজি ওসমানী।ওসমানী রনাঙ্গনকে দুটি ভাগে ভাগ করে নেয়। কর্নেল আব্দুর রব এবং এ কে খন্দকার।আব্দুর রব চীফ অব স্টাফ উপাধি । কর্নেল আব্দুর রব র উপর ন্যস্ত করা হয় দুটি বাহিনী।এর মধ্যে একটি নিয়মিত এবং অপরটি সেক্টর বাহিনী।বৃগেড ফোর্স ছিল তিনটি। সেগুলো হল জেড ফোর্স,এসফোর্স ও কে ফোর্স। জিয়াউর রহমান জেড ফোর্সের নেতৃত্বে ছিলেন।শফিউল্লা কে ফোর্স ,।
১-৬সেক্টরের দায়িত্বে আব্দুর রব। খন্দকার ছিলেন ৭-১১ সেক্টরের।এর মধ্যে ১১ সেক্টর ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। কেননা নৌবাহিনী ছিল এর অন্তর্ভুক্ত। বাকী গুলো অনিয়মিত।মেহেরপুরে হয় অস্হায়ী সরকার।১৯৭১ র ১০ ই এপ্রিল গঠন করা হয় ১ম সরকার।ওই সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা মুক্তি যুদ্ধের সুতিকাগার।বিশদভাবে বলতে গেলে১৭ ই এপ্রিল ১৯৭১মেহেরপুর জেলার মুজিবনগর, তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরে মহকুমা্র বৈদ্যনাথতলা ইউনিয়নের ভবের পাড়া গ্রামে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণ করে। বৈদ্যনাথতলা ইউনিয়নের ভবেরপাড়া গ্রাম দুটিকে
একত্র করে নুতন নামকরণ করা হয়।নাম দেয়া হয় মুজিবনগর।শপথ গ্রহণের সময় ১২৭ জন সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। কাকভোরে কলকাতা প্রেসক্লাব ও গ্র্যান্ডহোটেল থেকে সাংবাদিকদের এখানে নিয়ে আসা হয়। এদের সামনে রেখে স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রাশুরু হয়।একে একে শপথ বাক্য পাঠ করানো হয়।শপথ বাক্য পাঠ করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম,এম এজি ওসমানী প্রমুখ।ইপিআর, আনসার বাহিনীর দুই প্লাটুন গার্ড অব অনার প্রদান করে।এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের মাত্র ২ ঘন্টা পর পাকিস্তান বিমান বাহিনীর বোমারু বিমান বোমা হামলা চালিয়ে মেহেরপুর দখল করে নেয়। প্রথমেই ধাক্কা খায় নব গঠিত সরকার।
এই ধরনের আক্রমন ছিল অভাবিত। কেননা এরা তো ব্যস্ত ছিল সরকার গঠন এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়ে। বোমা হামলা হবে এরা তো ভাবতেই পারেনি।যদিও প্রায় দিন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাক বাহিনীর অবিরাম বোমা আক্রমন ছিল। বোমারু বিমান গুলো মুহুর্মুহু ঝাঁকে ঝাঁকে আক্রমন শানাচ্ছিল। দিনরাত ছিল পাক বাহিনীর অবিরাম আক্রমন।এই আক্রমনে সাধারণ মানুষ জবুথবু।কখন কি হয় এই আক্রমনে জনগন আতংকিত। আবার জিনিসপত্র গোছানো ছিল বড় কাজ।
২৫শে মার্চ ১৯৭১ বাংলাদেশে পাক বাহিনী নির্বিচারে গনহত্যা শুরু করে। গনহত্যার বিভীষিকা ক্রমশঃ উদ্বেগজনক হারে বাড়তেই থাকে। এই গনহত্যা থেকে কেউ বাদ যায়নি। মায়ের কোলের শিশু কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয় বর্বর পাক সেনারা।
ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়।একদিকে আগুনের লেলিহান শিখা অন্যদিকে অত্যাচার, গনধর্ষন। সে এক অভাবনীয় গনহত্যা রোধে আওয়ামী লীগের তৎকালীন নেতৃবৃন্দ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন।করতে থাকেন শলাপরামর্শ। কিভাবে গনহত্যা বন্ধ করা যায়?এদের মধ্যে একটি অংশ সীমান্ত অতিক্রম করে এদিক সেদিক করে ত্রিপুরায় চলে আসেন।এরা নানা স্হানে আশ্রয় নেন।শুরু করেন শলাপরামর্শ। কিভাবে গনহত্যা বন্ধ করা যায়?
