।। অন্তবিহীন এক লুপ ।।
।। অন্তবিহীন এক লুপ ।।
মাস দুয়েক আগের কথা । একদিন সন্ধ্যা রাত্রিতে এক বয়স্কা মহিলা সায়ন্তনকে ফোন করলেন । বেশ ভারিক্কি গলা । তার পরিচিত এক অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপকের নাম নিয়ে বললেন, তাঁর থেকে সায়ন্তনের ফোন নাম্বার সংগ্রহ করেছেন । তিনি নিজের নাম বললেন । পরিচয় দিলেন । একটি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন । এখন তিনি একটি এনজিও চালান । ত্রিপুরায় মাদক বা ড্রাগসের বিরুদ্ধে সচেতনতা জাগ্রত করায় ন্যস্ত । দিন কয়েক পরে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নেশা বিরোধী শিবির করবেন । তাকে সেই অনুষ্ঠানে থাকতে অনুরোধ করলেন । সে স্বাস্থ্যের কারণ দেখিয়ে অব্যাহতি চাইল । আরও বললো যে শিক্ষিত মানুষের সঙ্গ আজকাল সে উপভোগ করে না । কেমন যেন পীড়া দেয় । দম বন্ধ হয়ে আসে । লোকগুলি যেন মুখোশধারী । আর মুখোশের আড়ালের কদর্য চেহারা নজরে আসে । সে আরও অসুস্থ বোধ করে । আবেগের আতিশয্যে সে আরও দুই একটি কথা বলে । সবশেষে মাপও চেয়ে নেয় । তার মনে হয় যে একজন অপরিচিতা ভদ্রমহিলার সঙ্গে ফোনে এভাবে কথা বলা ঠিক হয়নি । দিনকয়েক পরের কথা । সে ভদ্রমহিলার নাম ভুলে গিয়েছিল । আগরতলা বইমেলায় তাঁর সঙ্গে দেখা । বই প্রকাশের একটি অনুষ্ঠানে । নিজে থেকেই তিনি পরিচয় দিলেন । অন্যথায় চিনতে পারত না । সায়ন্তনের পেশা ভিন্ন ছিল । সে পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত আমলা ।
দুজনে কুশল বিনিময় করে সেদিন বিদায় নেন । রাত্রিতে ঘরে ফিরে এসে প্রথম যেদিন ভদ্রমহিলা ফোন করেছিলেন সেদিনের কথা ভাবে । তার মত স্ট্রং লাইকি এবং ডিস লাইকিং স্বভাবের লোকেরা হয়তো এমনি আবেগতাড়িত হয় । সেদিন সকালের পত্রিকার একটি খবর দেখে তার মন খারাপ ছিল । আইনজীবী মিলন অধিকারী একটি প্রতিষ্ঠানের ভাইস চেয়ারম্যান হয়েছেন । সরকারি প্রতিষ্ঠান । সাংবিধানিক পদ । ভদ্রলোকের সঙ্গে সায়ন্তনের প্রত্যক্ষ পরিচয় নেই ।
কয়েক বছর আগের কথা । সে তখন রাজ্য স্তরের একজন পুলিশ অফিসার । আগরতলা শহরতলীর একটি থানার নাইট ডিউটি পার্টি মাদকসহ একটি গাড়ি আটক করে । ছোট গাড়ি । এসইউভি । সঙ্গে তিনজন পাচারকারী । তাৎক্ষণিক জিজ্ঞাসাবাদে পুশিশ মাদকের একটি গুদামের সন্ধান পায় । ঘটনাস্থলের খুব কাছে । সুতরাং সময় নষ্ট না করে পুলিশে দলটি সেখানে রেইড করে । রাতের অন্ধকারে কিছু লোক পালিয়ে যায় । তখন সেখানে একটি ছোট গাড়ি দাঁড়ানো ছিল । গাড়িতে বেশ কিছু নেশা দ্রব্য বোঝাই ছিল । তারা অতিরিক্ত ফোর্সের জন্য এতেলা পাঠায় । খবর পেয়ে স্থানীয় এসডিপিও সাহেব ফোর্স নিয়ে ছুটে আসে । গুদামটিতে তল্লাশি চালানো হয় । গুদামটি ছিল একটি গৃহস্থ বাড়িতে । ভাড়া ঘর । গুদাম থেকেও প্রচুর মাল বাজেয়াপ্ত হয় । সবমিলিয়ে বিশাল পরিমাণ নেশা দ্রব্য । বাড়ি মালিক একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক । তিনি বাড়িতেই ছিলেন । তাঁকে এসডিপিও সাহেব জিজ্ঞাসাবাদ করেন । যথেষ্ট ভদ্রতার সঙ্গে । ঘটনার আকস্মিকতায় ভদ্রলোক তখনও হতবম্ব!
