মুরারি মোহন সাহা ( ১৯৩৪ - ২০২৪); চির সবুজ জ্ঞান তাপস
পুরুষোত্তম রায় বর্মন
৯০ বছর বয়সে প্রয়াণকে এক অর্থে অকাল প্রয়াণ বলা যাবে না। কিন্তু গভীর অর্থে অবশ্যই অকাল প্রয়াণ। একুশে ফেব্রুয়ারী রাত্রি ৮ঃ৩০ মিনিটে জীবনাবসান হয়েছে মুরারি মোহন সাহার। শিবনগরে নিজ বাড়িতে । অভিভাবকের স্নেহ ও ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হলাম। ৯০ বছর বয়সে অশক্ত শরীরে মনের দিক থেকে ছিলেন চিরসবুজ তরুণ। একজন যথার্থ জ্ঞান সাধক ও জ্ঞানপিপাসু ছিলেন । দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে এসেছে । তবুও ম্যাগনিফাইং গ্লাসের সাহায্যে চোখের কাছে ভারী পুস্তক নিয়ে নিবিড় পড়াশোনায় মগ্ন থাকতেন প্রহরের পর প্রহর । জীবন একটাই, জ্ঞানের ভান্ডার অপরিসীম । জীবনরসিক মানুষ জীবনকে চরিতার্থ করার জন্য কর্মে ও জ্ঞানে অনলস। যতদিন বাঁচবো ততদিন জ্ঞানের সাগরে অবগাহন করব। জ্ঞান ভান্ডার থেকে নূড়ির পর নূড়ি সংগ্রহ করে চেতনা ও মননকে শান দেবো। শোষণ ও শাসনের মনস্তাত্ত্বিক সৌধকে চূড়মাড় করে মানব মুক্তির বৌদ্ধিক ইমারতের ভিত নির্মাণ করার জন্য। জীবনবোধের এই সঞ্জীবনী মন্ত্রে দীক্ষিত ছিলেন মুরারী মোহন সাহা । জন্ম অবিভক্ত বাংলার নোয়াখালি জেলার নেমতপুর গ্রামে । দেশভাগের পর সপরিবারে ত্রিপুরায় আসেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলিতে অনুশীলন সমিতির নেতৃবৃন্দের সংস্পর্শে এসেছিলেন। অনুশীলন সমিতির নেতৃত্বের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ পরবর্তী সময়ে বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দল বা আরএসপি গঠন করেন। তাই মুরারীবাবু বামপন্থার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন স্বাভাবিকভাবেই । রাজ্য সরকারি কর্মচারী ছিলেন । কর্মচারী আন্দোলনের নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিলেন। ১৯৬০ - ৬১ সনে ছিলেন টিজিইএর সাধারণ সম্পাদক । ১৯৭৪ এর লাগাতার ধর্মঘটের সময়ে অকুতোভয়ে নেতৃত্বের অন্যতম অংশীদার ছিলেন। চাকুরী থেকে অবসরের পর সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৮৯ থেকে ২০০৩ অব্দি আরএসপি দলের রাজ্য সম্পাদক ছিলেন। প্রগতিশীল সাহিত্য কেন্দ্র লোকায়ত চেতনা বিকাশ ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন । কর্মচারী আন্দোলনের ইতিহাস গ্রন্থের সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য ছিলেন। তাঁরই সম্পাদনায় আরএসপি দলিল সংগ্রহ চার খন্ডে বেরিয়েছে।
মুরারি মোহন সাহাকে চিনতাম ৮০র দশক থেকেই। ৯০ এর দশকে তাঁকে দেখতাম হাইকোর্টে প্রায়ই আসতেন প্রয়াত ভবেশ দাস এর কাছে। স্থির ধীর প্রকৃতির মানুষ । কথাবার্তা সব সময়ই পরিমিত। কিন্তু ঘরোয়া মজলিসে রসিক। আমার বাবা প্রয়াত উমাপদ বর্মনের সাথে পরিচয় ছিল। বাবা টিজিই এর সভাপতি ছিলেন পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে । বাবার সাথে পরিচয়ের সূত্রে আমি কাকু বলে ডাকতাম। বিয়ের পর মুরারী কাকুর সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে । কেননা তিনি সামন্তার মামা । আমি ও সামন্তা মাঝেমধ্যে যেতাম শিবনগরের বাড়ীতে। খুব খুশী হতেন আমাদেরকে দেখে । ওদের বাড়ীতে গিয়ে দেখতাম দুই সহোদরের পরস্পর নির্ভরশীলতা । প্রবীণ বয়সেও দুই ভাইয়ের মধ্যে অপূর্ব মিল । ছোট ভাই ছিলেন মলয় সাহা । অধ্যাপক ছিলেন। দুই ভাই ছিলেন অকৃতদার । মলয় কাকু ছিলেন দারুন রসিক। জমিয়ে গল্প বলতে পারতেন। হাসিতে পেট ফাটার যোগাড় হতো। আমাদের বাড়িতে বছর ১৩ /১৪ পূর্বে একদিন মুরারী