রানিকে নিয়ে রাজার অভিনব সেলফি

পান্নালাল রায়

ত্রিপুরার অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালের মাণিক্য রাজাদের মধ্যে নানা কারণে উজ্জ্বল হয়ে আছে বীরচন্দ্রের নাম।মূলত এই রাজার হাত ধরেই আধুনিকতার পথে যাত্রা শুরু হয়েছিল ত্রিপুরার। সাহিত্য-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি তিনি নিজেও ছিলেন একজন কবি ও শিল্পী।এমনকি ভারতবর্ষে আলোকচিত্র শিল্পের পুরোধাদের একজন হলেন ত্রিপুরার এই রাজা।বীরচন্দ্র ছিলেন সেযুগের একজন সুবিখ্যাত বৈষ্ণব কবি।আবার তিনি ছিলেন একজন নিপুণ চিত্রকর,আলোকচিত্রী।এমনকি অনেকের মতে সেলফি তোলার প্রথম কৃতিত্বও তাঁর। কবি প্রতিভার জন্য তরুণ বয়সের রবীন্দ্রনাথকে প্রথম সম্মান জানিয়েছিলেন ত্রিপুরার এই রাজা।

১৮৬২ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে রাজা ঈশানচন্দ্রের মৃত্যুর পর এক বিতর্কিত রোবকারী অনুসারে প্রয়াত রাজার ভাই বীরচন্দ্র রাজ্যভার গ্রহণ করেন। মৃত্যুর আগের দিন রাজা ঈশানচন্দ্র যুবরাজ পদে ভাই বীরচন্দ্র এবং বড়ঠাকুর পদে প্রথম পুত্র ব্রজেন্দ্র চন্দ্র ও দ্বিতীয় পুত্র নবদ্বীপ চন্দ্রকে কর্তা পদে নিয়োগ করেছেন বলে সেই রোবকারীতে উল্লেখ ছিল।কুলাচার অনুসারে রাজার মৃত্যুর পর যুবরাজই রাজা হয়ে থাকেন।তাই ঈশানচন্দ্রের মৃত্যুর পর স্বাভাবিক ভাবেই রাজ্যভার গ্ৰহণ করলেন বীরচন্দ্র। কিন্তু এই রোবকারী নিয়ে রাজার অপর দুই ভাই চক্রধ্বজ ও নীলকৃষ্ণ সন্দেহ প্রকাশ করেন। সিংহাসন নিয়ে তারপর শুরু হয় মামলা মোকদ্দমা।সে এক দীর্ঘ অধ্যায়।ইংরেজ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে অবশ্য মামলা চলাকালীন সময়ে ডিফেক্টো রাজা হিসেবে বহাল ছিলেন বীরচন্দ্র। দীর্ঘদিন সেই মামলা চলার পর শেষপর্যন্ত জয়লাভ করে সিংহাসনে পোক্ত হয়ে বসেন তিনি।বীরচন্দ্রের দীর্ঘ রাজত্বকাল(১৮৬২-৯৬ খ্রিঃ) নানা ঘটনায় পরিপূর্ণ। সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে রাজপরিবারে দ্বন্দ্ব, মামলা মোকদ্দমা,কুকি তান্ডব, জমাতিয়া বিদ্রোহ ইত্যাদির পাশাপাশি রাজার উপর ছিল ইংরেজদের প্রবল চাপ অর্থাৎ রাজার ক্ষমতা খর্ব করার চেষ্টা।ইংরেজ আমলে পার্বত্য ত্রিপুরার স্বাধীনতা ছিল কিছুটা প্রশ্ন কন্টকিত। কখনও পার্বত্য ত্রিপুরা তারা খাস দখল করার জন্য উদ্যোগী হয়েছে। কখনও ত্রিপুরার রাজাদের পত্রবাণে জর্জরিত করেছে তারা।কুকি বিরোধী অভিযানের সূত্র ধরে ত্রিপুরার পূর্ব সীমান্তের বিস্তীর্ণ এলাকা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে স্হায়ী ভাবে।১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে বীরচন্দ্রের রাজত্বকালে পার্বত্য ত্রিপুরার জন্য একজন পলিটিক্যাল এজেন্ট নিযুক্ত করে ইংরেজ সরকার। ইংরেজ সরকারের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখার জন্যই যে পলিটিক্যাল এজেন্ট বসানো হয়েছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।বীরচন্দ্র কিন্তু ইংরেজদের এই উদ্যোগে মোটেই খুশি হতে পারেননি।তখন রাজাকে এটা বোঝানো হয়েছিল যে,এতে রাজার ক্ষমতা খর্ব হবেনা।রাজ্যের আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে পলিটিক্যাল এজেন্ট কোনও হস্তক্ষেপ করবেনা।কিন্তু শুরুতে ইংরেজ কর্তৃপক্ষ যাই বলুকনা কেন,পলিটিক্যাল এজেন্ট নিয়োগে যে রাজার অধিকার খর্ব হয়েছিল পরবর্তী সময়ের নানা ঘটনায় তার প্রমাণ পাওয়া গেছে।তবে ঐতিহাসিকদের কেউ কেউ বলেছেন,ইংরেজ কর্তৃপক্ষ পলিটিক্যাল এজেন্ট নিয়োগ করায় ত্রিপুরার সাধারণ প্রজাদের খুব উপকার হয়েছিল। পলিটিক্যাল এজেন্ট আসার পর প্রশাসনিক ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণের পাশাপাশি বিচার ব্যবস্থার সুযোগ সম্প্রসারিত হয়,গঠিত হয় বিচারাদালত।দেওয়ানী ও ফৌজদারি বিষয়ক সংক্ষিপ্ত নিয়মাবলী প্রণীত হয়।এর আগে ত্রিপুরায় লেখা আইন ছিলনা।ব্রিটিশ অনুকরণে রাজ্যে ধাপে ধাপে আবগারি বিভাগ,স্ট্যাম্প ও দলিল রেজিস্টারির নিয়ম প্রবর্তিত হয়।১৮৭১ সালে আগরতলা শহরে মিউনিসিপালিটি স্হাপিত হয়।দাতব্য চিকিৎসালয় স্হাপিত হয় ১৮৭৩ সালে।প্রথম পোস্ট অফিস স্হাপিত হয় ১৮৭৫ সালে।এই ভাবে বীরচন্দ্রের রাজত্বকালে আধুনিকতার পথে যাত্রা শুরু হয়েছিল ত্রিপুরার।