গনহত্যা ও অত্যাচার রোধের একমাত্র পথ হল প্রতিরোধ ও পাল্টা আক্রমন। প্রতিরোধের উপায় গ্রাম শহর সর্বত্র দা,কুড়োল বানানোর ধুম পড়ে যায়।শেখ মুজিব ই ডাক দিয়ে ছিলেন যার কাছে যা আছে তা দিয়ে এদের প্রতিরোধ করুন।দা, কুড়োল,খুন্তি নিয়ে এদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ুন। সেই ডাকে মা বোনেরা ঘড় ছেড়ে বেড়িয়ে আসেন।এরা খাল,বিল, নদীতে দূরন্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে থাকেন।
এরাই শেখ মুজিব সহ অন্যদের এপারে এনেছিলেন। দিয়েছিলেন আশ্রয়।অন্ন,বস্ত্র ,মাথা গোঁজার ঠাঁই। এখন তো সব মিলে মিশে একাকার। ওদিকে শুরু হয়েছিল বাংলার মুক্তি সংগ্রাম। দূরদর্শী ইন্দিরা বুঝতে পেরেছিলেন ওদের দুর্দিনে আমাদের পাশে দাড়াতে হবে। ওদের মন জয় করতে হবে।হল ও তাই।।বাংলার মক্তিযুদ্রের সমর্থন আদায়ে ইন্দিরা বিশ্বের নানা প্রান্তের দেশ ঘুরেছেন।সমর্থন আদায় করেছেন। এতো বিশাল সাফল্য।এই সাফল্য এল শুধু উনার ঐকান্তিক প্রয়াসের জন্য।ওপারে মুক্তি সংগ্রামে ময়দানে ভারতীয় ফৌজ অন্যদিকে বাংলাদেশের লড়াকুদের মনোবল বাড়াতে ইন্দিরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানলেন।এই স্বীকৃতি রনাঙ্গনে তীব্রতা এনে দিল। ওপার বাংলায় মরনপন লড়াই আর এদিকে ইন্দিরা ত্রিপুরা কে পূনরাজ্যে উওরন করলেন।
তখন লড়াই র অভিমুখ ত্রিপুরা আর বাংলাদেশ।১৬ লাখ বিপন্নদের মুখে অন্ন তুলে দেয়া। রাতারাতি শিবির উঠে গেল। ইন্দিরা ছুটে এলেন শরনার্থীদের অবস্থা চাক্ষুষ করতে। গেলেন আমতলী,ক্যাম্পএর বাজার শিবিরে।দেখলেন, ওদের সাথে কথা বললেন। ফিরে গেলেন দিল্লী।।আসতে শুরু হল ত্রান, শিশুখাদ্য,দুধ। চিকিৎসা শিবির বসে গেল। আকাশে চক্কর কাটছে ভারতীয় বায়ুসেনার বিমান।দিনরাত ২৪ ঘন্টা।খোয়াই বিমান ঘাঁটিতে একেরপর এক যুদ্ধ বিমান। বিমানের ভেতর থেকে বেড়িয়ে আসছে ইয়া বড় বড় প্লেন। সামরিক প্লেন ২/৩ টি করে। বিমান থামতেই সেনার দল ছুটে গেল চকবের, মরা নদী।এসব আমার দেখা।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মিত্র বাহিনীর ভূমিকা রাখতে আমাদের হারাতে হয়েছিল বহু অফিসার ও সেনাকে। পশ্চিম ও পূর্ব রনাঙ্গনে ৩৬৩০ জন ভারতীয় সেনা প্রান হারান।আহত হয়েছিলেন প্রায় ১০০০০ সেনা। নিখোঁজ রয়েছেন অসংখ্য।এতথ্য সরকারী নয়।নানা তথ্যে প্রাপ্ত।তবে এটা ঘটনা ভারতের সাহায্য ছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশ হয়তো আজও হতো কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।