একটি ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি ঘরটি ভাড়া নিয়েছিল । তাদের মাল লোডিং আনলোডিং হত । এর আড়ালে যে ড্রাগসের ব্যবসা চলে জানতেন না । তিনি ভাড়ার চুক্তিপত্র দেখালেন । নোটারি কোর্টে রেজিস্ট্রেশন করা । ভাড়া নিয়েছে জনৈক হরিপদ ঘোষ । সে প্রথম দিন এসেছিল । সঙ্গে সন্দীপ দাস । ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির কর্মচারী । এজেন্সির মালিক জয়দেব সাহা । প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী । তিনি সব দোষ সন্দীপ দাসের উপর চাপিয়ে দিলেন । বললেন যে সন্দীপ তাঁর কর্মচারী । তাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন রেলস্টেশনের কাছাকাছি একটি গুদাম ভাড়া করার জন্য । সেই অনুযায়ী সে এই গুদামটি ভাড়া করে । তিনি কয়েকবার এসে ভিজিট করে গেছেন । বেআইনি কোন কিছু মজুদ দেখেননি । তাঁর এতদিনের অর্জিত সুনাম সন্দীপ মুহূর্তে ধূলায় মিশিয়ে দিল । তিনি পুলিশকে অনুরোধ করলেন যে সন্দীপকে আটক করে শক্ত সাজার ব্যবস্থা করার জন্য ।
সন্দীপ যে ঘটনাস্থলে ছিল বাড়ি মালিক কনফার্ম করলেন । কারণ সন্ধ্যার পর তাকে তিনি দেখেছেন । এনডিপিএস আইনে একটি কেইস নেওয়া হল । বাজেয়াপ্ত নেশাদ্রব্য প্যাকিং করে এবং ধৃত আসামিদেরকে কোর্টে চালান দিতে দিতে তদন্তকারী অফিসারের সারাদিন চলে গেল । বিকেলের পর সন্দীপের তল্লাশিতে বেরিয়ে দেখা গেল যে সে সেদিনের সকালের বিমানে কলকাতা পাড়ি দিয়েছে । তার মোবাইল সুইচড অফ মিলল । হরিপদ ঘোষের ঠিকানায় সেই নামে কাউকে পাওয়া গেল না । ধৃত তিনজন আসামী পুলিশ হেফাজতে এল । সায়ন্তন এসডিপিওকে নিয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করল । তাদের তিনজনেরই বাড়ি সীমান্ত লাগুয়া অন্য একটি জেলায় । সবাই মূলত ছোটগাড়ির ড্রাইভার । নেশাসামগ্রীর লোড টানলে কয়েকগুন বেশি মজুরি মেলে । তাদের দায়িত্ব আগরতলা থেকে মাল সীমান্ত লাগুয়া নির্দিষ্ট কিছু স্থানে পৌঁছে দেওয়া । কাজগুলি দিনেরাত্রে সবসময় হয় । তাদের দলের লোক থাকে পুলিশের গতিবিধির উপর নজর রাখার জন্য । তারা গ্রিন সিগনাল দিলে মাল নিয়ে টান দেয় । আগরতলায় স্টক এসে পৌঁছালে খবর আসে । তখন তারা গাড়ি নিয়ে যায় । সীমান্ত এলাকায় মালগুলি রিসিভ করার জন্য তাদের দলের অন্য লোক থাকে । সেদিন তাদের দ্বিতীয় গাড়িটির লোড নিতে দেরি হচ্ছিল । কিছুটা রাস্তা গিয়ে তারা ফিরে আসে । আর তখনই আটক হয় । কিছু লোকের নাম বলে । নেতার নামও বলে । তবে তাদের মোবাইল ঘেঁটে প্রাথমিকভাবে এর সত্যতা খুব একটা মেলে না । মোবাইলগুলি ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয় । রিপোর্ট যখন আসবে তখন তারা জেল হাজতে থাকবে । এটাই যেন দস্তুর ।প্রচুর বেকলগ । লোকগুলি যেন অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে চলছিল । শেখানো বুলি আওড়াচ্ছিল ।
এই ঘটনার কিছুদিনের মধ্যে সায়ন্তন অন্যত্র বদলি হয়ে যায় । আবার যখন আগরতলা সদরে পোস্টিং হয়ে এলো তখন সে অপেক্ষকৃত বড় দায়িত্বে । একদিন একটি রাজনৈতিক মামলায় জয়দেব সাহার জড়িত থাকার প্রমাণ মেলে । তখন সেই জেলার এসপি বদলে গেছে । সংশ্লিষ্ট থানার ওসি এবং মহকুমার এসডিপিও পাল্টে গেছে । সেই ড্রাগস এর মামলার তারিখটি সায়ন্তনের মনে ছিল । এসপিকে সে মামলাটির বর্তমান অবস্থা জানাতে বলল । খবর এলো যে কেইসটি তখনও তদন্তাধীন । শুধু মামলার তদন্তকরী অফিসার বদলে গেছে । ইতিমধ্যে চতুর্থ অফিসার তদন্ত করছে । সন্দীপ দাস আটক হয়েছিল । কলকাতা থেকে । চার মাস জেলে কাটিয়ে সে এখন জামিনে মুক্ত ।