রাজত্বকালে ঘরে বাইরে নানা চাপের মধ্যে থাকলেও মহারাজা বীরচন্দ্র সাহিত্য-সংস্কৃতির অকৃপণ পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছেন।তিনি নিজেও এর চর্চা করেছেন।ভারতের তদানীন্তন বিখ্যাত সংগীত শিল্পীরা তাঁর দরবারে এসেছেন। রাজা ছিলেন সেযুগের একজন সুবিখ্যাত বৈষ্ণব কবি।রাজার রচিত ছয়টি কাব্যগ্ৰন্হের কথা জানা যায়।তরুণ কবি রবীন্দ্রনাথকে অভিনন্দন জানানোর সূত্রে বীরচন্দ্রের সময় থেকেই ত্রিপুরার রাজপরিবারের সঙ্গে কবির সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। রাজা একজন নিপুণ চিত্রকর ও কৃতী আলোকচিত্র শিল্পী ছিলেন।এদেশে ফটোগ্রাফি চর্চার পুরোধা ব্যক্তিত্বদের মধ্যেও তিনি ছিলেন একজন। বীরচন্দ্রের বিপুল কর্মকান্ড আমাদের বিস্ময়ের উদ্রেক করে।বৈষ্ণবভক্ত এই কবি রাজা বিবসনা রমণীর চিত্রাঙ্কন করেন,পরিচারিকা মহিলাদের ফটো তোলেন, আবার তন্ময় হয়ে যান ঝুলন উৎসবে।রাজার কঠোর সমালোচকও বলেছেন তিনি 'পানাদি দোষে বর্জিত'!সুরাপান,বাঈজী নাচ এসব থেকে দূরে ছিলেন মহারাজা।

এবার আসা যাক বীরচন্দ্রের ফটোগ্রাফি চর্চার বিষয়ে।কেউ কেউ বলেছেন, তৈলচিত্র অঙ্কনের সুবিধার জন্যই তিনি ফটোগ্রাফির দিকে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। আর সেই সূত্রেই ভারতীয় আলোকচিত্রের ইতিহাসের সঙ্গেও জড়িয়ে আছেন ত্রিপুরার এই রাজা।বীরচন্দ্র ফটোগ্রাফিক সোসাইটি অব ইন্ডিয়ার আজীবন সদস্য ছিলেন। ত্রিপুরায় তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ক্যামেরা ক্লাব।ফটোগ্রাফি চর্চা বৃদ্ধিতে রাজা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। প্রতিবছর রাজপ্রাসাদে এক আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করতেন তিনি।মহারাজা তাঁর রানি ও পুত্রদেরও ফটোগ্রাফি চর্চায় উৎসাহিত করতেন। বীরচন্দ্র যেন তাঁর সময়কাল থেকে অনেক এগিয়ে ছিলেন। ফটোগ্রাফি চর্চা তখনও এদেশে তেমন ব্যাপ্তি লাভ করেনি,কিন্তু বীরচন্দ্র প্রত্যন্ত এক রাজ্যে বসে চমকপ্রদ কাজ করেছেন।এমনকি,এদেশে প্রথম সেলফি তোলার কৃতিত্বও বীরচন্দ্রকে দেয়া হচ্ছে আজ।রানি মনমোহিনী দেবীর সঙ্গে রাজার বহুল প্রচারিত ছবিটি সেযুগের এক অভিনব কৌশলের সেলফি বলে উল্লেখ করা হচ্ছে।ক্যামেরার সঙ্গে যুক্ত একটি লম্বা তারের একদিকে শাটার লাগানো ছিল। অপরদিকে একটি লাঠিতে লাগানো লিভারের সাহায্যে রাজা নিজেই শাটার টেনে বিখ্যাত সেই ছবিটি তুলেছিলেন।ফটোগ্রাফি সংশ্লিষ্ট কারিগরী বিষয়ে তাঁর জানার বিপুল আগ্রহ ছিল।বিভিন্ন সময়ে তিনি এসব ব্যাপারে চিঠি লিখেছেন ফটোগ্রাফিক সোসাইটির কাছে।অবহিত হয়েছেন নতুন নতুন পন্হা পদ্ধতি সম্পর্কে।বীরচন্দ্রের মৃত্যুর কয়েক বছর পর ফটোগ্রাফিক সোসাইটির জার্ণালে তাঁকে নিয়ে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ফটোগ্রাফি চর্চার বিষয়ে তাঁর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হয়।এতে উল্লেখ করা হয় যে,ভারতীয় শাসকবর্গের মধ্যে তিনি প্রথম ফটোগ্রাফি চর্চা শুরু করেছিলেন। রাজা তাঁর সচিবের মাধ্যমে ফটোগ্রাফি সম্বন্ধে বিদেশী বই থেকে জ্ঞান আহরণ করতেন বলে জানা যায়।বীরচন্দ্রের রাজত্বকালে এপোলোনিয়াস নামে এক ফরাসি ফটোগ্রাফার কিছুদিন আগরতলায় ছিলেন।আরও জানা যায় যে,মৃত্যুর কয়েক বছর আগে রাজা এক্স-রে ছবি তোলারও যন্ত্রপাতি কিনেছিলেন।কিন্তু সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি এসে পৌঁছবার আগেই তাঁর মৃত্যু ঘটে।এমনকি,কলকাতায় শেষ সফরকালে রাজা হাফটোন ব্লক তৈরির পদ্ধতি শিখেছিলেন বলেও জানা যায়।