কাকু ও মলয় কাকু এলেন। ভাই গৌতম মলয় কাকুর ছাত্র ছিল। বাড়ী এসে আমাদের কাছ থেকে সান্ধ্যনীড় বৃদ্ধাবাসের বিষয়ে জানামাত্রই মুরারী কাকু বললেন, প্রতি মাসে আমি ৫০০ টাকা করে সান্ধ্যনীড়ে চাঁদা দেবো। নিয়মিতভাবে সান্ধ্যনীড়ে চাঁদা দিয়ে গেছেন। প্রতিবছর জানুয়ারি মাসে চলতি বছরের ৬০০০ টাকা দিতেন । কখনো পাঠিয়ে দিতেন । কখনো খবর পাঠাতেন , আমি ও সামন্তা গিয়ে নিয়ে আসতাম। ২০২৪ সনের চাঁদাও দিয়ে গেছেন। এছাড়াও সান্ধ্যনীড়ের আবাসিকদের বিভিন্ন সময়ে মূল্যবান সামগ্রী দিয়েছেন। সান্ধ্যনীড়ের বার্ষিক সংখ্যায় দু-একবার লিখেছেনও।
বিশাল পরিমাণ অমূল্য গ্রন্থরাজি মুরারী মোহন সাহার ব্যক্তিগত সংগ্রহে ছিল । কয়েক বছর পূর্বেও বইমেলায় আসতেন , বই কিনতেন দেদার। শুধু কেনার জন্য কেনা নয়, পড়ার জন্য কেনা । বেশ কয়েক বছর পূর্বের কথা। আমাকে ও সামন্তাকে ডেকে পাঠালেন। আমরা এক রবিবারে গেলাম । যেতেই বললেন, তাঁর একান্ত ইচ্ছা , তাঁর সমস্ত বইগুলো আমাকে দিয়ে দেবেন। তাঁর অবর্তমানে বইগুলো সদ্ব্যবহার করার জন্য। বইগুলো অবশ্যই অমূল্য ও বিরল। চিরায়ত সাহিত্য, মার্কসীয় চিরায়ত পুস্তক, ইতিহাস, দর্শন ও রাজনীতির আকর গ্রন্থাবলী, ধর্মীয় পুস্তক, দেশি-বিদেশি চিরায়ত সাহিত্য ইত্যাদির এক বিপুল লোভনীয় সম্ভার। লোভ সংবরণ করে বললাম, কাকু এতগুলো বই আমি বাকি জীবনে পরে উঠতে পারব বলে মনে হয় না । আর এতগুলো বই রাখার জায়গাও নেই। এই বইগুলো নিয়ে পাঠাগার গড়ার প্রস্তাব দিলেন । সময় চেয়ে নিলাম । মৃন্ময়ের সাথে কথা বললাম । মৃন্ময় রাজি হলেও পাঠাগার গড়ার পরিকাঠামোগত সমস্যা ইত্যাদি কারণে আমরা সমস্যায় পড়লাম । এই কারণেই তৎকালীন মেয়র-ইন কাউন্সিলর ফুলন ভট্টাচার্যের সাথে যোগাযোগ করে মুরারী কাকু তাঁর বিশাল গ্রন্থ সংগ্রহ আগরতলা পুরো নিগমের লাইব্রেরীতে দান করেন। নিশ্চয়ই এখন বইগুলো পোকায় কাটছে। আমরা মুরীকাকুদের যোগ্য উত্তরসূরী হয়ে উঠতে পারিনি।
মার্কসবাদ ও সমাজ প্রগতিতে দৃঢ় আস্থাবান ছিলেন । পড়াশোনার পরিধি ও গভীরতা ছিল ব্যতিক্রমী। বামপন্থী নেতা ও কর্মীরা আজকাল পাঠবিমুখ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই । এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত ছিলেন মুরারী মোহন সাহা । প্রকৃত বামপন্থায় যারা আলোকিত তাঁরা প্রকৃতই মুক্তমনা ও উদার হৃদয়ের মানুষ। মানুষকে উজাড় করে ভালবাসতে জানেন বলেই মানুষের মুক্তি ও মানুষের কল্যাণকে জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন। নিজের পরিবার না থাকলেও ভাই ও বোনদের পরিবারকে বটবৃক্ষের মতো আগলে রেখেছেন নিবিড় মমতায়, নিবিড় ছায়ায় ও নিরাপত্তায়। বেশ কয়েক বছর পূর্বের স্মৃতি এখনো একদম সতেজ। সামন্তার দিদিমা মারা গেছেন। শ্মশানে গেছি আমরা । মুরারী কাকু গেছেন। পড়ন্ত বিকেলে ৯৫ বছর বয়সি বৃদ্ধার শরীর জুড়ে চিতার লেলিহান আগুন খেলা করছে উদ্দাম। মুরারী কাকু চিতা থেকে ৫০ গজ দূরে একটি চেয়ার টেনে বসেছেন। আমাকে কাছে পেয়ে বলতে শুরু করলেন, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু ভাবনা, বুদ্ধদেবের বস্তু থেকে জীবনের বিকাশ ভাবনা, কাঠপোনিষদের জীবনমৃত্যু সংক্রান্ত শ্লোক । আমি শুনছি। আর তারিফ করছি মৃত্যুর মুখোমুখি বসে ৮৫ বছরের এক যুবকের মৃত্যুর দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়াকে।
প্রণাম মুরারী মোহন সাহাকে । শ্রদ্ধাবনত চিত্তে। তাঁর জীবন এক প্রেরণা । কর্মে , চিন্তায় ও জ্ঞানে চির সক্রিয় ও চিরসবুজ থাকার। আমরা যেন তাঁর অসমাপ্ত কর্মের যোগ্য হয়ে উঠতে পারি।