কি মনে হওয়ায় সায়ন্তন এসপিকে বলল তদন্তকারী অফিসারকে কেইস ডকেটসহ তার কাছে পাঠাতে । সঙ্গে জামিনে মুক্ত সন্দীপকে নিয়ে আসতে । সে তাদের সাথে কথা বলবে । তখন তদন্তকারী অফিসার কমল সেন । সায়ন্তনের পরিচিত । সেদিন সন্ধ্যায় সে সন্দীপকে নিয়ে তার রুমে হাজির হয় । সন্দীপকে সে আগে দেখেনি । পশ্চিমবঙ্গের লোক । তার সামনে সন্দীপ কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল । বলল যে তার দুইটি কিডনি খারাপ হয়ে গেছে । সে একটু ধাতস্থ হলে অনেকটা সময় তার সঙ্গে কথা বলল । সায়ন্তন বুঝতে পারল যে ড্রাগসের ব্যবসার অরিজিনাল বস জয়দেব সাহা । সে ইতিমধ্যে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় চলে গেছে । তার আর্থিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক উন্নতিও হয়েছে । ব্লক পর্যায়ের নেতা । সন্দীপ বলল যে হরিপদ ঘোষ বলে মূলত কোন লোক নেই । কোর্টে দাখিল করা কাগজপত্র
জাল । জয়দেব সাহা সন্দীপ দাসের মামলার খরচপাতি যোগায় । উকিলের ফিস দেয় । সে যখন জেলে ছিল তার পরিবারকে দেখে রেখেছে । যে লোকটি হরিপদ ঘোষ সেজে নোটারি কোর্টে গিয়েছিল তাকে সন্দীপ চেন । লোকটি জয়দেব সাহারও পরিচিত । কোন অজ্ঞাত কারণে তদন্তকারী অফিসাররা এই নিয়ে অগ্রসর হয়নি । সেদিন রাত্রিতেই লোকটিকে আটক করা হয় । তার প্রকৃত নাম রসময় বণিক ।এবার সায়ন্তন সেই চুক্তিপত্রটি খুঁটিয়ে দেখে । সেখানে একজন ব্যবহারজীবী রসময় বণিককে হরিপদ ঘোষ নামে সনাক্ত করেছিলেন । সেই উকিলবাবু ছিলেন মিলন অধিকারী । সরকারি উকিল । পরদিন সায়ন্তনের কাছে জেলার এসপি এবং থানার ওসি দেখা করতে আসে । তারা রাজনৈতিক প্রভুদের কাছ থেকে আদেশ পেয়েছিল । মামলাটি তদন্ত ধীরে করার জন্য । সায়ন্তন তার উপরের অফিসারের সঙ্গে কথা বলে । তিনিও এসপিকে সমর্থন করেন । জয়দেবকে গ্রেপ্তার করে সেই শ্মশানের নীরবতা ভঙ্গ করা উচিত হবে না ।
হরিপদ ঘোষ ওরফে রসময় বণিক পুলিশ রিমান্ডে আসে । নামকাওয়স্তে জিজ্ঞাসাবাদ হয় । মাসখানেক জেল হেফাজতে থাকে । একদিন এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সায়ন্তনকে ফোন করেন । রাজ্য পর্যায়ের নেতা । তার সঙ্গে ভদ্রলোকের সম্পর্ক ভাইয়ের মত । তিনি রসময় বণিকের প্রসঙ্গ এনে বলেন যে তার স্ত্রী খুব অসুস্থ । সে এখন ভালো হয়ে গেছে । ইত্যাদি ইত্যাদি । সেই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আরো দুই একজনের জন্য ব্যাট ধরেছিলেন । যদিও সায়ন্তন জানে এর পেছনে টাকার লেনদেন চলত । বছরে তার পরিমান তার সারাজীবনের জিপিএফের সঞ্চয় থেকেও বেশি হবে ।সে তখন অবসরের দোরগোড়ায় । কাজের প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। এক সময় অবসরে চলে আসে । পত্রপত্রিকায় প্রায় প্রতিদিনই নেশাদ্রব্য বাজেয়াপ্ত হওয়ার খবর দেখে । জয়দেব সাহা, রসময় বণিকদের নামও দেখে । তাদের মালও আটক হয় । তারা গ্রেপ্তার হয় না । কারণ তারা রাজ্যের বাইরে । ড্রাগসের নেক্সাস চালায় । অন্তবিহীন একটি লুপ । সায়ন্তন ভাবুক হয়ে পড়ে । কণিকা ব্যানার্জীর কণ্ঠে রবি ঠাকুরের একটি গান শুনে, "শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে? আঘাত হয়ে দেখা দিল, আগুন হয়ে জ্বলবে ।।"
তার অশান্ত মন কিছুটা শান্ত হয় ।
(সব চরিত্র কাল্পনিক । কোন বাস্তব চরিত্রের সঙ্গে মিল পেলে, নেহাতই কাকতালীয় মানবেন।