বীরচন্দ্রের এডিসি কর্ণেল মহিমচন্দ্র দেববর্মা লিখেছেন, রাজভবনে বাগানবাড়ির কক্ষটি ছিল রাজার 'সুখের আলয়','সর্ব্ববিদ্যার আগার'।তিনি এই স্টুডিওটিকে বীরচন্দ্রের 'চিত্রবিদ্যা,রাসায়নিক এবং শিল্পশিক্ষার ও আলোচনার একটি মন্দির' বলেও অভিহিত করেছেন।কর্ণেল মহিমচন্দ্রের লেখা সূত্রে আরও জানা যায় যে, মহারাজার ইচ্ছা ছাড়া নিজ পরিজনদের কারও এই কক্ষটিতে প্রবেশাধিকার ছিলনা।সেজন্য সাধারণের মধ্যে এই ঘরটির নাম হয়েছিল 'মানাঘর'।উল্লেখ করা যায় যে,রাজার ফটোগ্রাফি চর্চায় সহকারী হিসেবে কাজ করতেন মহিমচন্দ্র।পরবর্তী সময়ে তাঁর 'দেশীয় রাজ্য' গ্রন্হে বীরচন্দ্রের চিত্রাঙ্কন ও ফটোগ্রাফি চর্চার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।বীরচন্দ্রের দরবারে চাকরি করতেন শ্রীনিবাস বন্দ্যোপাধ্যায়।তাঁর লেখা 'স্বাধীন ত্রিপুরাধিপতি বীরচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুর' শিরোনামের প্রবন্ধ থেকে রাজার ছবি আঁকা সম্পর্কে মহিমচন্দ্র উদ্ধৃত করেছেন-"...কোন বিবসনা রমণীর চিত্র অঙ্কিত করিতে বসিলে দুচারিটী বিশিষ্ট লোক ভিন্ন অন্য লোকের গৃহে প্রবেশ নিষেধ হইত।দরবারের ভাষায় বলা হইত 'সাক্ষাৎ মানার ছবিতে' আছেন অর্থাৎ নিষিদ্ধ ছবি লইয়া আছেন।"মহারাজা পরিচারিকা মহিলাদের ফটো তুলতেন বলেও মহিমচন্দ্র তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছেন।

সব মিলিয়ে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন বীরচন্দ্র। রাজার কাব্য প্রতিভা নিয়ে সপ্রশংস আলোচনা করেছেন তাঁর কঠোর সমালোচক ঐতিহাসিক কৈলাসচন্দ্র সিংহও। তিনি লিখেছেন,মহারাজ তাঁর কবিতা সমূহ প্রকাশে নিতান্ত অনিচ্ছুক ছিলেন।কিন্তু সেসব প্রকাশিত হলে তিনি বঙ্গীয় কবি সমাজে উচ্চ আসন লাভ করতেন সন্দেহ নেই।সাহিত্য-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি রাজা নিজেও ছিলেন এক সুখ্যাত কবি,গীতিকার, নিপুণ চিত্রকর।সর্বোপরি এদেশের ফটোগ্রাফি চর্চার ইতিহাসেও তিনি স্হান করে নিয়েছেন।ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রত্যন্ত এক দেশীয় রাজ্যের রাজার বহুমুখী প্রতিভা যেন একবিংশ শতাব্দীতেও আমাদের বিস্ময়ের উদ্রেক করে!


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.